অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র

হ্যালো আমি বিকাশ থেকে বলছি ...

রুদ্র মিজান
হ্যালো আমি বিকাশ থেকে বলছি ...
প্রতীকী ছবি

ঘটনাটি ঘটে দ্রুত। অপরপ্রান্ত থেকে কল আসে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রের ফোনে। ‘হ্যালো, আমি বিকাশ থেকে...বলছি, স্যার আপনার ফোন নম্বর ০১... এতে ৪০ হাজার টাকা ক্যাশ ইন করা হয়েছে। কিন্তু আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে আপনার বিকাশ অ্যাপসটি কাজ করবে না। এজন্য আমরা দুঃখিত। আমরা দ্রুত এটি ঠিক করে দিচ্ছি। আপনি আমাদের হেল্প করেন।’

এভাবে কথা বলতে বলতেই একটি এসএমএসের মাধ্যমে একটি ওটিপি কোড পাঠানো হয় ওই ছাত্রের ফোন নম্বরে। তারপর কোডটি জানতে চাওয়া হয়। কোডটি বলে দেন ওই ছাত্র। তারপর বিশ্বাসযোগ্য বিভিন্ন তথ্যসংবলতি প্রশ্ন করা হয়। কথা বলার একপর্যায়ে স্টার টু ফোর সেভেন হ্যাশ চাপতে বলা হয়। নির্দেশনা অনুসারে চাপতে থাকেন ওই ছাত্র।

এর মধ্যেই অ্যাকাউন্ট শূন্য। আবার ফোন। ‘সরি স্যার, ভুল হয়েছে। যে কারণে টাকাগুলো আমাদের অন্য একটি নম্বরে ট্রান্সপার হয়েছে। এই টাকা ফেরত পেতে হলে আপনাকে এক্ষুণি ক্যাশ ইন করতে হবে...। দ্রুত সময়ের মধ্যে।’ এভাবে কৌশলে একাধিকবার এসএমএসের মাধ্যমে সর্বমোট ১ লাখ ১১ হাজার টাকা নেওয়া হয়। কিন্তু টাকা আর ফেরত পাননি ওই ছাত্র।

ভুক্তভোগী একটি বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র। গত ১ জানুয়ারি সকালে তিনি তার বাবার কাছ থেকে সেমিস্টার ফি দেওয়ার জন্য ৪০ হাজার টাকা নিয়ে স্থানীয় বিকাশ এজেন্টের কাছ থেকে নিজের মোবাইলে ক্যাশইন করেন। এর কিছুক্ষণ পরই বিকাশ কর্মকর্তা সেজে প্রতারকরা ওই শিক্ষার্থীকে কল করে। প্রতারণার মাধ্যমে তার অ্যাকাউন্টে থাকা ৪০ হাজার টাকা ও পরে আ্যকাউন্টটি সচল করার জন্য কৌশলে আরো ৭১ হাজার টাকাসহ মোট ১ লাখ এগারো হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই শিক্ষার্থী সেমিস্টার ফি দিতে ব্যর্থ হয় এবং বাধ্য হয়ে এক সেমিস্টার ড্রপ দিতে হয়। বিষয়টি জানতে পেরে তদন্ত শুরু করেন কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ডিপার্টমেন্টের সিটি সাইবার ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের সদস্যরা।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হ্যালো পার্টির চক্রের সদস্যরা টার্গেটকৃত ব্যক্তির ফোন নম্বর সংগ্রহ করে বিভিন্ন এজেন্ট থেকে। সাধারণত দোকানে গ্রাহক সেজে বা নানা কৌশলে অবস্থান নিয়ে ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে খাতায় লেখা গ্রাহকদের নম্বর ধারণ করে নেয়। পরবর্তীতে এসব নম্বরে ফোন দিয়ে ক্যাশ ইনের তথ্য জানিয়ে প্রতারণার প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করে। তারা কথা বলে শুদ্ধ বাংলায়। অনেক ক্ষেত্রে ইংরেজি-বাংলার সংমিশ্রণে। কথা শুনে বোঝার উপায় নেই যে কলটি বিকাশ থেকে আসেনি।

এক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিকাশ কাস্টমার কেয়ারের মতো ফোন নম্বর ব্যবহার করে এই চক্র। এ রকম একটি চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে সিটিটিসির সিটি সাইবার ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট। চক্রটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের ১ লাখ ১১ হাজার টাকা লুটে নিয়ে গেলে তিনি এ বিষয়ে হাজারীবাগ থানার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত ২০ জানুয়ারি মামলা দায়ের করেন। তদন্ত করতে গিয়ে একটি বিকাশ এজেন্টকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যে দোকানে ক্যাশ ইন করেন ভুক্তভোগী ছাত্র। সংগ্রহ করা হয় সিসি টিভির ফুটেজ। ওই ফুটেজ থেকে পাওয়া যায় একটি পালসার মোটরসাইকেলের নম্বর।

পরে মোটরসাইকেলের প্রকৃত মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তদন্তকারীরা। মোটরসাইকেলের মালিক জানান, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে উত্তরা থেকে মোটরসাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। সেই চোরাই মোটরসাইকেল দিয়েই একদল প্রতারক প্রতারণার টাকা বিভিন্ন বুথ ও দোকান থেকে ক্যাশআউট করত। মোটরসাইকেলটি ২০২০ সালে ট্রাফিক কেসে অভিযুক্ত হয়।

ওই কেসের স্লিপ থেকে প্রাপ্ত মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে গত ৮ মার্চ ঢাকা থেকে মো. তারেকুল ইসলাম নামে একজনকে আটক করে সাইবার ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের সদস্যরা। তারেকুলের কাজ হলো মূল প্রতারকদের টাকা ক্যাশআউট করে দেওয়া। তার তথ্যের ভিত্তিতে তাকে নিয়ে ৯ মার্চ মাগুরার শ্রীপুর থানার মহেষপুরে অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে বাপ্পী শেখ ও রাসেল আহম্মেদকে আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে পাঁচটি মোবাইল, ছয়টি মোবাইল সিম এবং প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি জব্দ করা হয়।

সূত্রমতে, হ্যালো পার্টি, ওয়েলকাম পার্টি নামে এরকম ভিন্ন ভিন্ন চক্র রয়েছে। তার আগে ওয়েলকাম পার্টি নামে এক চক্রের সদস্য রিজাউল মাতুব্বরকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। প্রায় ১৩ বছর ধরে এই প্রতারণা করে আসছিল সে ও তার সহযোগীরা। এক্ষেত্রে বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে এই চক্র। তারা মোবাইলের মাধ্যমে বিভিন্ন কোম্পানিসহ বিকাশ কোম্পানি থেকে লটারিতে গাড়ি, বাড়ি, অর্থ পুরস্কার পেয়েছেন বলে প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করে। তাদের ফাঁদে যারা পা দিত তাদের কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে হাতিয়ে নিত অর্থ।

সাইবার ইনভেস্টিগেশন বিভাগের ইন্টারনেট রেফারেল টিমের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) ধ্রুব জ্যোতির্ময় গোপ জানান, জড়িতদের গ্রেপ্তারের পর দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে। সেইসঙ্গে প্রতারণার কৌশল সম্পর্কেও তথ্য দিয়েছে বলে জানান তিনি।

মন্তব্য