-->
শিরোনাম
আড়াইহাজারে ত্রাসের রাজত্ব: পর্ব-২

মদ, নারী ও সম্পদের নেশা লাক মিয়ার

যুবলীগ নেতা রাহাতকে হত্যার অভিযোগ

রুদ্র মিজান ও ইদ্রিস আলম
মদ, নারী ও সম্পদের নেশা লাক মিয়ার
সহযোগীসহ লাক মিয়া। ফাইল ছবি

লাক মিয়া শুধু জমি জবরদখলকারীই নন। বাগিয়ে নেন অন্যের স্ত্রীকেও। তার এই অপকর্মে বাধা দিলেই হামলা-মামলা থেকে শুরু করে ঘটে খুন-খারাবিও। সম্পত্তির লোভে পথের কাঁটা সরাতে ভাড়াটে খুনি দিয়ে হত্যা করেন যুবলীগ নেতা রাহাতকে।

লাক মিয়ার মূলত তিন নেশা- মদ, নারী ও জমি। এসব নেশার কারণেই অনেকে যেমন ভিটেছাড়া হয়েছেন, তেমনি সন্তানহারা হয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তিন নেশার বিষয়ে অবগত লাক মিয়ার আশপাশের সবাই। শৈশবে অর্থকষ্টে থাকলেও তারুণ্যে সেই অভাব দূর করেছেন তিনি। পাঁচ ফিট তিন ইঞ্চি লম্বা এই মানুষটি অত্যন্ত ধূর্ত বলেই এলাকায় পরিচিত।

লাক মিয়া একসময় তাঁতিদের কাছ থেকে হাতে বোনা কাপড় কিনে সরবরাহ এবং বিক্রি করতেন। কাপড়ের ব্যবসার আড়ালে তখন কেউ কেউ করতেন ফেনসিডিলের বাণিজ্য। তাদের মধ্যে লাক মিয়াও একজন। ভারত থেকে আখাউড়া হয়ে আসত সেই ফেনসিডিল। ওই সময়ে বিপুল অর্থের মালিক হয়ে যান লাক মিয়া ও তার ভাইয়েরা।

লাক মিয়ার ঘনিষ্ঠরা জানান, তখন থেকেই ফেনসিডিলে আসক্ত হন তিনি। তবে মাদক বাণিজ্যের অভিযোগে কোনো মামলা নেই তার বিরুদ্ধে। অভিযোগের তুলনায় বলতে গেলে মামলা কমই বলা যায় দুর্ধর্ষ এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে। অন্যের স্ত্রীকে ফাঁদে ফেলে বিয়ে করেছেন তিনি। ওই স্ত্রীর জমি জবরদখল করতেও ছাড়েননি। বাধা পেয়ে হাঁটেন ভিন্ন পথে। ঘটে হত্যাকাণ্ড। নরসিংদীর মাধবদী থানায় লাক মিয়ার নামে রয়েছে একটি হত্যা মামলা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাঞ্চল্যকর সেই তথ্য।

আরো পড়ুন: মূর্তিমান আতঙ্ক লাক মিয়া

সময়টা ২০০৭ সাল। লাক মিয়ার পাশের গ্রাম ছোটবিনাইরচর। ওই গ্রামে এক নারীর প্রতি লোলুপ দৃষ্টি পড়ে লাক মিয়ার। নারীর নাম ফারহানা সরকার। দক্ষিণ কান্দারপাড় নরসিংদীর জসিম উদ্দিন সরকারের মেয়ে। স্বামী থাকেন প্রবাসে। খালার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে লাক মিয়ার নজরে পড়েন তিনি। তারপরই ঘটতে থাকে ঘটনা। নানা অজুহাতে ফারহানার সঙ্গে কথা বলেন লাক মিয়া। অনৈতিক প্রস্তাব দেন। ফারহানা অসম্মতি জানান। জানিয়ে দেন, তার স্বামী ও দুই সন্তান রয়েছে। লাক মিয়া নাছোড়বান্দা। ফারহানাকে জানান, হয় তাকে বিয়ে করতে হবে নতুবা তার সঙ্গে সম্পর্ক করতে হবে। যে কোনো মূল্যে ওই নারীকে চাই তার। লাক মিয়ার দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাদের। এই বন্ধুত্বকে কাজে লাগিয়ে এবার ওই নারীর সংসার ভাঙার মিশনে নামেন লাক মিয়া। কুৎসা রটান স্বামীর বাড়ির লোকজনের কাছে। শুরু হয় কলহ। একপর্যায়ে বাধ্য হয়েই স্বামীকে ডিভোর্স দেন ফারহানা। এবার রাস্তা পরিষ্কার। নানা অজুহাতে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থেকে ফারহানার নরসিংদীর বাড়িতে যাওয়া আসা করেন লাক মিয়া। গড়ে তোলেন প্রেমের সম্পর্ক। ২০০৭ সালের ১০ মে বিয়ে হয় তাদের। ফারহানা জানান, বিয়ের পর নরসিংদীতেই ছিলেন তিনি।

বিয়ের বিষয়টি জানাজানি হলে পারিবারিক চাপের মুখে পড়েন লাক মিয়া। ফারহানাকে ছেড়ে যেতে নানা কৌশল করতে থাকেন। ফারহানার বাড়ি নির্মাণে নিজের দেওয়া কিছু টাকা ফেরত চান লাক মিয়া। এ নিয়ে কলহ বাড়তে থাকে দুজনের মধ্যে। এরমধ্যেই প্রকাশ পায় লাক মিয়ার আসল চেহারা। টাকা দিতে না পারলে বাড়ি লিখে দিতে হবে, এমন দাবি করেন তিনি। বউ নয়, তখন বাড়িটি তার কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে।

ফারহানা জানান, একপর্যায়ে কৌশলে বেড়ানোর কথা বলে বোনের বাড়ি আড়াইহাজারে নিয়ে যান তাকে। পরিকল্পিতভাবে ওই বাড়িতে নিয়ে প্রথমে তার মোবাইলফোন নিজের কাছে নেন লাক মিয়া। তারপর ফারহানার মা-বাবাকে খবর পাঠান যে তারা দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। প্রথমে হাসপাতাল পরে আড়াইহাজারের কথা বলে ওই বাসায় তাদের নিয়ে যায় লাক মিয়ার লোকজন। সেখানে নিয়ে ফারহানার মা-বাবাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করা হয়। তাদের মারধর করে, আতঙ্ক সৃষ্টি করে বাড়ি থেকে জমির দলিল আনানো হয়। ওই সময়ে ফারহানার পিতা জসিম উদ্দিন সরকার কর্তৃক তাকে দেওয়া একটি ফ্ল্যাট এবং পিতার সব সম্পত্তি জোর করে লিখে নেন লাক মিয়া। সেইসঙ্গে কিছু খালি স্ট্যাম্পেও স্বাক্ষর রাখা হয়। এমনকি ফারহানার বাবার ব্যবহৃত গাড়ি (ঢাকা মেট্টো-ড-২৭৫৭১১) লিখে নেন লাক মিয়া।

তারপর দীর্ঘদিন ওই বাসাতে আটকে রাখা হয় ফারহানাকে। পরবর্তীতে ফারহানার বাড়ি দখলের জন্য নরসিংদীতে সন্ত্রাসী হামলা চালান নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের চেয়ারম্যান লাক মিয়া।

এ বিষয়ে ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর অভিযোগ করেন ফারহানা। অভিযোগে উল্লেখ করেন, ২০১৩ সালের ২৩ জানুয়ারি রাত ১০টার দিকে লাক মিয়ার নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা বাড়ি দখলের জন্য হামলা চালায়। এ সময় ফারহানাকে মারধর করে ওই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদ করায় লাক মিয়ার শত্রুতে পরিণত হন ফারহানার ভাই রাহাত সরকার। পরবর্তীতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন রাহাত। নরসিংদীর চাঞ্চল্যকর রাহাত হত্যা মামলায় এক নম্বর আসামি করা হয়েছে লাক মিয়াকে। এ ছাড়াও আসামি করা হয়েছে নরসিংদীর রাঙামাটি গ্রামের এস এম কাইয়ুম, নরসিংদীর মাধবীর টাটাপাড়ার রাজন ও হেমন্দ্র সাহার মোড়ের সজলকে।

২০১৭ সালের ৭ মে মাধবদী থানার নরসিংদী-মদনগঞ্জ সড়কে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাহাতের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, হত্যাকাণ্ডের আগে রাহাতের সঙ্গে ছিলেন রাজন। পরদিন নরসিংদী যুবলীগের সম্মেলনে উপস্থিতি বাড়াতে তৎপর ছিলেন যুবলীগ নেতা রাহাত। ফারহানা জানান, এজন্য রাজনকে সঙ্গে নিয়ে মাধবদীতে গিয়েছিলেন রাহাত সরকার। লাক মিয়ার লোক হিসেবে পরিচিত রাজন। লাক মিয়া ও এস এম কাইয়ুমের পরিকল্পনায় রাহাতকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। ফারহানা বলেন, বিপুল অর্থের মালিক লাক মিয়া। মোটা অংকের টাকা ব্যয় করে সঠিক তদন্তে বাধা দেন। যে কারণে দুটি তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদনেও হত্যাকারীদের হদিস পাওয়া যায়নি।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি আদালত মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন ডিবি পুলিশকে। ফারহানা জানান, রাহাত হত্যার বিচারের জন্য তিনি শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবেন।

লাক মিয়া সম্পর্কে ফারহানা বলেন, লাক মিয়ার মদ, নারী ও অর্থ-সম্পত্তির নেশা প্রবল। সম্পত্তির জন্য সে সবই করতে পারে। সুন্দরী মেয়েদের চাকরি দিয়ে, হুমকি দিয়ে, অর্থ দিয়ে নিজের দখলে রাখে। একইভাবে জমিও দখল করে। এজন্য টার্গেটকৃত জমির এলাকায় আতঙ্ক তৈরি করে কৌশলে। প্রতিবাদের মুখে কখনো কখনো এসব জমি নামমাত্র মূল্য দিয়ে দখল করে। আবার একই জমি একাধিক ব্যক্তির নামে হাতবদল করে শেষ পর্যন্ত স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রেশন করে নয়। এভাবেই নামে বেনামে লাক মিয়া এখন শত শত বিঘা জমির মালিক বনে গেছেন।

ফেনসিডিলের নেশা তার পুরোনো। যখন সংসার করেছি তখন অনেক চেষ্টা করেও তা থেকে মুক্ত করতে পারিনি। ফেনসিডিলের বাণিজ্য করতে গিয়েই লাক মিয়া এতে আসক্ত হয়ে যান বলে জানান ফারহানা।

অপরদিকে সম্প্রতি (০১-০৩-২০২২) রূপগঞ্জ উপজেলার মতুজাবাদ গ্রামের হারুন অর রশীদ নামের এক ব্যক্তি রূপগঞ্জ থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন লাক মিয়ার ভাই লাট মিয়া (৫০)-এর বিরুদ্ধে। সেই অভিযোগে বলা হয়, রূপগঞ্জ থানাধীন পানাব মৌজার আরএস দাগ নং-৩৪৭ এর ২৮ শতাংশ জমির ক্রয় সূত্রে মালিক তার পিতা। সেই সূত্রে ওই ভূমিতে ভোগ দখলেও আছেন তারা। ওই ভূমির চারপাশে নির্মিত বাউন্ডারি দেয়াল ভাঙচুর করে লাক মিয়ার ভাই লাট মিয়া গ্যাংয়ের লোকজন। অভিযোগকারী উল্লেখ করেন, বাউন্ডারি দেয়াল ভেঙে অন্তত এক লক্ষ টাকার ক্ষতি করা হয়েছে। দেয়াল ভাঙচুরের ঘটনায় প্রতিবাদ করলে তাকে মিথ্যা মামলা ও প্রাণ নাশের হুমকি দেওয়া হয়।

এসব বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলতে চাননি লাক মিয়া। প্রশ্ন জেনেই ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।

(আগামীকাল থাকবে- নুন আনতে পান্তা ফুরনো নব্য ধনকুবের লাক মিয়া)

মন্তব্য

Beta version