-->
শিরোনাম
টিপু হত্যাকাণ্ড

৫ দিন আগে ভাড়া করা হয় খুনি

এমদাদুল হক খান
৫ দিন আগে ভাড়া করা হয় খুনি
মাসুম ওরফে আকাশ

রাজধানীর শাহজানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু ও কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান জামান প্রীতিকে গুলি করে হত্যা করে কন্ট্রাক্ট কিলার মো. মাসুম ওরফে আকাশ। হত্যাকাণ্ডের ৫ দিন তাকে কন্ট্রাক্ট করা হয়। তিন দিন আগে টার্গেট টিপুর নাম জানিয়ে দেয় পরিকল্পনাকারী। কিলিং মিশনের একদিন আগে তার কাছে অস্ত্র ও মোটরসাইকেল সরবরাহ করা হয়। প্রথম দিন চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় কিলিং মিশন। তবে দ্বিতীয় দিন সফল হয়। হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়া কিলার আকাশকে কোনো টাকা-পয়সা না দিলেও পূর্বের মামলা থেকে রেহাই পাইয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।

হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবেশী দেশে পালানোর চেষ্টা করেছিল কিলার আকাশ। তবে তার আগেই বগুড়া পুলিশের সহায়তায় তাকে শনিবার রাতে বগুড়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে গতকাল রোববার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ এম হাফিজ আক্তার জানিয়েছেন। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারীরা গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন। তাদেরকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলছে।

ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, এই হত্যার জন্য পাঁচ দিন আগে মাসুমকে ভাড়া করা হয়। ঘটনার তিন দিন আগে কমলাপুরের ইনল্যান্ড ডিপো এলাকায় অপরিচিত এক ব্যক্তি এসে মাসুম ও তার সহযোগীকে একটি মোটরসাইকেল ও অস্ত্র দিয়ে যান। ঘটনার আগের দিনও জাহিদুলকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে এজিবি কলোনিতে গিয়েছিল মাসুম ও তার সহযোগী। তবে সেদিন তাকে সুবিধামতো না পেয়ে তারা ফিরে যান। পর দিন রাতে শাহজাহানপুরের আমতলা এলাকায় জাহিদুলকে লক্ষ্য করে অনেকগুলো গুলি করা হয়। এতে জাহিদুল ও কলেজ ছাত্রী সামিয়া আফরান জামান প্রীতি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। আহত হন জাহিদুলের গাড়িচালক মনির হোসেন।

সংবাদ সম্মেলনে ডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, জাহিদুল মতিঝিল এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন। অনেকগুলো বিষয় এই হত্যার পেছনে রয়েছে। তবে পূর্বপরিকল্পিত এই হত্যার ‘মোটিভ’ এখনো জানা যায়নি। মাসুমের সহযোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে উল্লেখ করে ডিবি বলেছে, তদন্তের স্বার্থে তার নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।

জাহিদুল ইসলাম টিপু। ছবি- সংগৃহীত

 

টিপু হত্যাকাণ্ডে কত টাকা কন্ট্রাক্ট হয়েছে জানতে চাইলে ডিবিপ্রধান বলেন, কত টাকার বিনিময়ে তা জানা যায়নি। তবে গ্রেপ্তার আকাশের বিরুদ্ধে হত্যাসহ বেশ কিছু মামলা রয়েছে। সে মামলা থেকে অব্যাহতির জন্য টিপুকে হত্যার কন্ট্রাক্ট পায় সে। এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, তার সহযোগী যারা ছিল, এ ঘটনার পেছনে কারা ছিল- তাদের গ্রেফতার করব। এছাড়া মোটরসাইকেল ও অস্ত্র উদ্ধার করব।

অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, আওয়ামী লীগ নেতার টিপু একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাকে হত্যার পর স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। হত্যার পরদিন খুনিকে একটি গ্রুপ দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা জয়পুরহাটে পৌঁছে দেয়। পরে তারা ঢাকায় চলে আসে। পুলিশ এই গ্রুপটিকে আটক করে হেফাজতে নেয়। এরপর শূটার আকাশ জয়পুরহাট দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে উল্লেখ করে এই পুলিশ কর্মকর্তা আরো বলেন কিন্তু সৌভাগ্যবশত সে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যেতে পারেনি। এরপর সে বগুড়ায় চলে যায়। বগুড়া থেকে সে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করত। তবে গোয়েন্দা তথ্য- প্রযুক্তির সহায়তায় ও বগুড়া পুলিশের সহযোগিতায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় জড়িত আরো কয়েকজন গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। আকাশকে রিমান্ডে নেওয়ার পর আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে বলে জানান এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গ্রেপ্তার আকাশের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উপজেলার কাইশকানি এলাকায়। তার বাবা মোবারক হোসেন একজন স্কুল শিক্ষক। হাফিজ আকতার বলেন, কলেজছাত্রী প্রীতির নিহত হওয়ার ঘটনার বিষয়ে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সে বলেছে, আমার টার্গেট ছিল টিপুকে হত্যা করা। তাই আমি অস্ত্রের ট্রিগার চেপে রেখেছিলাম। একাধারে গুলি বের হচ্ছিল। প্রীতিকে টার্গেট করে গুলি করিনি। প্রীতির শরীরে যে গুলি লেগেছে সেটা আমি জানতাম না। হত্যার পরের দিন টিভি দেখে জেনেছি। তাকে আমি গুলি করতেও যাইনি। আমার টার্গেট ছিল কেবল টিপু। যেহেতু বলা হচ্ছে, খুনি ভাড়া করে টিপুকে হত্যা করা হয়েছে, তাহলে এটা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড কি-না প্রশ্ন করলে সরাসরি কোনো উত্তর দেননি হাফিজ আকতার।

আজ সোমবার আকাশকে আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন করা হবে জানিয়ে অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আকতার বলেন, যারা কন্ট্রাক্ট দিয়েছে তাদের কয়েকজনের নাম সে বলেছে। টাকা নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, তার নামে মামলা তুলে নেওয়ার সুবিধার বিষয় থাকতে পারে।

ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, অনেক দিন পর শুটিং কিলিংয়ের ঘটনা ঘটেছে। আমরা দিনরাত পরিশ্রম করেছি। শুটিং মিশনে অনেকগুলো গুলি ছোঁড়া হয়। মূল কিলার গ্রেপ্তার হয়েছে। এখন তদন্তে জানা যাবে মোটিভ। আর কারা ছিল, কি কারণে খুন, পেছনে কারা জড়িত তা জানার চেষ্টা চলছে।

গত ২৪ মার্চ রাত সোয়া ১০টার দিকে রাজধানীর শাহজাহানপুরে ইসলামী ব্যাংকের পাশে বাটার শো-রুমের সামনে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসময় গাড়ির পাশে রিকশায় থাকা সামিয়া আফরান প্রীতি (১৯) নামে এক কলেজছাত্রীও নিহত হন। এছাড়া টিপুর গাড়িচালক মুন্না গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের পর ওই দিন রাতেই শাহজাহানপুর থানায় নিহত টিপুর স্ত্রী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সংরক্ষিত কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি বাদি হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। এতে অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়।

প্রায় এক দশক আগে যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কী হত্যা মামলার আসামি ছিলেন জাহিদুল ইসলাম টিপু। ৪-৫দিন আগে ফোনে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছেন তার স্ত্রী।

এজাহারে ডলি বলেন, আমার স্বামী মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য ছিলেন। আমার বাবার মতিঝিল কাঁচাবাজার এলাকায় একটি রেস্টুরেন্ট আছে। আমার স্বামী রেস্টুরেন্ট দেখাশোনা করতেন। আমার স্বামী বৃহত্তর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের ১০ বছর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন দলীয়ভাবে কোন্দল ছিল। গত ৪-৫ দিন আগে আমার স্বামীকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা মোবাইল ফোনে হত্যার হুমকি দেয়।

এজাহারে তিনি আরো বলেন, প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার মাইক্রোবাস নিয়ে গাড়িচালক মনির হোসেন মুন্নাসহ তিনি এজিবি কলোনির রেস্টুরেন্টে যান। রাতে বাসায় আসার পথে আনুমানিক সোয়া ১০টার দিকে শাহজাহানপুর মানামা ভবনস্থ বাটার দোকানের সামনে অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারীরা পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আমার স্বামীকে এলোপাতাড়ি গুলি করে। গুলিতে গাড়ির গ্লাস ভেঙে যায় এবং আমার স্বামীর গলার ডান পাশে, বুকের বাম পাশে, বুকের বাম পাশের বগলের কাছাকাছি, পেটের মধ্যে, নাভির নিচে, বাম কাঁধের ওপরে, পিঠের বাম পাশের মাঝামাঝি স্থানে, পিঠের বাম পাশের কোমর বরাবর, পিঠের ডান পাশের কোমরের ওপর মারাত্মক জখম হয়।

পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। দুষ্কৃতকারীরা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করার সময় প্রীতি নামে এক পথচারীও নিহত হন। একই ঘটনায় রিকশায় থাকা যাত্রী বদরুন্নেসা কলজের ছাত্রী প্রীতি খুনের বিষয়ে মামলা করবেন না বলে জানিয়েছেন তার বাবা।

মন্তব্য

Beta version