জিডি অভিযোগেই সীমাবদ্ধ থানা-পুলিশ!

* থানায় ঘটছে হারানোর ঘটনা * তদন্ত হয় না বেশিরভাগ জিডির * ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে অপরাধীরা

ইদ্রিস আলম
জিডি অভিযোগেই সীমাবদ্ধ থানা-পুলিশ!
প্রতীকী ছবি

রাজধানী তুরাগের বাউনিয়া পুকুর পাড় এলাকার মাদার্স প্রিন্টার্স ফ্যাক্টরির সামনে থেকে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি মধ্য রাতের কোনো এক সময় প্রায় ৫ লাখ টাকা মূল্যের ৫ হাজার ৫শ পিচ গেঞ্জির কাপড়সহ কোম্পানির একটি কাভার্ডভ্যান চুরি হয়। এ ঘটনায় ফ্যাক্টরির স্বত্বাধিকারী মো. তাইজুল ইসলাম খান তুরাগ থানায় যান মামলা করতে। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন তিনি। পরে তার ছেলে ফাইম উল ইসলাম খান বাদী হয়ে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। সর্বমোট ১৫ লাখ টাকার মালামাল হারিয়ে থানা পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি।

তুরাগের বাউনিয়া বটতলা এলাকায় বিধবা বৃদ্ধা সানোয়ারা বেগমের গোয়ালঘর থেকে গত বছরের ২০ নভেম্বর রাতে চুরি হয় প্রায় ৪ লাখ টাকা মূল্যের ৫টি গরু। এই চুরির ঘটনাটি ব্যাপক সাড়া ফেলে এলাকা জুড়ে। এ ঘটনায় থানায় মামলা করতে গেলে থানা পুলিশ মামলা না নিয়ে একটি অভিযোগ রেখে দেয়। এরপর ওই ঘটনার ৪ মাস পেরিয়ে গেলেও চোর ধরতে পারেনি পুলিশ।

আরেক ভুক্তভোগী মোটরসাইকেল হারানো মিজানুর রহমান। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে বাউনিয়ার ভাড়া বাসার গ্যারেজ থেকে টিভিএস স্টাইকার ১২৫ সিসির মোটরসাইকেল চুরি হয়। বাসার গেইটের তালা ভেঙে নিয়ে যায় এই মোটরসাইকেল। এ ঘটনায়ও মামলা নেয়নি পুলিশ। আর এই মোটরসাইকেল আর উদ্ধার হয়নি।

শুধুই তাইজুল ইসলাম বা সানোয়ারা বেগম বা মিজানুরি রহমান নন, এরকম ভুক্তভোগীর সংখ্যা অনেক। লোহার তৈরি গেট কেটে, তালা ভেঙে বহুতল ভবনের নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে ঘটছে এমন ঘটনা। এরকম অসংখ্য চুরির ঘটনা ঘটলেও থানা পুলিশ মামলা নিচ্ছে না। ভোরের আকাশের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বেশির ভাগ ঘটনা সীমাবদ্ধ রয়েছে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও অভিযোগে। একটিরও হয়নি মামলা। জিডি ও অভিযোগ তদন্তে রয়েছে ধীরগতি। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ থানা পুলিশের দ্বারস্থ হয়েও মিলছে না সেবা।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ চুরি-ডাকাতির মতো ঘটনায় থানায় গেলেই এগুলো হয়ে যায় নিছক সাধারণ ঘটনা! মামলা না নিয়ে নেয়া হয় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) কিংবা অভিযোগ। এটি এন্ট্রি করতেও পোহাতে হয় নানা ভোগান্তি। তদন্তে নেই কোনো গতি। ভুক্তভোগীরা দ্বায়িত্বরত অফিসারকে চুরির খোঁজখবর নিতে ফোন দিলে হন বিরক্ত।

ভুক্তভোগী ও স্থানীয়দের তথ্য মতে, গত দুই মাসে তুরাগ থানাধীন বাউনিয়া এলাকা থেকে নামীদামি ব্যান্ডের ১২টি মোটরসাইকেল ও গার্মেন্টেসের মালামালসহ কাভার্ডভ্যান চুরির ঘটনা ঘটে। এছাড়াও তিনটি বাড়িতে দিনে দুপুরে চুরি সম্পাদন হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাওকে শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

প্রতিদিনই রাজধানীজুড়ে ঘটছে এমন ছোট বড় ঘটনা। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলেই তবে নজরে আসেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের। বাকি ঘটনা নীরবেই চাপা পড়ে যায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) কিংবা অভিযোগের সীমাবদ্ধতায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ‘এসব ঘটনা কীভাবে হারানোর ঘটনা হিসাবে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) বা অভিযোগ হয়? এগুলো ঘটনা চুরি বললেও তো ভুল হবে। সরাসরি ডাকাতির ঘটনা হিসেবে চলে যায়। মানুষের সামনে থেকে কোনো কিছু লুকিয়ে নিয়ে গেলে সেটি হয় চুরি।’

ভুক্তভোগী মো. তাইজুল ইসলাম খান বলেন, ‘কাপড়ে প্রিন্ট করার ফ্যাক্টরি আমার। এ কারণে গেঞ্জিতে প্রিন্ট করার জন্য আমার ফ্যাক্টরিতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু আমার ফ্যাক্টরির সামনে থেকে মালামালসহ কাভার্ডভ্যানটি চুরি হয়ে গেল। আর তুরাগ থানা পুলিশ মামলা নিল না। অনেক ঘোরাঘুরি পর অভিযোগ নেয়। তাতেও নেই কোনো অগ্রগতি। অথচ এখন গেঞ্জির মালিকরা আমাকে চাপ দিচ্ছেন, গেঞ্জির টাকার জন্য। ’

বিধবা বৃদ্ধা সানোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমাদের মতো গরিবের কেউ নেই। তাই তো আমার এতো বড় ক্ষতি হওয়ার পরেও থানা পুলিশ মামলা নেন নি। কেউ আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি।’ তার ছেলে সেলিম হোসেন বলেন, ‘তুরাগ থানায় কয়েক বার গিয়েও মামলা করতে পারিনি। পরে তুরাগ থানাধীন ডিয়াবাড়ির ফাঁড়ি পুলিশের আশ্বাসে চুপ থাকেন বৃদ্ধার পরিবার। কিন্তু আজও মেলেনি হদিস।’

মিজানুর রহমান বলেন, ‘তুরাগ থানায় মামলা করতে গেলে নানা অজুহাত দেখান। পরে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু ১৫ দিন পার হলেও তদন্তের কোনো খবর নেই। আমরা মনে হয় থানা পুলিশের কাছে অসহায়।’

উত্তরা জোনের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ মোরশেদ আলম ভোরের আকাশকে বলেন, ‘এমন ঘটনা জানা নেই। আপনি ভুক্তভোগীদের নাম ঠিকানা ও ফোন নম্বর দেন। আর না হয় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। বাকিটা আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার এলাকায় এ ধরনের কোনো ঘটনাকে আশ্রয় দেওয়া হবে না। মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য আমাদের দ্বায়িত্ব দিয়েছেন সরকার।’

সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় বাস ডাকাতির ঘটনায় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, যে কোনো ঘটনার মামলা থানাকে অবশ্যই নিতে হবে। না হলে ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যাবে। এ বিষয়ে তুরাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মেহেদী হাসানের অফিশিয়াল ফোন নম্বরে কয়েক বার ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

মন্তব্য