অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে ফিরে

ইদ্রিস আলম
অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে ফিরে

# মা তোমরা আমাকে বাঁচাও... ওরা মেরে ফেলবে! # বিক্রি হয়েছেন ৪-৫ বার # নির্যাতনের দৃশ্য দেখানো হতো ভিডিও কলে # ১৫-২০ লাখ টাকায়ও মেলেনি সুখ #

‘মা গো তোমরা আমাকে বাঁচাও! তোমরা আর আমাকে দেখতে পাবে না মা। অনেক নির্যাতন করে, সারাদিন শুধু একটা রুটি আর এক বোতল পানি দেয় খাইতে। যেভাবে পার তোমরা ওদের টাকা দিয়ে

আমাকে বাঁচাও মা!- এভাবেই ভিডিও কলের অপর প্রান্ত থেকে ভয়ঙ্কর নির্যাতনের কথা জানান আমিনুল বেপারি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ভিডিও কলে দেখানো হতো পরিবারের সদস্যদের

নির্যাতনের দৃশ্য। টাকা না দিলেই বেড়ে যেত নির্যাতনের মাত্রা।’ ১৫ লাখ টাকাতেও মেলেনি সুখের মুখ। প্রথমে ১০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এর পর নির্যাতন থেকে বাঁচাতে আরো ৫ লাখ টাকা দেওয়ার পরও

নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে পারিনি। ভোরের আকাশের কাছে এভাবেই ছেলের ওপর নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন রিনা বেগম।

মাদারীপুর থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরে লিবিয়ায় নির্যাতনের শিকার এক মায়ের আর্তনাদের কথা বলছি। এমন আর্তনাদ রয়েছে সবারই। চল্লিশার্ধো মহিলা রিনা বেগম। চোখেমুখে লেগে আছে আতঙ্কের

ছাপ। ছেলেহারা মায়ের যেমনটা হওয়ার কথা, ঠিক তেমনই। এক নজর কলিজাছেঁড়া ধনকে দেখতে ছোটাছুটি করেন টার্মিনালের এদিক থেকে ওদিক। কখনো সেনাবাহিনী, আবার কখনো গণমাধ্যমকর্মীর

পিছনে ছুটছেন তিনি। লক্ষ্য একটাই- ছেলে আমিনুলের একটু খবর আর এক নজর দেখা। লিবিয়ায় নির্যাতনের শিকার মাদারীপুরের সাইদুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ‘সাবইকে জোর

অনুরোধ করি- এভাবে যেন আর কেউ বিদেশে না যায়। আমাদের শরীরে মারের দাগ ছাড়া আর কিছু নাই। খেতে দিত না; নির্যাতন করা হতো আমাদের।’

কিভাবে নির্যাতন করা হতো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাই বলে বোঝানোর মতো না। ভয়ঙ্কর নির্যাতন। লিবিয়ার পুলিশও মারত। আমরা পাঁচবার বিক্রি হয়েছি। ১৬ লাখ টাকা দিয়েও সুখ খুঁজে পাইনি।

জীবন নিয়ে ফিরে এসেছি ৬ মাস নির্যাতনের পর।’ মাদারীপুর থেকে বিমানবন্দরে আসা নির্যাতনের শিকার আশিক খানের বাবা হায়দার আলী খান বলেন, ‘প্রথমে বডি কন্ট্রাক ১০ লাখ টাকা। এর পরও

আমার ছেলেকে নির্যাতনের শিকার হতে হলো। সেখান থেকে ছাড়ানোর কথা বলে টাঙ্গাইলের এক দালাল ৪ লাখ টাকা নিয়ে উধাও। এভাবে ১৪ লাখ টাকা দিয়েও আমার ছেলের শেষ রক্ষা হলো না।’ এর

পরও ছেলেকে জীবিত ফিরে পেয়ে শান্তি পেয়েছেন বাবা। ভিডিও কলে নির্যাতনের দৃশ্য দেখানো হতো। যা পৃথিবীর কোনো বাবা-মা সহ্য করতে পারবেন না। শুধু মাদারীপুর থেকেই গেছেন ১২০ জন। এরা

বেশির ভাগ গিয়েছেন ভাগ্যের চাকা বদলাতে। ২০২১ সালের বিভিন্ন সময় দালালের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা খরচ করে স্বপ্নের ইতালি যাওয়ার কথা ছিল তাদের। কে জানত তাদের জায়গা ইতালিতে নয়, হবে লিবিয়ার কারাগারে।

লিবিয়া থেকে নির্যাতনের শিকার মাদারীপুরের রাসেল ঢালী দীর্ঘ ৯ মাস কারাবন্দি জীবন থেকে বেরিয়ে শাহজালাল বিমানবন্দরে ভোরের আকাশের কাছে জানান তাদেও ওপর পাশবিক নির্যাতনের শিকার

ভয়ঙ্কর তথ্য। কথা বলতে কষ্ট হয় তার। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নিয়ে যাওয়া বাসে খুঁড়ে খুঁড়ে হাঁটতে দেখা যায় তাকে।

রাসেল ঢালী বলেন, ‘১০ লাখ টাকা দিয়েও আমরা ইতালিতে যেতে পারিনি। বিক্রি হয়েছি ৫ বার। দালালরা নির্যাতন করত আর বলত বাড়ি থেকে টাকা পাঠাতে। নির্যাতনের দৃশ্য ভিডিও কলে পরিবারের লোকজনদের দেখানো হতো।’তিনি বলেন, নির্যাতনের ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে মনে হতো আর মা-বাবার মুখ দেখতে পারব না। তার নিজের বক্তব্য অনুযায়ী চোখের সামনেই নির্যাতন সইতে না পেরে মারা গেছেন ৮ জন। বিমানবন্দরে

লিবিয়ায় নির্যাতনের শিকার ছোট ভাই ও ভাতিজাকে নিতে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ সদস্য তার মোবাইল ফোন থেকে একটি ভিডিও দেখে জানান, ‘এই পাঁচজন এখনো লিবিয়াতে দালালদের

কাছে আটকা রয়েছে। তাদের দাবি, জনপ্রতি ৪ লাখ করে মোট ২০ লাখ টাকা না দিলে তাদের মেরে ফেলা হবে। সেই ভিডিও ধারণ করা রয়েছে সেই মোবাইলে। ভিডিওতে দেখা যায়, লিবিয়া থেকে আটক

পাঁচজন কান্না করছে আর পরিবারের কাছে টাকা দিতে বলছেন। না হলে তাদের লাশ সমুদ্রে ফেলে মাছ দিয়ে খাওয়ানো হবে।’

ভুক্তভোগীর আত্মীয়রা জানান, ইতালি নেওয়ার কথা বলে দালালচক্র ভিজিট ভিসায় প্রথমে দুবাই, ওমান ও মালয়েশিয়া হয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় লিবিয়ায়। ত্রিপোলির গেমঘরে আটক রেখে নির্যাতন করা

হয় তাদের। পরে আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা আদায় করে চক্রটি। অবশেষে আইওএমের সহায়তায় দেশে ফিরলেন লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে আটক ১১৪ জন বাংলাদেশি। দেশে ফেরা সবাই

অবৈধভাবে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টাকালে লিবিয়ার সরকারি বাহিনী তাদের আটক করে। পরে লিবিয়া সরকার একটি বিশেষ ফ্লাইটে তাদের দেশে পাঠায়। গত বৃহস্পতিবার বোরাক এয়ারের একটি

বিশেষ ফ্লাইটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তারা। পরে পরিচয় শনাক্তের পর সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তিন দিনের কোয়ারেন্টিনের জন্য তাদের উত্তরার হাজি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।

মন্তব্য