যেখানে বাবা-মায়ের কাছে নিরাপদ নয় সন্তান! স্বামীর কাছে স্ত্রী, স্ত্রীর কাছে স্বামী, বাদ যাচ্ছেন না কেউ। মানুষের আচরণে হিংস্রতা বেড়েছে। নিজ ঘরেই ঘটছে নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। সেইসঙ্গে বাড়ছে নারী নির্যাতনের ঘটনাও। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু নির্মম ঘটনা সেটারই প্রতিচ্ছবি বহন করছে।
নারী ও শিশুদের ওপর পারিবারিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, যৌন হয়রানি, শ্লীলতাহানি, ইভটিজিং, ধর্ষণসহ সব ধরনের নির্যাতনের শিকার অসহায় মানুষের পাশে আইনি সহয়তা দিতে ২৪ ঘণ্টা কাজ করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ছোট্ট একটি বিভাগ উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন।
পুলিশ বলছে, শুধু এগুলোই নয় এছাড়াও রয়েছে অপহরণ, পাচার, যৌতুক, যৌতুকের জন্য নির্যাতনসহ অন্য যে কোনো ধরনের নির্যাতন ও সহিংসতা রোধে ২৪ ঘণ্টা কাজ করে যাচ্ছে পুলিশের এই বিভাগ। যেখানেই নারী ও শিশু নির্যাতন সেখানেই উপস্থিত এই ইউনিটের সদস্যরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছোট্ট একটা বিভাগ কিন্তু কাজ করছে বহুমাত্রিক মিশন নিয়ে। বাংলাদেশ পুলিশের তত্ত্বাবধানে ২০০৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অধীনে তেজগাঁও থানাসংলগ্ন বাংলাদেশের প্রথম ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে এর নাম পরিবর্তন করে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন করা হয়।
থানার মতো ২৪ ঘণ্টার জন্য বিরামহীন সেবা প্রদানের প্রত্যয় নিয়ে পথ চলা এ বিভাগের। সহিংসতার শিকার নারী ও শিশু ভিকটিমদের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা, খেলাধুলা, বিনোদন, যাতায়াত, আইনি পরামর্শ, কাউন্সেলিং ও পারিবারিক সমস্যায় মধ্যস্থতা দেওয়ার পাশাপাশি মামলা তদন্ত এবং ভিকটিম উদ্ধার এ ডিভিশনের মূল কাজ।
উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন সেবা গ্রহণকারী নারী ও শিশুদের একই কেন্দ্র থেকে পুলিশি সেবা প্রদানের পাশাপাশি আইনগত সহায়তা, কাউন্সেলিং ও পুনর্বাসন সেবা প্রদান করে। ভিকটিমের ঠিক কি প্রয়োজন সেটা বিবেচনা করে পুলিশ ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। নারী ও শিশু ভিকটিমের বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে দেখা হয় এবং নারী পুলিশ সদস্য বিষয়টি তদারকি করেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে নগরীর তেজগাঁও থানা চত্বরে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১১ সালে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের অধীন উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ চালু করে ডিএমপি। গত এক যুগে এ সেন্টার ১৮ হাজার নারী-শিশুকে আইনি সহায়তা দিয়েছে। এর মধ্যে গত পাঁচ বছরে সেবা দেওয়া হয় ১০ হাজার নারী ও শিশুকে। গত ১০ বছরে নারী ও শিশুদের করা মোট ৪ হাজার ৩৮০ মামলার তদন্ত করেছে এ সেন্টার।
এছাড়াও নারী ও শিশুদের প্রতি যে কোনো ধরনের সহিংসতার ক্ষেত্রে জরুরি প্রয়োজনে যে কোনো সময় (২৪/৭) পুলিশের সহায়তা পেতে ৯৯৯ নম্বরে কল করুন। আসুন নিজে সচেতন হই, অন্যকে সচেতন করি নিরাপদ জীবন গড়ি। মনে রাখি, উদ্ঘাটনের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।
ডিএমপির ৫০ থানার স্পর্শকাতর মামলা, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) তদন্তাধীন নারী ও শিশুবিষয়ক মামলা এবং জিডির বাদী হওয়া ভুক্তভোগীদের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগে পাঠানো হয়। ঢাকার আশপাশের জেলার মামলা ও জিডির বাদীর ভুক্তভোগীদেরও এখানে পাঠানো হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন আদালত থেকে পাঠানো ভুক্তভোগীকে এখানে সেবা দেওয়া হয়।
ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, এই সেন্টার থেকে গত ১০ বছরে নারী ও শিশুদের করা মোট ৪ হাজার ৩৮০ মামলার মধ্যে ২ হাজার ৪০৫ মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। ১ হাজার ২৩৭ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। বাকি ৭৩৮ মামলা তদন্তাধীন। এসব মামলার তদন্ত শেষ হলেও ডিএনএ ও মেডিকেল পরীক্ষার প্রতিবেদন না পাওয়ায় অভিযোগপত্র আটকে আছে। এ ছাড়া ধর্ষণ, গণধর্ষণ, যৌতুক ও অপহরণের অভিযোগে আদালতে হওয়া ৪৮ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার। এর মধ্যে তদন্ত শেষে ৪৪ মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি চারটি মামলা তদন্তাধীন।
উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের প্রধান ডিএমপির উপ-কমিশনার হামিদা পারভীন বলেন, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে সেবা নেওয়ার প্রত্যাশা বেড়েছে। এখান থেকে ২০২০ সালে ১ হাজার ৯৯৪ জন এবং গত বছর ২ হাজার ২৪ জন নারী ও শিশুকে আইনি সহায়তা এবং সেবা দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের হটলাইনে অন্তত ২০০ জন যোগাযোগ করেন। এ ছাড়া ১০ থেকে ১৫ জন সশরীরের অভিযোগ জানান। তাদের মধ্যে অনেকে মামলা বা জিডি করতে চান না। তারা সমাধান চান। তখন উভয় পরিবারকে নিয়ে বসে সমস্যার সমাধান করা হয়।
ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, সহিসংতার শিকার নারীদের বক্তব্য শুনে সমস্যা চিহ্নিত করা হয়। এরপর সহায়তা দেওয়া হয়। ভুক্তভোগীকে চিকিৎসাকেন্দ্রে জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হয়। সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে সহায়তা দেওয়া, আটকে পড়া নির্যাতনের শিকার নারী-শিশুকে তাৎক্ষণিক উদ্ধারে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ ছাড়া কাউন্সেলিং সেবা দেওয়া হয় এখানে। স্বাভাবিক প্রয়োজনে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঁচ দিন থাকা যায়। বিশেষ প্রয়োজনে ভুক্তভোগী নারী ও শিশুকে দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত রাখা হয়। এ সময় থাকার জায়গার পাশাপাশি খাবারসহ প্রয়োজনীয় সুবিধা দেওয়া হয়। তদন্তে মামলার বাদী ও ভুক্তভোগীকেও সহায়তা দেওয়া হয়। পরিবারে একত্রীকরণ, পুনর্বাসনের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় পাঠানো হয় এখান থেকে। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের সঙ্গে ১০টি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করছে।
বিদেশি নারীকে বিয়ে করে দেশে এনে নির্যাতন প্রসঙ্গে হামিদা পারভীন বলেন, বিদেশি নারীকে বিয়ে করে এনে দেশে নির্যাতন ও দেশের নারী বিদেশে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হলে তাদের সমস্যা সংশ্লিষ্ট দেশের মাধ্যমে সমাধান করে দেয় এ সেন্টার। ভারত, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া ও মিসরে এ ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রে সমাধান করে দিয়েছে এই সেন্টার।
মন্তব্য