-->
শিরোনাম

পুলিশ হেফাজতে যেভাবে মারধর করা হয় উজিরকে

রুদ্র মিজান
পুলিশ হেফাজতে যেভাবে মারধর করা হয় উজিরকে
উজির মিয়া। সংগৃহীত ছবি

সুনামগঞ্জে চাঞ্চল্যকর উজির মিয়া ‘হত্যাকাণ্ডের’ অভিযোগে তদন্তে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। উজিরকে গ্রেপ্তারের পর তাকে বেদম মারধর করা হয় দক্ষিণ সুনামগঞ্জ (শান্তিগঞ্জ) থানা হাজতে। উজিরকে মারধরের সময় বেশ ক্ষিপ্ত ছিলেন এসআই দেবাশীষ সূত্রধর।

নিজেকে বাঁচাতে বারবার অনুনয় করেছেন উজির মিয়া। তাতে কর্ণপাত না করেই এসআই দেবাশীষসহ একের পর এক পুলিশ সদস্যরা সেই রাতে উজিরকে মারধর করেন। তাদের মার থেকে রক্ষা পেতে উজির তখন চিৎকার করে কেঁদেছেন। উজির মিয়ার নামে চুরির মামলা বা অভিযোগ থাকা দূরে থাক তথ্য প্রমাণ অনুসারে চুরি ঠেকাতে যারা সক্রিয় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। উজির মিয়া নিজেও ছিলেন ভুক্তভোগী। উজির মিয়ার স্বজনদের বক্তব্য ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

৯ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে শত্রুমর্দন গ্রামে উজির মিয়ার ঘরে অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় উজির মিয়া বাসা থেকে বের হতে না চাইলে পুলিশ জোর করে গাড়িতে তোলে।

নিহতের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, গ্রেপ্তারের সময় উজির মিয়াকে ধরে গ্রিলের সঙ্গে ধাক্কা দেন এসআই দেবাশীষ। এ সময় তিনি মাথায় আঘাত পান। পরবর্তী সময়ে তাকে ধরে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

অভিযানকালে পুরো ঘর ঘিরে রাখে পুলিশ। ঘরের পেছনে অবস্থান করছিলেন এসআই পার্ডন কুমার সিংহ। ওই রাতে ওই গ্রাম থেকে শহীদ ইসলাম ও আক্তার মিয়াকে আটক করে পুলিশ। একই গ্রামের উস্তার আলীর ঘরের প্রায় ২ লাখ টাকা মূল্যের মালামাল চুরির ঘটনায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। রাত প্রায় ১টার দিকে থানায় নিয়ে আলাদা কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাদের।

জিজ্ঞাসাবাদ করেন এসআই দেবাশীষ সূত্রধর, এসআই এমদাদুল হক, এসআই লুৎফর রহমান ও এসআই আলাউদ্দিন। পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদে শহীদ ইসলাম ও আক্তার মিয়া চুরির অভিযোগ অস্বীকার করেন। পরবর্তী সময়ে পূর্বে গ্রেপ্তারকৃত চিহ্নিত চোর শামীমের মুখোমুখি করলে উস্তার মিয়ার ঘরে চুরির বিষয় স্বীকার করে।

পরে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে শহীদ ও আক্তার জানায়, বেদম মারধরের কারণে চুরির ঘটনায় সম্পৃক্ত না হয়েও চুরির বিষয়ে স্বীকার করে। সেইসঙ্গে তারা জানায়, চুরির মালামাল উজির মিয়ার কাছে রয়েছে। শহীদ ও আক্তারের স্বীকারোক্তি অনুসারে তাদের মারধর করেছেন এসআই পার্ডন কুমার ও এএসআই আক্তারুজ্জামান। পায়ের তলায় লাঠি দিয়ে লাগাতার আঘাত করার সময় পুলিশ যা বলেছে তাই স্বীকার করেছে বলে জানায় তারা। অন্যদিকে তারা জানায়, উজির মিয়াকে তখন বেদম প্রহার করেন এসআই দেবাশীষ।

লাঠির আঘাতে চিৎকার করছিলেন উজির মিয়া। দেবাশীষ ছাড়াও কয়েকজন তাকে মারধর করেছেন বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। মারধরের শিকার হয়েও বারবার বলছিলেন, চুরির ঘটনায় তিনি জড়িত না। মারধরের ফলে একপর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে মেজেতে পড়ে যান তিনি।

এ সময় উজির মিয়াসহ তিনজনকে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতলে নিয়ে যান এসআই পার্ডন কুমার সিংহ ও এসআই এমদাদুল হকসহ পুলিশ সদস্যরা। উজির মিয়ার অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অন্যদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। উজির মিয়ার ঘওে চোরাই মালামাল রয়েছে বলে অভিযোগ করা হলেও তার বাড়ি থেকে কোনো মালামাল জব্দ করতে পারেনি পুলিশ। পরে গত ১৪ জানুয়ারির একটি চুরির মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় তাকে।

পরদিন ১০ ফেব্রুয়ারি আদালত উজির মিয়া, শহীদ ও আক্তারের জামিন মঞ্জুর করেন। বাড়ি ফেরার পর অসুস্থতা বাড়তে থাকে উজিরের। উজিরের খোঁজ নিতে তার বাড়িতে যান দক্ষিণ সুনামগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত)সহ দুই পুলিশ সদস্য। পরে উজিরকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে মারা যান উজির মিয়া। তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এলাকাবাসী। তারা সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন।

জানা গেছে, ৯ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ১২টায়র ওই অভিয়ানে অংশগ্রহণ করেন এসআই দেবাশীষ সূত্রধর, এসআই পার্ডন কুমার সিংহ, এসআই অনুপম দেবনাথ, এসআই এমদাদুল হক, এসআই লুৎফর রহমান, এসআই আলাউদ্দিন, এএসআই আক্তারুজ্জামান, কনস্টেবল ওয়াসিম হাজরা, কনস্টেবল মোখলেছুর রহমান, ফরিদ মিয়া ও ইয়াছির আরাফাত। ইতোমধ্যে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা পুলিশ সদস্যদের এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।

উজির মিয়া নিজেই ছিলেন ভুক্তভোগী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধেই চুরিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠে। গত বছরের নভেম্বর থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত দক্ষিণ সুনমাগঞ্জের বাঘের কোনা শত্রুমর্দন ও পশ্চিম পাগলা ইউনিয়ন এলাকায় ২১ জনের ঘর ও গরু চুরির ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে গত ২০ জানুয়ারি দক্ষিণ সুনামগঞ্জ (শান্তিগঞ্জ) থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন ভুক্তভোগীরা।

তাদের মধ্যে একজন্য শান্তিগঞ্জের শত্রুমর্দন গ্রামের উজির মিয়া। তার ঘর থেকে চোরেরা প্রায় ২৫ হাজার টাকার মালামাল চুরি করে নিয়ে যায়। ওই ঘটনায় অন্যান্য ভুক্তভোগীর সঙ্গে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। এদিকে গ্রাম্য সালিশে একই গ্রামের পেশাদার চোর শামীমের সহযোগী অপ্রাপ্তবয়স্ক শাহাবুদ্দিন স্বীকার করে শামীম ও সে মিলে উজির মিয়ার ঘর চুরি করেছে।

পুলিশের দেওয়া তথ্যানুসারে, ৯ ফেব্রুয়ারি শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানায়, একই গ্রামের উস্তার আলীর ঘর চুরির ঘটনায় উস্তার আলীর ভাতিজা শহীদ, আক্তার ও উজির মিয়া জড়িত। তার দেওয়া তথ্যানুসারেই পরবর্তী অভিযানে উজির মিয়াসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

উজির মিয়ার স্বজনরা জানান, উজিরের চাচাত ভাই রেজাউল আলম নিকু চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে একই ইউনিয়নের রণিজত সূত্রধরের। তাদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে অতীতে। এ নিয়ে ২০১৭ সালের ১৮ মে থানায় মামলা হয়। রণজিত সূত্রধরের মামলায় আসামি ছিলেন নিকুর চাচাতো ভাই উজির মিয়া।

উজিরের স্বজনরা জানান, রণজিতের আত্মীয় এসআই দেবাশীষ। সে হিসেবে উজিরকে পরিকল্পিতভাবে গ্রেপ্তার ও মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ তাদের। কিন্তু রণজিত সূত্রধর জানান, অতীতের সেই বিরোধ মীমাংসা হয়েছে বেশ আগে। উজিরের মৃত্যুর সঙ্গে এই বিরোধের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেন তিনি।

এদিকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি উজির মিয়াকে ‘হত্যার’ অভিযোগে এসআই দেবাশীষ সূত্রধর ও এসআই আলাউদ্দিনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেছেন নিহতের ভাই ডালিম মিয়া। তার আগে ২৭ ফেব্রুয়ারি এসআই দেবাশীষ সূত্রধরকে ক্লোজড করে সুনামগঞ্জ পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়।

মন্তব্য

Beta version