-->
শিরোনাম

‘কাট-আউট’ পদ্ধতিতে হত্যা

এমদাদুল হক খান
‘কাট-আউট’ পদ্ধতিতে হত্যা
প্রায় এক দশক আগে যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কী হত্যা মামলার আসামি ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু।

রাজধানীর শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু ও বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফনান প্রীতি হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সন্দেহভাজন সুমন শিকদার ওরফে মুসা কোথায় তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধুম্রজাল। গোয়েন্দাদের দাবি, কিলার ভাড়া করার পর দেশ ছেড়ে পালিয়েছে মুসা। তবে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র দাবি করেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতেই আছে মুসা। হত্যাকাণ্ড সংঘটনের তথ্য-উপাত্ত ও আলামত বিশ্লেষণ করে পুলিশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন- ‘কাট-আউট’ পদ্ধতিতে হত্যা করা হয় টিপুকে।

এদিকে গতকাল বুধবার দুপুরে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়াকে সঙ্গে নিয়ে গুলিতে নিহত কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান প্রীতির শান্তিবাগের বাসায় যান তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। এ সময় তিনি বলেন, কলেজছাত্রী সামিয়া আফরিন প্রীতির মৃত্যু এত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক যে, মেনে নেওয়া যায় না। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে এবং আমরা তাদের পাশে আছি সেটা জানানোর জন্যই আমাদেরকে পাঠিয়েছেন।

সামিয়ার বাবা জামাল উদ্দিন, মা হোসনেআরা ও এসএসসি পরীক্ষার্থী ছোট ভাই সোহায়েব সামির সঙ্গে একান্তে কথা বলেন তারা। অশ্রুসিক্ত সামিকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখেন তথ্যমন্ত্রী। পরে ড. হাছান সাংবাদিকদের জানান, আমরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে, দলের পক্ষ থেকে তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছি, যে কোনো প্রয়োজনে আমাদের দল, আমাদের সরকার তাদের পাশে থাকবে।

তথ্যমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যেই মূল আসামী গ্রেপ্তার হয়েছে। একই ঘটনায় আমাদের দলের একজন নেতা মৃত্যুবরণ করেছেন। নিহত ছাত্রী সামিয়ার পরিবার মামলা না করলেও জাহিদুল ইসলাম টিপুর স্ত্রী মামলা করেছেন। সেই মামলার এজাহারে প্রীতির হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ আছে। আইন অনুযায়ী একই ঘটনায় দুটি মামলার প্রয়োজন নেই। মূল আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে, যারা তার সঙ্গে ছিল তারাও পুলিশের জালের মধ্যে আছে। আমরা আশা করি, তারাও খুব সহসা গ্রেপ্তার হবে। যথোপযুক্ত বিচার করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। সামিয়ার মা-বাবার আরেকটি সন্তান প্রীতির ছোট ভাই এসএসসি পরীক্ষা দেবে, তার সঙ্গেও আমাদের কথা হয়েছে। ‘আমরা এখান থেকে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আমাদের দলের সভাপতি শেখ হাসিনাকে বিস্তারিত জানাব’ উল্লেখ করেন হাছান মাহমুদ।

সরকারের কাছে সামিয়ার পরিবার কোনো সাহায্যের আবেদন করেছে কি না-এ প্রশ্নের জবাবে তথ্যমন্ত্রী বলেন, তারা সরকারের কাছে এখনো আবেদন করেনি, আমরা এ বিষয়টি দেখার জন্য আমাদের কাউন্সিলরকে দায়িত্ব দিয়েছি এবং সরকারের পক্ষ থেকে যথাসম্ভব করা হবে।

জানা গেছে, রাজধানীর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সন্দেহভাজন সুমন শিকদার ওরফে মুসা ঘটনার কয়েক দিন আগে দেশ ছেড়েছেন। মুসা ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ-বিকাশ গ্রুপ ও মানিক গ্রুপের সদস্য। তিনি মতিঝিল এজিবি কলোনিতে যুবলীগ নেতা রিজভী হাসান ওরফে বোঁচা বাবু হত্যা মামলার অন্যতম আসামি। সম্প্রতি জামিন পাওয়া এই মামলার আসামিরা জাহিদুল ইসলাম হত্যা মামলায় সন্দেহভাজন।

রিজভী হাসান হত্যা মামলার বাদী তার বাবা আবুল কালাম, যিনি জাহিদুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ। মামলাটি মিটমাটের জন্য মুসাসহ আসামিরা জাহিদুলের কাছে গিয়ে ব্যর্থ হন। জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যা মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ধারণা, অপরাধ জগৎ ও দলীয় প্রতিপক্ষ জাহিদুলকে খুন করতে রিজভী হাসান হত্যা মামলার আসামিদের ব্যবহার করেছে।

জাহিদুল হত্যার পর পুলিশ ও র‌্যাব সন্দেহভাজন হিসেবে যাদের খুঁজছে, তাদের মধ্যে অন্যতম মুসা। তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাদের ধারণা, মুসা খুনি ভাড়া করাসহ অন্যান্য পরিকল্পনা শেষে দুবাই চলে গেছে। সেখান থেকে জাহিদুল হত্যার বিষয়টি তদারকি করেন। এ ব্যাপারে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ঘটনার পর দেশে মুসার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কিছুদিন আগে হয়তো দেশ ছেড়েছেন তিনি।

গত ২৪ মার্চ রাত সোয়া ১০টার দিকে রাজধানীর শাহজাহানপুরের আমতলী এলাকার রাস্তায় অস্ত্রধারীর গুলিতে নিহত হন মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু (৫৪)। ওই সময় গাড়ির কাছেই রিকশায় থাকা বদরুন্নেছা সরকারী মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফরান প্রীতিও গুলিতে নিহত হন। ওই ঘটনায় পরদিন সকালে টিপুর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ডলি শাহজাহানপুর থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা দায়ের করেন।

হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়া শুটার মাসুম আহম্মেদ আকাশকে গত ২৭ মার্চ জয়পুরহাট-বগুড়া এলাকার মাঝামাঝি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে মতিঝিল গোয়েন্দা-পুলিশ। তাকে গ্রেপ্তারে সহায়তা করে বগুড়া জেলা পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মাসুম ঘটনার দায় স্বীকার করলেও এই ঘটনার জন্য সে অনুতপ্ত বলেও জানায়। পরিবার থেকে বিচ্যুত ছিল। বাবা-মা এমনকি স্ত্রীর সঙ্গেও ছিল না ভালো সম্পর্ক। সবুজবাগ এলাকায় ডিশ ব্যবসায় জড়িত ছিল। ব্যবসাও ভালোভাবে চলছিল না। এসব নিয়ে হতাশা কাজ করছিল তার ভেতর। এলাকায় স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িত থাকলেও ছিল না কোনো পদ।

গোয়েন্দারা জানতে পারেন, বিভিন্নভাবে পারিবারিক-সামাজিক ও আর্থিক হতাশাকে কাজে লাগিয়ে কাছের লোকজনই তাকে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ভাড়া করে। তাকে বলা হয়, এ কাজ করা হলে তার নামে থাকা ৪টি মামলা থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে। মাসুম গোয়েন্দাদের আরো জানায়, হত্যাকাণ্ডের সময় রাস্তার অন্য পাশে মোটরসাইকেলে থাকা ব্যক্তির সঙ্গে কন্ট্রাক্ট কিলিং নিয়ে তার দফারফা হয়। এতে আরো যারা জড়িত ছিল তাদের অনেকের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। তারাও আছে নজরদারিতে। যে মোটরসাইকেলে ঘটনাস্থল থেকে মাসুম পালায়, মূলত সে মোটরসাইকেলের চালকই এই হত্যার জন্য চুক্তিবদ্ধ করে তাকে। এ কাজে ‘কাট-আউট’ পদ্ধতি বেছে নেয় তারা। এতে মূল আদেশদাতা বা একজনের সঙ্গে আরেকজনের সরাসরি কোনো যোগাযোগ থাকে না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মাধ্যমে নির্দেশনা দেওয়া হয় শুধু। ওই মোটরসাইকেল চালককেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) রিফাত রহমান শামীম বলেন, মাসুমকে জিজ্ঞাসাবাদে আরো কিছু জেনেছি। অনেকের নাম পেয়েছি। সেসব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট আরো কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলে এ হত্যার মোটিভ পরিষ্কার হবে।

মন্তব্য

Beta version