দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একজন কর্মকর্তাকে অপসারণের ঘটনায় সচেতন মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। চিহ্নিত করা হচ্ছে এই কাণ্ডে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করেছে কি না। নাকি শর্ষের মধ্যে ভূত লুকিয়ে আছে।
এরই মধ্যে গণমাধ্যমে এসে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন বহিষ্কার হওয়া দুদকের সাবেক উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দীন। অপরদিকে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা, ঘুষসহ অনেক অভিযোগ রয়েছে বলে দুদকের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে জনমনে প্রশ্ন, অপসারণের ঘটনাটি দুর্নীতিবাজদের উৎসাহিত করবে, নাকি দুর্নীতি দমনে কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে। দুদকের এই পদক্ষেপ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে তুমুল সমালোচনা।
আর জনমনে সৃষ্টি হওয়া এসব ধোঁয়াশা দূর করতে দুদকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি মনে করে, জনমনে তৈরি হওয়া এসব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হলে দুর্নীতি দমনে কাজ করা সংস্থাটির বিশ্বাসযোগ্যতা গভীরতর সংকটের মুখে পড়বে।
দুদক প্রজ্ঞাপনে অপসারণের বিষয়ে বলা হয়, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮ - এর বিধি ৫৪ (২) তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পটুয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হলো। তিনি বিধি মোতাবেক ৯০ দিনের বেতন এবং প্রযোজ্য সুযোগ-সুবিধা (যদি থাকে) পাবেন। কমিশনের অনুমোদনক্রমে জনস্বার্থে এ আদেশ জারি করা হলো। যা ১৬ ফেব্রুয়ারি (২০২২) অপরাহ্ন থেকে কার্যকর গণ্য হবে।’
প্রজ্ঞাপন প্রকাশিত হওয়ার পরের দিন (১৭ ফেব্রুয়ারি) অফিস শুরু হওয়ার পরেই সংস্থার প্রধান কার্যলয়ের সামনে মানববন্ধন করে দুদক কর্মকর্তা-কর্মচারী। এর আগে তারা দুদক সচিব বরাবর একটি স্মরকলিপিও দিয়েছেন। যা দুদক প্রতিষ্ঠার পর প্রথম কোনো ঘটনা। ওই দিন পটুয়াখালী এবং চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ২১টি জেলায় মানববন্ধন হয়েছে বলে খবরে জানা গেছে।
চাকরিচ্যুতির ঘটনায় টিআইবি তার বিবৃতিতে বলেছে, শরীফ উদ্দীনের ঘটনার সঠিক চিত্র প্রকাশ না হলে- দুর্নীতি দমনে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করা সৎ ও সাহসী কর্মকর্তারা উদ্যম হারিয়ে ফেলবেন, যা দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থানকেই দুর্বল করে ফেলবে, যেটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। দুদক নেতৃত্ব এ বিষয়ে নিজেদের প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে সৃষ্ট ধোঁয়াশা দূর করবে এমনটাই প্রত্যাশা করে টিআইবি।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার দুদক প্রধান কার্যলয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, দুদকের উপসহকারী পরিচালক শরীফ, তিনি এই দুর্নীতি দমন কর্মচারী চাকরি বিধিমালা, ২০০৮ অনুযায়ী যেসব বিধি-বিধান মানা প্রয়োজন তা না মেনে অব্যাহতভাবে বিধির পরিপন্থি কাজ করে যাচ্ছেন। যার কারণে কমিশন মনে করেছে, কমিশনের ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থে, সকলে যাতে সঠিকভাবে কাজ করে, সে লক্ষ্যে তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে। এটি কোনো ব্যক্তির বিষয় নয়। এটি প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি রক্ষা এবং যাতে আমারা বিধি মেনে চলি, সেজন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
শরীফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, চট্টগ্রামে কর্মরত থাকাকালে তিনি আদালতের অনুমতি ছাড়াই সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের কক্সবাজার শাখার একটি হিসাব নম্বর স্থগিত করেন। তার ওই কর্মকাণ্ড চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করলে ২০২১ সালের ২৭ জুন শুনানিতে আদালত বলেছেন- কমিশনের অনুমোদন ব্যতীত কোনো অ্যাকাউন্টের অর্থ উত্তোলন বন্ধ করার ক্ষমতা তদন্তকারী কর্মকর্তার নেই।
দুদক চট্টগ্রাম কার্যালয়ের (কক্সবাজার) এর মামলা নং- ১ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) কর্তৃক জব্দকরা ৯৩ লাখ ৬০ হাজার ১৫০ টাকা জব্দ করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন ওই টাকা কক্সবাজার সদর মডেল থানার উপপরিদর্শক আরফাতুল আলমের নিকট থেকে চালানমূলে গ্রহণ করলেও সরকারি কোষাগারে অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা দেয়নি। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়। যা কমিশনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে দাবি করা হয়।
ফলে শরীফকে জনস্বার্থে গত ১৬ জুন সজেকা, চট্টগ্রাম-২ থেকে সজেকা, পটুয়াখালীতে বদলী করা হয়। এরপর দীর্ঘ একমাস পর ১৭ জুলাই ই-মেইলযোগে সমন্বিত জেলা কার্যালয়, পটুয়াখালীতে যোগদানপত্র প্রেরণ করে গত ১০ আগস্ট সশরীরে সমন্বিত জেলা কার্যালয়, পটুয়াখালীতে উপস্থিত হন। বদলি বাতিলের জন্য একজন আইনজীবীর মাধ্যমে হাইকোর্টে ১০৫ (এ-৭)/২০২১ রিট আবেদন করেন শরীফ। হাইকোর্ট রিট আবেদনটি খারিজ করে দেন। তার এই কর্মকাণ্ডকে ধৃষ্টতা বলে মনে করেন দুদক সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া, বদলির পর তার নিকট রক্ষিত নথিসমূহ যথাসময়ে হস্তান্তর না করে দীর্ঘ আড়াই মাস পর ২৯ আগস্ট হস্তান্তর করেন।
শরীফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম থাকাকালীন চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন অফিস ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কথা বলে কোটি কোটি টাকার ঘুষবাণিজ্য এবং চাঁদাবাজি করেন।
অন্যদিকে শরীফ উদ্দিন নিজেই অভিযোগ করেছেন, কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির মামলার তদন্ত করে তিনি আমলা, রাজনীতিকসহ প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছিলেন, সেজন্য রোষানলে পড়ে তাকে চাকরি হারাতে হয়েছে।
মন্তব্য