রাজধানীতে রয়েছে গাড়ি চোরচক্রের অর্ধশত সিন্ডিকেট। নানা কৌশলে ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে গাড়ি চুরি করে এসব চক্র। বিভিন্ন সময়ে মাঠ পর্যায়ের চোররা গ্রেপ্তার হলেও মূলহোতারা থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
চার শ্রেণিতে বিভিক্ত হয়ে চুরি করে এসব চক্র। প্রথম অংশটি মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করে গাড়ি চুরি করে। দ্বিতীয় অংশটি গাড়ির চেসিস নম্বর পরিবর্তন করে, তৈরি করে ভুয়া কাগজ। তৃতীয় অংশটি গাড়ি বিক্রির কাজ করে। চতুর্থ অংশটি থাকে পর্দার আড়ালে। গাড়ি চুরি করতে গিয়ে কেউ আটক হলে তাদের ছাড়িয়ে নিতে সহযোগিতা করে এই চক্র। এই চক্রের কেউ কেউ নিজেরাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বলে তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কলাবাগানের হাতিরপুলের পুকুরপাড় মসজিদের সামনে থেকে চুরি হয় একটি সিএনজি অটোরিকশা (ঢাকা মেট্টো-থ ১২-০৩৭৬)। গাড়ির মালিক দয়াগঞ্জের মৃত আলফাজ উদ্দিনের ছেলে তোতা মিয়া। এ ঘটনায় ওই দিন কলাবাগান থানায় একটি চুরির মামলা করেন তিনি।
পুকুরপাড় মসজিদ এলাকার বিভিন্ন সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে দেখা গেছে, গাড়িটি চুরি করার সময় আরো একটি সিএনজি অটোরিকশার (ঢাকা-দ-১১-২৬৩১) সহযোগিতায় নেয় চোর।
ফুটেজে একজনকে দেখা গেছে, তোতা মিয়ার অটোরিকশাটি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল। এটি গিয়ারে থাকায় নিউটাল করে বাম্পারে রশি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ফুটেজে দেখা ওই ব্যক্তির নাম আবদুল মালেক।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, যে অটোরকিশার সহযোগিতায় এটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ওই অটোরিকশার মালিক পুলিশ সদস্য এমদাদুল হক। তিনি পুলিশের ঢাকার ট্রান্সপোর্ট বিভাগে কর্মরত। চুরি হওয়ার পর গাড়িটি বিক্রি করা হয় রংপুরে তাহের নামে এক ব্যক্তির কাছে। গাড়ি বিক্রি করতে সহযোগিতা করে এমাদ উল্লাহ ও হারুন নামে দুই ব্যক্তি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এমাদ উল্লাহ ও হারুন গাড়ি বিক্রি ও গাড়ির মালিকের কাছ থেকে টাকা আদায় করে গাড়ি ফেরতের ব্যবস্থা করে। এই চক্রের আরো কিছু সদস্য রয়েছে বলে জানা গেছে।
তারা গাড়ির চেসিস নম্বর পরিবর্তন করে। ভুয়া কাগজপত্র তৈরির কাজ করে। পাঞ্চ মেশিনের মাধ্যমে চেসিস ও ইঞ্জিন নম্বর পরিবর্তন করে তারা। পরে বিআরটিএ’র দালালের মাধ্যমে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে গাড়িগুলো বিক্রি করে।
কিছু ক্ষেত্রে কাগজ ছাড়াই গ্রাম এলাকায় চোরাই গাড়ি বিক্রি করা হয় বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। এই প্রক্রিয়াতেই তাহেরের কাছে গাড়িটি বিক্রি করা হয়। তোতা মিয়ার সিএনজি অটোরিকশা চুরির ঘটনায় মামলা দায়েরের পর অভিযানে নামে পুলিশ। কলাবাগান থানার উপপরিদর্শক আলী আহমদ জানান, এ ঘটনায় এমাদ উল্লাহ, হারুন ও গাড়ির ক্রেতা তাহেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চালক মালেক এখনো পলাতক।
সূত্র মতে, মামলার পর পুলিশ কনস্টেবল এমদাদুল হককে থানায় ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরবর্তী সময়ে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রংপুর থেকে সিএনজি অটোরিকশাটি উদ্ধার করা হয়।
কিন্তু এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্তকারী কর্মকর্তা আলী আহমদ জানান, এমদাদুল হকের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো কথা হয়নি। যে সিএনজি অটোরিকশার মাধ্যমে তোতা মিয়ার অটোরিকশাটি চুরি করা হয়েছে এর মালিকানা অস্বীকার করছেন এমদাদুল হক।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালে এটি বিক্রি করেছেন পিবিআই সদর দপ্তরে কর্মরত কনস্টেবল রুহুল আমিনের কাছে। কিন্তু নানা কারণে কাগজপত্রে মালিকানা পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি।
কিন্তু বিষয়টি অস্বীকার করেন রুহুল আমিন। তিনি বলেন, ওই সিএনজি অটোরিকশার মালিক আমি না। যার নামে কাগজ সেই মালিক। আমি এমদাদুল হকের কাছে ৭ লাখ ৫৫ টাকা পাই। ওই টাকা না পেলে তিনি এমদাদুলের বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলে জানান। কিন্তু এটি কিসের টাকা তার কোনো সদোত্তর দেননি তিনি।
প্রায়ই চোরাই গাড়ি উদ্ধার করা হয়। কিন্তু মূলহোতাদের গ্রেপ্তার করা দুষ্কর হয়ে যায়। গত বছরের শেষের দিকে রাজধানীর গেন্ডারিয়ায় অভিযান চালিয়ে তিনটি চোরাই গাড়িসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগের সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ, গাড়ি চুরি প্রতিরোধ ও উদ্ধার টিম। জব্দ করা হয় একটি মাইক্রোবাস ও দুটি প্রাইভেট কার।
গ্রেপ্তার আনোয়ার বিভিন্ন কৌশলে গাড়ি চুরি করে জসিমের কাছে হস্তান্তর করে। মোহাম্মদ আলীর গ্যারেজ থেকে গাড়ির ইঞ্জিন ও চেসিস নম্বর পরিবর্তন করে বিক্রি করে জসিম। চেসিস নম্বর পরিবর্তন করা হলে গাড়িগুলো ট্র্যাকিং করা সম্ভব না হয়। অবাধে এসব গাড়ির কাগজ তৈরি করে বিক্রি করে চক্রের সদস্যরা।
গাড়ি চোরচক্রের হোতা সোহেল। গত বছরের আগস্টে মিরপুরের দারুস সালাম এলাকা থেকে সোহেলসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে চারটি পিকআপ জব্দ করা হয়। এই চক্রটি মূলত পিকআপ চুরি করে। গত তিন বছরে শতাধিক গাড়ি চুরি করেছে তারা।
র্যাব জানিয়েছে, সোহেল ও সাগর দুই ভাই। তাদের মধ্যে সোহেল মুহূর্তের মধ্যে গাড়ির জিপিএস সিস্টেম অকেজো করতে জানত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে নিজেদের রক্ষা পেতে কঠোর সাবধানতা অবলম্বন করত। তথ্যপ্রযুক্তি থেকে দূরে থাকত এই চক্রের সদস্যরা।
ডিএমপির উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ফারুক হোসেন বলেন, গাড়ি চুরি প্রতিরোধ করতে পুলিশ সক্রিয় রয়েছে। প্রায়ই গাড়ি উদ্ধার ও জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
মন্তব্য