আফরোজা সুলতানা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিকঠাক। চলছে কেনাকাটা। স্বর্ণালঙ্কার থেকে শুরু করে প্রায় সব বাজার চলছে ধুমধাম করে। কিন্তু তখনো আফরোজা জানত না তার জীবনে নেমে আসছে কালো মেঘের ছায়া। নিমিষেই নিভে যাবে জীবনের অধ্যায়!
হৃদয় ব্যাপারী। আফরোজা সুলতানার ৬ বছরের বিশ্বস্ত গাড়িচালক। এই হৃদয়ের হৃদয়হীন কাণ্ডে হতবাক তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ সবাই। কিন্তু হৃদয়ের পূর্বের পেশা ছিল কসাই। সে জন্য সহজেই এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটাতে সক্ষম হয়।
বলছি, গত ১৩ মার্চ। ঘড়ির কাটায় রাত ১০টা। রাজধানী বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় এক নারীর গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। হত্যার রহস্য জানতে জড়িতদের আটকের চেষ্টায় মাঠে নামে গোয়েন্দা পুলিশ। গাড়িচালক হৃদয় ব্যাপারীকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর বেরিয়ে আসে লোমহর্ষক তথ্য।
গুলশান গোয়েন্দা বিভাগের এডিসি কামরুজ্জামান ভোরের আকাশকে বলেন, ৬ বছর ধরে আফরোজার গাড়ি চালাতেন হৃদয়। খুব বিশ্বস্ত ছিলেন। সেই সুবাদে মাঝে মাঝে টাকা ঋণ নিতেন, ঠিক মতো ফেরত দিতেন না। চাইলে ম্যাডাম বলত, আগের টাকা ফেরত দাও। এগুলো সে পুষে রাখেন ক্ষোভ হিসেবে।
হত্যাকণ্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এর আগে হৃদয় কসাই ছিলেন। তাই সে খুব সহজেই গলাকেটে হত্যা করতে পেরেছে। যা তার কিছু মনে হয়নি। সে মূলত অনলাইন জুয়ায় আসক্ত ছিলেন। বেতনের বেশির ভাগ টাকা জুয়ায় চলে যেত। বড় লোক হওয়ার স্বপ্ন থেকেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
হৃদয়ের দেওয়া তথ্য থেকে তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত গাড়িচালক হৃদয় ব্যাপারীকে নিয়েই বিয়ের বাজার, স্বর্ণালঙ্কার কেনাকাটা করেন আফরোজা। হৃদয় ব্যাপারীর ধারণা, ম্যাডামের (আফরোজা) অনেক টাকা পয়সা আছে। অনেকদিন যাবত হৃদয় ব্যাপারী ভাবছে কীভাবে টাকা-পয়সার মালিক হওয়া যায়। কারণ অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হৃদয়ের প্রাপ্ত বেতনের বেশিরভাগই জুয়ায় চলে যায়। তিন মাসের বাসা ভাড়া বাকি, এদিকে জমজ দুই সন্তানসহ তিন সন্তান প্রয়োজনীয় খাদ্যাভাবে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। সবমিলিয়ে টাকার জন্য দিশেহারা হৃদয়ের মাথায় হঠাৎ নতুন নেশা খেলে গেল।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা ঘটনাস্থল ঘিরে বিজ্ঞানভিত্তিক আর তথ্যপ্রযুক্তিগত তদন্তে ব্যস্ত। হলুদ মার্কিং এ ঘেরা ক্রাইমসিন। এ সময় গুলশান গোয়েন্দা বিভাগের এসআই রিপন উদ্দিন হঠাৎ দুরূহ কোণ থেকে একটা সিসিটিভি ক্যামেরায় লক্ষ্য করল, ঘটনাস্থল ঘরের জানালা দিয়ে পরপর কয়েকটা কাগজ জাতীয় কিছু একটা পড়ছে।
বিষয়টা এডিসি কামরুজ্জামান এবং এডিসি মাহবুবুল হক সজীবকে শেয়ার করে এসআই রিপন নিচে গিয়ে দেখলেন, রক্তমাখা কিছু টিস্যু। সামনের সিসিটিভির সঙ্গে টাইমিং মিলিয়ে দেখা গেল ওই সময়েরই কিছুক্ষণ পরে ঘটনাস্থল বাসা থেকে কেউ একজন বের হয়ে যাচ্ছে। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গেল। কিন্তু বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়া ব্যক্তি তো দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত গাড়িচালক হৃদয় ব্যাপারী। প্রতিদিনের ন্যায় ম্যাডামকে সেদিনও গাড়ি থেকে নামিয়ে সে বাসায় পৌঁছে দেয়। ওই দিন ম্যাডাম তাকে চা খাওয়ানোর জন্য কিছুক্ষণ বাসায় বসিয়েছিল।
গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ম্যাডামের মৃত্যুতে সহমর্মিতার অভিনয় করে হৃদয়। নানান ফন্দি-ফিকির আর মিথ্যের ফুলঝুরি। এক পর্যায়ে নিহতের স্বামীকে হত্যাকাণ্ডে জড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা। বিভিন্ন নাটক সাজিয়ে নিজেকে বাঁচানোর কারসাজি, সবই ব্যর্থ হল। অবশেষে চৌকস গোয়েন্দাদের দক্ষতা এবং পেশাদারিত্বের কাছে হার মানল খুনি। জেরার মুখে পড়ে সবকিছু স্বীকার করে বিশ্বাসঘাতক হৃদয় বেপারী।
কোরবানির গরু কাটায় দক্ষ হৃদয় বেপারী কদিন যাবত ছুরিটা নিয়ে ঘুরছে। অনেক টাকার নেশা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে হৃদয়ের মাথায়। সন্তানদের মুখে হাসি ফুটাতে হবে, বড় লোক হতে হবে, আরো কত কি! কিভাবে দ্রুত বড় লোক হওয়া যায়, সে পরিকল্পনা তো করাই আছে, এখন বাস্তবায়নের অপেক্ষা।
যেভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটায় হৃদয়
গত ১৩ মার্চ সন্ধ্যার আগে অফিস থেকে ফিরে বাসার নিচে ম্যাডামকে নামিয়ে টিফিন বাটি আর ব্যাগ পৌঁছে দেওয়ার জন্য পিছে পিছে বাসায় ঢুকল হৃদয় বেপারী। দীর্ঘদিনের পরিচিত হৃদয় বেপারী যে এতটা হৃদয়হীন হবে তা কল্পনাও করেনি আফরোজা সুলতানা। ম্যাডামের কাছে গরম পানি চেয়ে কালক্ষেপণ করে সুযোগ খুঁজতে থাকে হৃদয়।
বিশ্বস্ত হৃদয়কে গরম পানি দিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে কাপড় চোপড় ধুতে থাকেন ম্যাডাম। এক পা দু-পা করে এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে চরম নিষ্ঠুরতায় ম্যাডামের গলায় ছুরি চালিয়ে দেয় বিশ্বাসঘাতক হৃদয় ব্যাপারী! মুহূর্তে লুটিয়ে পড়েন রক্তাক্ত আফরোজা সুলতানা। দীর্ঘদিনের পরিচিত মানুষটি এমন করতে পারে ভাবার আগেই গোঙাতে গোঙাতে মারা যান তিনি। এরপর ঘাতক হৃদয় ঠান্ডা মাথায় ঘরের স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা নিয়ে ভদ্রবেশে নেমে যায়।
ঘটনা তদন্তের অভিজ্ঞতা থেকে পুলিশ জানায়, হৃদয় ব্যাপারী শিখিয়ে গেল, বিশ্বাসঘাতক আসলে অন্য কেউ নয়- বিশ্বাসঘাতক আমাদের নিজেদেরই লোক, যারা আমাদের মধ্যেই চারপাশে ঘাপটি মেরে আছে। সময় আর সুযোগ মতোই ছোবল দিবে হয়ত।
গুলশান গোয়েন্দা বিভাগের ডিসি মশিউর রহমানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এডিসি কামরুজ্জামান, মাহবুবুল হক সজীব এবং সাব-ইন্সপেক্টর রিপন উদ্দিনের বিচক্ষণতায় খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে উদঘাটন হল আফরোজা পারভীন হত্যার রহস্য। হৃদয় ব্যাপারী থেকে উদ্ধার হলো স্বর্ণালঙ্কার, টাকা এবং হত্যার কাজে ব্যবহৃত ছুরি। প্রকাশ পেল গুরুত্বপূর্ণ একটি হত্যা মামলার জটিল রহস্য।
মন্তব্য