ডা. আহমেদ মাহী বুলবুল ছিনতাইকারীদের হাতে নিহত হয়েছেন নাকি পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে তাকে- এই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি এখনো। এই ঘটনায় বুলবুলের স্ত্রী শাম্মী আখতার বাদী হয়ে ডিএমপির মিরপুর থানায় মামলা দায়ের করেছেন। থানা পুলিশ ছাড়াও চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করছে র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি কোনো সিসি ক্যামেরার ফুটেজ না পেলেও কিছুটা দূরের কয়েকটি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। রোকেয়া সরণি এলাকায় কয়েকটি ফুটেজে সন্দেহমূলক চলাচলকারী কয়েকজনকে খুঁজছে পুলিশ।
ঘটনার সময় দুটি দলে বিভক্ত হয়ে দুই দিকে দুই গলি দিয়ে অন্তত তিনজনকে যেতে দেখা গেছে সিসি ক্যামেরার ফুটেজে। এর মধ্যে দুই যুবককে ওই সময়ে রোকেয়া সরণির রাস্তা দিয়ে দ্রুত হেঁটে যেতে দেখা গেছে। ওই অজ্ঞাত যুবকদের সন্দেহের তালিকায় রেখে তদন্ত করছে পুলিশ।
মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাজিরুল ইসলাম জানান, পরিকল্পিত হত্যা ও ছিনতাইকারীদের হাতে হত্যা- এই দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তবে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের কোনো কারণ পায়নি পুলিশ। যদিও ডা. বুলবুলের স্বজনরা মনে করছেন তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হতে পারে।
ডা. বুলবুলের ছোট ভাই আহমেদ রাহি বকুল বলেছেন, ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলে ছিনতাইকারীরা তার ফোন ও মানিব্যাগ ফেলে যেত না। যেহেতু এগুলো খোয়া যায়নি আমাদের ধারণা তাকে হত্যা করা হয়েছে। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হতে পারে। এই হত্যাকাণ্ডে পরিচিতদের কেউ জড়িত থাকতে পারে। তা না হলে এত সকালে তিনি বাসা থেকে বের হবেন এই তথ্য হত্যাকারীদের জানার কথা নয়। সঠিকভাবে তদন্ত করে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবি জানান তিনি।
গোয়েন্দারা জানান, পরিবারের অভিযোগ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। ডা. বুলবুলের কললিস্ট থেকে শুরু করে নানা বিষয় বিশ্লেষণ করছেন তদন্তকারীরা। গতকাল সকালে ডা. আহমেদ মাহি বুলবুলের লাশ ঢাকা থেকে রংপুরের ভগিবালাপাড়ায় নিজ বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে রংপুরের ভগিবালাপাড়ার বাতাস। বাদ জোহর স্থানীয় রামপুরা জামে মসজিদে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়।
পরবর্তীতে ডা. আহমেদ মাহি বুলবুলকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে এর সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে রংপুরে সংবাদ সম্মেলন করেছেন পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা।
ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছেন তার মা বুলবুলি বেগম। একই সঙ্গে ডা. বুলবুলের দুই সন্তানের পড়ালেখার দায়িত্ব সরকারকে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নিহত বুলবুলের মা বুলবুলি বেগম, ভাই বকুল, বুলবুলের আট বছরের কন্যাশিশু ও দেড় বছরের সন্তান নিয়ে স্ত্রী শাম্মী আখতার।
ডা. বুলবুলের লাশের ময়নাতদন্ত শেষে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সেলিম রেজা জানান, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে বুলবুলের মৃত্যু হয়েছে। তার ডান পায়ের উরুতে ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। এতে গুরুত্বপূর্ণ রগ কেটে রক্তক্ষরণ হয়েছে।
বুলবুলের ঘনিষ্ঠরা অভিযোগ করেছেন, হামলার শিকার হওয়ার পর নিকটস্থ আল হেলাল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। কিন্তু বেসরকারি এই হাসপাতালটি চিকিৎসা দেয়নি তাকে। পুলিশ কেস বলে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে।
রোকেয় সরণি এলাকায় প্রহরী হিসেবে কর্মরত ইসমাইল হোসেন জানান, চিৎকার শুনে তারা এগিয়ে গিয়ে বুলবুলকে উদ্ধার করে আল হেলাল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। একই কথা বলেন বুলবুলের বন্ধু মোহাম্মদ সিরাজ। তিনি জানান, তারা চিকিৎসা না দিয়ে ৯৯৯-এ কল দিয়ে পুলিশকে খবর দেয়। এখানেও কিছু সময়ক্ষেপণ হয়েছে, যার কারণে অতিরিক্ত রক্তপাতে বুলবুল মারা যান। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অস্বীকার করেছে। পরবর্তীতে তাকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
দন্ত চিকিৎসার পাশাপাশি ঠিকাদারি করতেন আহমেদ মাহী বুলবুল। গতকাল রোববার সকালে শেওড়াপাড়ার বাসা থেকে নোয়াখালী যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হন তিনি। শেওড়াপাড়া থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশায় রোকেয়া সরণিতে পৌঁছালে তিনি আক্রান্ত হন। হামলাকারীরা তার উরুতে ছুরিকাঘাত করে। এ সময় তিনি চিৎকার করলে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। ডা. আহমেদ মাহি বুলবুলের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন বুলবুল।
১৯৯৭ সালে রংপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর তিনি ঢাকায় একটি বেসরকারি ডেন্টাল কলেজে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে রাজধানীর মগবাজারে ‘রংপুর ডেন্টাল’ নামে একটি চেম্বার খুলে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন। সেখানে তিনি গরিব রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতেন। স্ত্রী শাম্মী আখতার ও দেড় বছর বয়সি ছেলে সামি এবং আট বছর বয়সি কন্যা আয়নকে নিয়ে শেওড়াপাড়ার ভাড়া বাসায় থাকতেন বুলবুল।
মন্তব্য