-->

রজনীগন্ধা মার্কেটে যেভাবে লুট হয় সোনার দোকান

নিজস্ব প্রতিবেদক
রজনীগন্ধা মার্কেটে যেভাবে লুট হয় সোনার দোকান
গ্রেপ্তার তিন ডাকাতদলের সদস্য

গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর কচুক্ষেতের রজনীগন্ধা টাওয়ারের নিচতলায় রাঙাপরী জুয়েলার্স নামে একটি সোনার দোকান থেকে প্রায় ৩০০ ভরি সোনা লুট হয়ে যায়। এ দুর্ধর্ষ ঘটনায় মুন্সীগঞ্জ ও বরিশালে অভিযান পরিচালনা করে সোনার অলংকার লুটচক্রের মূলহোতা মো. রাজা মিয়া (৫৪),সহযোগী মো. কাউসার হোসেন ওরফে বাচ্চু মাস্টার (৪২) ও মো. মাসুদ খান (৪২)কে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

তাদের জিজ্ঞাসাবাদে ওই জুয়েলারির দোকানে ডাকাতির বিবরণসহ আরো অনেকগুলো জায়গায় এই অপরাধ চক্রের ডাকাতি ও সোনার অলংকার লুটের তথ্য পেয়েছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার এই বাহিনী।

র‌্যাব জানিয়েছে, এই চক্রটির দলনেতার নাম রাজা মিয়া। সে অটোরিকশা চালানোর আড়ালে এই ডাকাতদলটি পরিচালনা করত। অটোরিকশা চালালেও তার মূল কাজ ছিল বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে জুয়েলারির দোকানগুলোর অবস্থা যাচাই করা এবং লুটপাটের ছক আঁটা।

এই ধুরন্ধর দলনেতার আরেকটি বৈশিষ্ট হচ্ছে সে একজন দক্ষ তালা-চাবির কারিগর। একসময়ের বাস কন্ডাক্টর থেকে পেশা বদলে অটোরিকশাচালক হওয়া রাজা মিয়া দুই দশকে অর্ধ-শতাধিক চুরি-ডাকাতির ঘটনায় জড়িত, তবে সব অপরাধের জড়িত থাকার খোঁজ না মেলায় তাকে এতগুলো অপরাধের মামলা বয়ে বেড়াতেও হচ্ছে না।

র‍্যাব জানায়, ২০০২ সালের দিকে একটি সংঘবদ্ধ ডাকাত চক্রের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। তাদের মাধ্যমেই সে অপরাধে জগতে প্রবেশ করে।

মঙ্গলবার (৫ এপ্রিল) র‍্যাব সদর দপ্তর থেকে এক ভিডিও বার্তায় র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।

তিনি বলেন, প্রায় এক যুগ ধরে বিভিন্ন ছদ্মবেশে ব্যাংক ডাকাতি ও স্বর্ণালংকার লুটকারী চক্রের মূলহোতা রাজা মিয়াসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন,গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর কচুক্ষেতের রজনীগন্ধা টাওয়ারের নিচতলায় রাঙাপরী জুয়েলার্স নামে একটি সোনার দোকান থেকে প্রায় ৩০০ ভরি সোনা লুটের একটি দুর্ধর্ষ ঘটনা ঘটে।

ওই ঘটনায় বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে মুন্সীগঞ্জ ও বরিশালে অভিযান পরিচালনা করে সোনার অলঙ্কার লুটচক্রের মূলহোতা মো. রাজা মিয়া (৫৪),সহযোগী মো. কাউসার হোসেন ওরফে বাচ্চু মাস্টার (৪২) ও মো. মাসুদ খান (৪২)কে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় লুট করা ১৯.৭০ গ্রাম সোনা ও নগদ ৩ লাখ ২৯ হাজার ১৮০ টাকা। চুরির ঘটনায় রাজা মিয়া দোকানে লুটের পরিকল্পনা করে এবং লুটের সময় স্বর্ণের দোকানে শার্টারের তালা ভাঙার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল।

 উদ্ধার করা সোনার অলংকার

 

চক্রটির অপরাধের ধরন বিশ্লেষণ করে র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, তারা প্রথমে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র, নাগরিক সনদপত্র ইত্যাদি ব্যবহার করে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে তাদের লক্ষ্যবস্তু দোকানগুলোতে বা ওই মার্কেটে নিরাপত্তাকর্মী বা পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে যোগ দেয়। পেটেভাতে চাকরি চাওয়ায় তাদের চাকরি পাওয়া সহজ হয়। অথবা কখনো তারা টার্গেটের আশেপাশে দোকান ভাড়া নেয়। পরবর্তীতে সোনার অলংকার লুট করার পর তারা আত্মগোপনে চলে যায়। এসময় তারা নিজেদের মধ্যে সব ধরনের যোগাযোগও বন্ধ করে দেয়। পর্যায়ক্রমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা কিছুদিন পর নতুন লক্ষ্যবস্তু ঠিক করার জন্য ফের যোগাযোগ করে।

জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানায় যে, তারা সংঘবদ্ধ ব্যাংক ডাকাতি ও স্বর্ণালঙ্কার লুটচক্রের সক্রিয় সদস্য। এই চক্রের সদস্য সংখ্যা ৮-১০ জন। গ্রেফতারকৃতরা সকলেই বিভিন্ন পেশার আড়ালে দীর্ঘদিন যাবত পারস্পারিক যোগসাজসে দেশের বিভিন্ন স্থানের সোনার দোকান লুট, ব্যাংক ডাকাতি ও বিভিন্ন মার্কেটে লুট করে আসছে।

রজনীগন্ধা মার্কেটে যেভাবে লুট হয় সোনার দোকান

র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, তারা জিজ্ঞাসাবদে জানতে পেরেছেন, রজনীগন্ধা মার্কেটে সোনার দোকান লুটপাটের আগে প্রতারকচক্রের এক সদস্য সেখানে একটি দোকান ভাড়া নেয়। তার নাম কাউসার মাস্টার।

এরপর কাউসার মাস্টার তার দলসঙ্গী মাসুদকে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে রাজধানীর মিরপুরের একটি সিকিউরিটি এজেন্সির সদস্য হিসেবে চালিয়ে দেয়। এরপর তাকে কৌশলে রজনীগন্ধা মার্কেটে সিকিউরিটি গার্ড এ চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তারা বিভিন্ন সময়ে মার্কেটের সিকিউরিটিসহ অন্যান্য বিষয়ের খোঁজখবর নিতে থাকে এবং সোনার দোকানটি লুটের ছক আঁটতে থাকে। আর রাজা মিয়া তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাউসারের ভাড়া করা দোকানে নাম সর্বস্ব মালামাল রেখে কৌশলে লুটের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জামাদি মজুত করে।

আসামিদের বরাত দিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, গত ৪ ফেব্রুয়ারি ঘটনার রাত একটায় মাসুদ চক্রের বাকি সবাইকে রজনীগন্ধা মার্কেটে আসতে বলে। এরইমধ্যে মাসুদ মার্কেটের অন্যান্য নিরাপত্তাকর্মীদের কৌশলে খাবার ও পানীয়ের মধ্যে চেতনানাশক সেবন করিয়ে অজ্ঞান করে। তখন পরিকল্পনা মোতাবেক অন্যরা মার্কেটের সামনে এলে মাসুদ ও তার এক সহযোগী গেটের তালা খুলে তাদেরকে কাউসার এর ভাড়া করা দোকানের ভেতর নিয়ে যায়। এসময় কাউসার মাস্টার ও তার এক সহযোগী মার্কেটের বাইরের চারপাশ নজরদারিতে থাকে। পরবর্তীতে রাত আনুমানিক ২টার দিকে কাউসার মাস্টারের দোকানে আগে থেকে মজুতে করে রাখা তালা ভাঙার যন্ত্রপাতি দিয়ে দুটি দোকানের তালা এবং শাটার ভেঙে রাজা মিয়াসহ আরও ২/৩ জন দোকানের ভেতর ঢোকে।

ওই দোকানের ভেতর থাকা স্বর্ণলংকার ও নগদ টাকা লুট করে তাদের ভাড়া করা দোকানে নিয়ে যায়। ঘটনা চলাকালীন সময়ে মাসুদ দোকানের বাইরে পাহারা দেয়। দোকানে যে স্বর্ণালঙ্কার লুট হয়েছে তা যেন তাৎক্ষণিক বোঝা না যায় সেজন্য তারা দোকানে নতুন তালা লাগিয়ে দেয়। এরপর ভোরে লুট করা মালামালসহ কেরানীগঞ্জে কাউসার মাস্টার এর আগে থেকে ভাড়া করা বাসায় চলে যায়।

গ্রেফতারকৃতরা আরও জানায় যে, ঘটনার দিন সকালেই তারা লুট করা সোনার অলংকার ও নগদ টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে তাদের গ্রামের বাড়ি চলে যায়।

র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, এ ঘটনার অন্যতম প্রধান হোতা কাউসার মাস্টার ওরফে কাউসার হোসেন মাধ্যমিক পাস। সে প্রথম জীবনে আরআরএমপির একটি প্রকল্পে চাকরি করে। পরবর্তীতে ২০০৯ সাল হতে ঢাকায় এক আইনজীবীর অফিস সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে। ২০১৮ সালে মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে সংঘবদ্ধ ডাকাতি ও স্বর্ণালঙ্কার লুট চক্রের এক সদস্য আদালতে এলে সেখানে কাউসার এর সঙ্গে পরিচয় হয়। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। ২০১৮ সালে সিদ্ধিরগঞ্জের সোনার অলংকার লুটে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে।গ্রেফতারকৃত মাসুদ ঢাকার চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ক্লিনার ও বয় হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করে। চাইনিজ রেস্টুরেন্টে চাকরি করা অবস্থায় ২০১০ সালের দিকে এই চক্রের সঙ্গে তার পরিচয় ও সখ্যতা শুরু। সে ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জে একটি গার্মেন্টসে চাকরি নেয়। ২০১৮ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে থাকা অবস্থায় নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন হাজী আহসান উল্লাহ সুপার মার্কেটের দুটি সোনার দোকানের প্রায় ২ কেজি সোনা লুট করে। সেই লুটের ঘটনায় সে গ্রেপ্তার হয়ে সাজাও ভোগ করে। এরপর বের হয়ে আবারো একই পেশায় জড়িয়ে যায়। তার নামে ৩টি চুরির মামলাও রয়েছে।

আরো সোনার দোকান লুট

র‍্যাবের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে কচুক্ষেতের রজনীগন্ধা মার্কেটের একটি জুয়েলারি দোকানে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনারও আগে ২০১৪ সালে মিথ্যা পরিচয়ে জয়পুরহাট শাখার ব্র্যাক ব্যাংকের পাশের একটি ঘর এনজিও’র নামে ভাড়া নিয়ে সেখান থেকে কৌশলে ওই ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে এক কোটি ৯৫ লাখ টাকা লুট করে এই চক্র।

সেই লুটের কৌশল তুলে ধরে র‍্যাব জানায়, ভল্ট লুটের এক সপ্তাহ আগে থেকে স্ক্রু ড্রাইভার ও শাবল দিয়ে দেয়াল কেটে ব্যাংকের ভল্টে ঢুকে ঐ টাকা লুট করে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে র‌্যাবের অভিযানে রাজা মিয়াসহ ৭ জন গ্রেফতার হয়। ঐ ঘটনায় রাজা মিয়া ৩ বছর কারাভোগ করে।

একইভাবে তারা ২০১৪ সালে সিদ্ধিরগঞ্জে দুইটি সোনার দোকানে ডাকাতি করে ৪৫৫ ভরি সোনা ও ২ লাখ টাকা লুট করে। পরবর্তীতে র‌্যাবের অভিযানে তারা ৩ জন গ্রেফতার হয় এবং কারাভোগ করে।

গ্রেফতারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানায় যে, তারা ২০২০ সালে এই চক্র ডেমরার হাজী হোসেন প্লাজায় একটি সোনার দোকানে ডাকাতি করে ২৩০ ভরি সোনা ও দেড় লাখ টাকা লুট করে।

এই অপরাধচক্রের দলনেতা রাজা মিয়া এর আগে চুরি ও ডাকাতির দুটি মামলায় কারাভোগ করেছে। গ্রেফতার আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

 

 

মন্তব্য

Beta version