-->
শিরোনাম
অনিয়মের নতুন উদাহরণ

খেয়াপারেও সিন্ডিকেট!

* জিম্মি এলাকাবাসী, ব্রিজ করতে বাধা * প্রতিদিন আয় লক্ষাধিক টাকা

এমদাদুল হক খান
খেয়াপারেও সিন্ডিকেট!
সরকার বারবার এসব এলাকায় ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নিলেও শক্তিশালী এ সিন্ডিকেটের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। ছবি- ভোরের আকাশ

খেয়া পারাপারেও সিন্ডিকেট হতে পারে! অবিশ্বাস্য। তবে সত্যি। এ যেন অনিয়মের এক নতুন উদাহরণ। রাজধানীসহ আশপাশের এলাকার সব কটি খেয়াঘাট নিয়ন্ত্রণ করছে ওসব এলাকার সিন্ডিকেট। ঘাটের এপার-ওপারের হাজার হাজার মানুষ জিম্মি ওই সিন্ডিকেটের কাছে।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্রিজ-কালভার্ট কিংবা রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন হলেও খোদ রাজধানীর আশপাশের বেশ কিছু এলাকায় এখনো পারপারের মাধ্যম নৌকা। এসব নৌকা বিনোদনের মাধ্যম নয়। রাজধানীর উপকণ্ঠে নিম্নআয়ের মানুষের নিত্যপ্রয়োজনের, নিত্য যাওয়া-আসার ‘ঘাট’ আর ‘নৌকা’। সচেতন পাঠক এই সংবাদ পড়ে বিস্মিতই হবেন। তবে এটাই সত্যি। রাজধানীর চার পাশের বেশ কটি ছোট খাল পার হতে খেয়াঘাটের টাকা গুণতে হয় নিম্নআয়ের হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে। এসব ঘাটকে পুঁজি করে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রকরা অল্পদিনে বনে যাচ্ছে কোটিপতির।

সরকার বারবার এসব এলাকায় ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নিলেও শক্তিশালী এ সিন্ডিকেটের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বছরের পর বছর সাধারণ মানুষ এই সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে আছে।

জানা যায়, প্রতিদিন এসব খেয়াঘাট থেকে লক্ষাধিক টাকা আয় করছে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। অন্যদিকে খেয়া পারাপার হতে গিয়ে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ওই এলাকার মানুষজনকে। আবার নৌকা ডুবির ঘটনায় প্রতি বছর প্রাণ হারাচ্ছেন অন্তত ১৫-২০ জন। এ ছাড়া ব্রিজ না থাকায় মুমূর্ষু রোগী নিয়ে পড়তে হয় সীমাহীন দুর্ভোগে। সময়মতো হাসপাতালে নিতে না পারায় অনেকের জীবনপ্রদীপও নিভে যাওয়ার ঘটনা রয়েছে।

সরেজমিনে বেশ কয়েকটি এলাকায় ঘুরে খেয়া পারাপার সিন্ডিকেটের চাঞ্চল্যকর এই তথ্য পাওয়া গেছে।

রাজধানীর দারুস সালাম এলাকার ছোট্ট খালে এখনো চলে নৌকা। নৌকার যাত্রী নিম্নআয়ের কর্মব্যস্ত মানুষ। দারুস সালামের বাসস্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে দক্ষিণ দিকের একটি গলির শেষ মাথায় নৌকার ঘাট। এক পাশে দারুস সালাম এলাকা। অন্যপাশে আদাবরের মুনসুরাবাদ। খালটির দূরত্ব সর্বোচ্চ ২০ গজ। এ খালকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। স্থানীয় কাউন্সিলরের ছত্রছায়ায় সরকারদলীয় কয়েকজন নিয়ন্ত্রণ করেন এ ঘাটটি।

এর মধ্যে মোতালেব, হারুন সাহাবুদ্দিন, মনির, মতলব আলী অন্যতম। তাদের ভয়ে এলাকাবাসী মুখ খুলতেও সাহস পান না। প্রতিদিন গার্মেন্টস কর্র্র্মীসহ প্রায় ১০ হাজার লোক এ ঘাট দিয়ে পারাপার হয় বলে স্থানীয়রা জানান। কারো কাছে টাকা না থাকলে তাদের পার হতে দেন না এই চক্র। ইতোপূর্বে এই এলাকায় ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা সম্ভব হয়নি। পরে ব্রিজটি প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরত্বে সরিয়ে গৈদারটেক এলাকায় নির্মাণ করা হয়।

ফলে আদাবর, মনুসরাবাদ এলাকার লোকজনকে খেয়া দিয়ে পারাপার না হলে ৩ কিলোমিটার দূরত্বে ব্রিজ দিয়ে খাল পার হতে হয়। এতে প্রায় খরচ হয় ৬০-৭০ টাকা। তাই খরচ বাঁচাতে খেয়া পারাপারকে বেছে নেয় নিম্নআয়ের মানুষ।

খেয়াঘাটের মাঝি মোতালেব জানান, প্রতিদিন এ ঘাট থেকে যে টাকা আয় হয় তা কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। স্থানীয় মসজিদে দেওয়া হয় প্রতিদিন পাঁচশত টাকা। এ ছাড়া এলাকার ছাত্রলীগ, যুবলীগের বেশ কয়েকজনকে ভাগ দিতে হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা আসলাম সরকার ভোরের আকাশকে বলেন, মাত্র ২০ গজ এ পথের জন্য প্রায় ৩ কিলোমিটার পথ ঘুরতে হয়। অফিসগামী মানুষ বাধ্য হয়ে নৌকায় পার হন। খেয়া পারাপার সিন্ডিকেটের স্থানীয় কয়েক জনের দাপটের কারণে এখানে ব্রিজ করা সম্ভ হচ্ছে না। এক প্রকার জিম্মি হয়ে আছেন দুই পারের বাসিন্দা।

আলেয়া বেগম নামে একজন নারী বলেন, তিনি দারুস সালামের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। থাকেন আদাবরের মুনসুরাবাদ এলাকায়। সময় বাঁচাতে প্রতিদিন এ খেয়াঘাট দিয়েই পারাপার হতে বাধ্য হন। এখানে ব্রিজ তৈরি হলে স্থানীয় অনেকের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এখানে অনেক বড় একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই খেয়াঘাটের বয়স ৭০ থেকে ৮০ বছর। আগে এটি অনেক বড় ছিল, এখন চারদিকে মাটি ফেলে ঘরবাড়ি ও দোকানপাট বসানোর কারণে ঘাট সংকুচিত হয়ে পড়েছে।

এ এলাকার সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর রাজিয়া সুলতানা ইতির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বেশ কয়েকবার এ খালে ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে নানা সমস্যার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। এরপরও মেয়র মহোদয় খালটিতে একটি ব্রিজ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সিটি করপোরেশন থেকে বাজেট পেলেই ব্রিজ নির্মাণ করা হবে।

রাজধানীর দারুস সালাম থানার আরেক খেয়াঘাটের নাম দিয়াবাড়ি খেয়া ঘাট। খেয়াঘাটের অপরপ্রান্ত সাভারের কাউন্দিয়া এলাকা। চারদিকে নদী। মধ্যখানে দ্বীপের মতো গড়ে উঠেছে কাউন্দিয়া ইউনিয়ন। প্রায় ৪০ হাজার বাসিন্দা এ ইউনিয়নে বাস করে। এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি একটি ব্রিজের। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বারবার ব্রিজ নির্মাণের আশ্বাস দিলেও নির্বাচন শেষে তা ভুলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

স্থানীয় আবুল কাশেম নামে এক ষাটোর্ধ ব্যক্তি ভোরের আকাশকে জানান, সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় মুমূর্ষু রোগী নিয়ে। একটি ব্রিজ না থাকায় এ এলাকায় অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করতে পারে না। সময়মতো নদী পার হতে না পারায় অনেকে পথেই মারা যান। এ ছাড়া প্রসূতি রোগী নিয়েও চরম বিপাকে পড়তে হয়। শুধু তাই নয়, এ নদী দিয়ে বালুবাহী কার্গো জাহাজ চলাচল করায় অনেকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। গত বছর এ খেয়া ঘাটে খেয়া নৌকা ডুবির ঘটনায় শওকত হোসেন নামে এক ব্যবসায়ী মারা যান। ট্রলারের ধাক্কায় যাত্রীবাহী একটি খেয়া নৌকা ডুবে যায়। এ ঘটনায় কাউন্দিয়া ইউনিয়নের আবদুল হালিমের ছেলে ব্যবসায়ী শওকত হোসেন নিখোঁজ হন। ২৯ ঘণ্টা পর তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

স্থানীয় কাউন্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান খান শান্ত জানান, একটি সেতুর অভাবে খেয়া নৌকা ডুবিতে গত এক যুগে প্রায় অর্ধশত ব্যক্তির অকাল মৃত্যু হয়। আর গত বছর অন্তত সাতটি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটল দিয়াবাড়ি খেয়াঘাট এলাকায়। এ বছর এ সকল ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছয়জন মারা গেছেন।

রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানেও রয়েছে নৌকার ঘাট। গুলশান ঝিল দিয়ে কম সময়ে কড়াইল বস্তিতে যেতে সবাই এ পথ ব্যবহার করে থাকেন। এখানে মোট ঘাট রয়েছে চারটি। নৌকাও অসংখ্য। প্রায় ২৫০টি নৌকা রয়েছে এ ঝিলে। তবে এককভাবে এ ঘাটগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন সর্দার ইসমাঈল মৃধা নামে এক ব্যক্তি। সর্দার নামেই তিনি বেশি পরিচিত। মাঝিরা দৈনিক ১০০ টাকা ভাড়ার বিনিময়ে এখানে নৌকা চালান। একেক জনের দৈনিক আয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।

স্থানীয়রা জানান, সময় বাঁচাতে অফিসগামী লোকেরা নৌকায় যাতায়াত করে থাকেন। গুলশান থেকে বীরোত্তম এ কে খোন্দকার সড়ক দিয়ে কড়াইলে যেতে অতিক্রম করতে হয় প্রায় ৩ কিলোমিটার। সময় ব্যয় হয় আধা ঘণ্টার মতো। যানজটে পড়লে লাগে প্রায় দ্বিগুণ সময়। অথচ গুলশান ঝিল দিয়ে কড়াইলে যেতে সময় লাগে মাত্র ১০ মিনিট।

সাভারের আশুলিয়ার রুস্তমপুর খেয়া ঘাট। অপর প্রান্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের তুরাগ ধৌড় এলাকা। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্রিজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলেও দুটি প্রভাবশালী হাউজিং কোম্পানির বাধার কারণে দীর্ঘদিনেও এখানে ব্রিজ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। ব্রিজ হলে জমির দাম বেড়ে যাবে। তাই ওই হাউজিং কোম্পানির জমি কেনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ব্রিজ নির্মাণ হবে না।

তবে এ ব্যাপারে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানিয়েছেন, কাউন্দিয়া ও রুস্তমপুরে ব্রিজ নির্মাণের চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ব্রিজের ডিজাইন, বাজেট নিয়ে কাজ করছে। আশা করছি, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ করতে পারব।

রাজধানীর উত্তরার কামারপাড়া পরান মণ্ডলের টেক খেয়াঘাট। অপরপ্রান্ত গাজীপুরের দেউড়া, চেরাগ আলী। এ ঘাট নিয়ন্ত্রণ করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর যুবরাজ। তার সহযোগী সাইফুল ইসলাম নান্নুর লোকজন ঘাট এলাকায় যাত্রীদের কাছ থেকে খেয়া পারাপারের টাকা আদায় করেন। এখানে প্রায় অর্ধ শতাধিক ডিঙ্গি নৌকা খেয়া পারাপারে নিয়োজিত। নান্নুকে আয়ের ভাগ দিয়েই নৌকা চালাতে হয় মাঝিদের।

মন্তব্য

Beta version