-->
শিরোনাম
চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই

ভয়ংকর রাতের ঢাকা

* ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা * ঘটনাগুলোর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে: বিশেষজ্ঞ

এমদাদুল হক খান
ভয়ংকর রাতের ঢাকা
প্রতীকী ছবি

ভয়ংকর হয়ে উঠেছে রাতের ঢাকা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেপরোয়া ডাকাত, ছিনতাইকারী, টানা পার্টি ও চোর চক্রের সদস্যরা। রাতভর ছিনতাই-ডাকাতি-চুরিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড করে ভোর হলে আড়ালে চলে যায় তারা। এসব দুর্বৃত্তের কবলে পড়ে মূল্যবান সামগ্রী হারানোর পাশাপাশি অনেকের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। এসব অপরাধীর সঙ্গে পেরে উঠছেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ফলে নগরবাসীকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ তাদের।

পুলিশ বলছে, সম্প্রতি চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব ঘটনায় জড়িতদের ধরতে টহল টিম বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে অপরাধ চক্রের সদস্যরা। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে ফের একই অপকর্মে লিপ্ত হয় অপরাধীরা। জানা গেছে, সম্প্রতি মতিঝিলের কমলাপুর এলাকায় ছিনতাইকারীর হ্যাঁচকা টানে রিকশা থেকে পড়ে সুনিতা রানী দাস (৫০) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়। নিহত নারী ছিলেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী।

সুনিতা রানীর ছেলে রাজু দাস জানান, তার মা বৌদ্ধমন্দিরে দুই বছর ধরে পরিচ্ছন্নতার কাজ করতেন। গোপীবাগ ঋষিপাড়ার বাসা থেকে বুধবার ভোরে আমার খালাতো ভাই সুজিতকে নিয়ে রিকশা করে বৌদ্ধমন্দির যাচ্ছিলেন। কমলাপুর বিআরটিসি বাস ডিপো এলাকায় পৌঁছালে একটি প্রাইভেট কার থেকে এক ছিনতাইকারী তার মায়ের ভ্যানিটি ব্যাগ ধরে টান দেয়। এতে রিকশা থেকে ছিটকে পড়ে মাথা ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত পান তিনি। সুনিতার সঙ্গে থাকা তার ভাগনে সুজিত দাস বলেন, ‘মাসিকে প্রথমে মুগদা হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসি। মাসির জ্ঞান ছিল না। ২০৪নং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাসি দুপুর ১২টায় মারা যান।

এদিকে রাজধানীর মুগদা স্টেডিয়াম ইউনিক বাস কাউন্টারের সামনে ছিনতাইকারীরা চলন্ত রিকশা থেকে ব্যাগ ধরে টান দিলে লিপি আক্তার নামে এক নারী পড়ে যান। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। অন্যদিকে ধানমন্ডিতে গাড়ির ভেতর থেকে ছিনতাইকারীরা এক নারীর ব্যাগ ধরে টান দেয়। ব্যাগ টানতে টানতে ২০০ গজ রাস্তা পার করে। একপর্যায়ে তার ওপর দিয়েই গাড়ি চালিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই হেলেনা নামে ওই নারীর মৃত্যু হয়।

হেলেনা বেগম ভোর সাড়ে ৪টায় তার স্বামীর সঙ্গে বরিশাল থেকে সদরঘাটে আসেন। সেখান থেকে বাসে করে ধানমন্ডি ৬ নম্বরে নামেন। ভোর সোয়া ৫টায় তারা বাসায় যাওয়ার জন্য মিরপুর রোড পার হতে গেলে গাড়িতে করে আসা ছিনতাইকারীরা ব্যাগ ধরে টান দেয়। গাড়ির সামনের জানালায় কোনোভাবে তার হাত আটকে যায়। সেভাবেই তাকে কিছুদূর টেনে নিয়ে যাওয়ার পর গাড়িটি তার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। এছাড়া যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জে চলন্ত রিকশায় ছিনতাইয়ের সময় মায়ের কোল থেকে পড়ে ৫ মাসের এক শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এর আগে ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজেসের ডাক্তার ফরহাদ আলমও মোটরসাইকেলে আসা ছিনতাইকারীদের টানে রিকশা থেকে পড়ে নিহত হন। আর ছিনতাইকারীদের বাধা দিতে গিয়ে টিকাটুলিতে ছুরিকাঘাতে নিহত হন বেসরকারি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু তালহা।

এদিকে রাজধানীর ডেমরা এলাকায় এক পুলিশ কর্মকর্তার বাড়িতে ঘটে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা। এ সময় ডাকাতরা পুলিশ কর্মকর্তাসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের হাত ও পা বেঁধে ডাকাতি করে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে বালুরমাঠের ছোট পাইটি এলাকায় যাত্রাবাড়ী থানার এসআই আজিজুল হক সুমনের একতলা বাড়িতে মুখোশ পরিহিত ডাকাত দল সশস্ত্র হামলা চালায়। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, প্রথমে ডাকাত দল বাড়ির কেচি গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। এরপর বাড়ির কাঠের দরজা শাবল দিয়ে আঘাত করে ভেঙে চুরমার করে। এ সময় পুলিশ কর্মকর্তা ও তার স্ত্রী এবং তাদের আত্মীয় আরেকজন পুলিশ কনস্টেবল চিৎকার করলেও আশপাশের কোনো ব্যক্তি এগিয়ে আসেনি। প্রায় ৪০ মিনিট ধরে ডাকাত দল বাসার ভেতরে অবস্থান করে পরিবারের সবার হাত-পা বেঁধে ফেলে। ডাকাতরা প্রায় আট ভরি স্বর্ণালঙ্কার, একটি ঘড়ি এবং ৫০ হাজার টাকা লুট করে নিয়ে যায়।

এদিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি বাসায় ডাকাতি প্রস্তুতির সময় ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। স্থানীয়রা জানান, রাত ৩টার দিকে কয়েকজন সশস্ত্র ডাকাত ইকবাল রোডের ৯/২১ নম্বর বাসায় ডাকাতির চেষ্টা করে। এ সময় ডাকাতরা নিরাপত্তাকর্মী মাসুদ আলমকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। ওই নিরাপত্তাকর্মীর চিৎকারে আশপাশের মানুষ জড়ো হয়ে ডাকাতদের ধাওয়া করে। পরে পুলিশ এসে ৩ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করে। অন্যদিকে শেরেবাংলা নগর এলাকায় ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগ। গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের অস্ত্র উদ্ধার ও মাদক নিয়ন্ত্রণ টিমের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. ফজলুর রহমান জানান, ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শেরেবাংলা নগর থানার পিডব্লিউডি গোডাউন সংলগ্ন পশ্চিম কাফরুল এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।’

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেপ্তাররা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে গণপরিবহণে, মার্কেট এলাকায় ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জনসমাগম স্থলে ডাকাতি করত। তাদের আয়ের কোনো বৈধ উৎস না থাকলেও ঢাকা শহরে বিলাসী জীবনযাপন করে তারা। ডিএমপির তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ঢাকা মহানগরীতে মামলা হয় ১৪৫টি, ২০২০ সালে ১৭৬, ২০১৯ সালে ১৫৫, ২০১৮ সালে ২১৬, ২০১৭ সালে ১০৩, ২০১৬ সালে ১৩২, ২০১৫ সালে ২০৫ এবং ২০১৪ সালে ২৬৫টি মামলা হয়। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে মামলা হয়েছে ১৩টি। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে রাজধানীতে ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে ১০টি। তবে এসব ঘটনায় শুধু থানার মামলার হিসাব এগুলো। বাস্তবে ছিনতাইয়ের ঘটনা আরো বেশি। একসময় সড়কে মানুষজনকে ঠেক দিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও গত কয়েক বছরে ছিনতাইয়ের ধরন পাল্টেছে। এখন মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস নিয়ে ছিনতাই করা হয়। এসব ছিনতাইকারীরা ভ্রাম্যমাণ।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, বর্তমানে ছিনতাইকারীরা ‘ভ্রাম্যমাণ’ হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তারা মোটরসাইকেল, সিএনজি, প্রাইভেট কার বা মাইক্রোবাস নিয়ে বের হয়। কখনো যাত্রী হিসেবে গাড়িতে তুলে সবকিছু কেড়ে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। আবার যাত্রীরা কিছু দিতে না চাইলে কখনো কখনো তাদের শ্বাসরোধে হত্যা করে নির্জন সড়কের পাশে ফেলে রেখে যায় ছিনতাইকারীরা।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, আমরা দুই স্তরবিশিষ্ট সুপারভাইজিং কমিটি গঠন করে দিয়েছি। রাতের বেলা যে টিমগুলো কাজ করছে, তারা সবসময়ই সক্রিয় থাকে। ছিনতাইকারীরা নানাভাবে ছিনতাই করে থাকে। তবে ছিনতাইয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় মোটরসাইকেল। তাদের টার্গেট থাকে রিকশার যাত্রী বা পথচারী। এরপর রয়েছে প্রাইভেট কার ব্যবহার করে ছিনতাইয়ের ঘটনা। সাধারণত চলন্ত অবস্থায় হ্যাঁচকা টানে মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হয় ভুক্তভোগীর। পায়ে হেঁটে যারা ছিনতাই করে তাদের একটি বড় অংশের টার্গেট থাকে বাসের জানালা দিয়ে মোবাইল ফোন বা মূল্যবান অন্যকিছু ছিনিয়ে নেওয়ার। আর বেশি ছিনতাই হয় মধ্যরাতের আগে ও ভোরে।’

এ বিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যমের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘ছিনতাইকারীরা মোটরসাইকেলের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে রিকশার যাত্রীদের কাছ থেকে ছিনতাই করে থাকে। অনেক সিএনজিচালক বিভিন্ন ছদ্মবেশে সিএনজি চালানোর নামে এসব অপকর্ম করে থাকে।’ ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার আ স ম মাহাতাব উদ্দিন বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা পুলিশকে জানান না। কী কারণে এসব ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে, তা প্রায় পুলিশের অজানা। তবে এসব রোধে আমরা কাজ করছি।’

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার বলেন, ‘ছিনতাই প্রতিরোধে গোয়েন্দা পুলিশের প্রায় ৭০টির মতো টিম পুরো ঢাকা শহরে দায়িত্ব পালন করছে। এর মধ্যেও দুয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। তবে বেশিরভাগ মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুয়েকটি ঘটনায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমরা শিগগিরই তাদেরও গ্রেপ্তার করতে পারব।’ পুলিশের দাবি, ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়লেও তা এখনো ভয়ংকর হয়ে ওঠেনি। তবে সম্প্রতি ছিনতাইয়ের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। বেশির ভাগ ঘটনায় আসামিরা গ্রেপ্তার হয়েছে। বাকি দুয়েকটি ঘটনায় তদন্তের কাজ অব্যাহত রয়েছে।

ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ছিনতাইপ্রবণ এলাকা ঘিরে নেওয়া হয়েছে কয়েক স্তরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা। ডিএমপিতে মামলার রেকর্ড পর্যালোচনা করে যারা ছিনতাইয়ের কাজে আগেও গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের আবার গ্রেপ্তার করতে অভিযান চালানো হচ্ছে। এছাড়া আমাদের টহল ডিউটি যেগুলো ছিল, তা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। তদারকি এবং চেকপোস্ট বাড়ানো হয়েছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, ‘রাজধানীসহ ঢাকার আশপাশে হঠাৎ করে ছিনতাই বেড়ে যাওয়ায় মানুষ অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। এসব ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রাণহানিও ঘটছে এবং মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘ঘটনাগুলোর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। সেসব বিষয় চিহ্নিত করে কাজ করতে হবে। এ বেপরোয়া ছিনতাইকারী চক্রের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলমান রাখলে হয়তো এসব অপরাধ কমে আসবে। তবে সাধারণ মানুষকে এসব বিষয়ে অতিরিক্ত সচেতন হতে হবে বলে জানান এ অপরাধ বিশেষজ্ঞ।’

মন্তব্য

Beta version