অপরাধের হটস্পট হয়ে উঠেছে রাজধানীর গুলিস্তান এলাকা। সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত ছিনতাইকারীর দখলে চলে যায় পুরো এলাকাটি। রাত গভীর হলে যানবাহন ও মানুষের সমাগম কমে গেলে ছিনতাইকারীরা আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে পড়ে। এ সময় রিকশা ও পায়ে হেঁটে চলাচলকারীদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এ এলাকা। দেশীয় অস্ত্রধারী ও দলবদ্ধ এসব ছিনতাইকারীদের সঙ্গে যুদ্ধ করাও কঠিন। একটু বলপ্রয়োগ করতে গেলে প্রাণ হারানোর ভয় থাকে। ছিনতাইকারীরর ছুরিকাঘাতে প্রায়ই মারাত্মকভাবে আহত ও হতাহতের মতো ঘটনা ঘটছে। এসব অপরাধী চক্রের সদস্যদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না পুলিশ-সাংবাদিকও। প্রতিদিনই গুলিস্তান এলাকায় ছিনতাইকারী, অজ্ঞানপার্টি ও পকেটমারের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। শুধু তাই নয়, ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে পুলিশসহ অনেকেই মারাত্মক জখম হয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তুলনামূলক কম টহল টিম, ভুক্তভোগীদের মামলা না করা, জামিনে মুক্ত হওয়া ছিনতাইকারীদের নজরদারিতে না রাখার কারণে ঢাকায় ছিনতাই কমছে না। কারণ ঢাকার আয়তনের তুলনায় টহল ব্যবস্থা ও চেকপোস্ট ততটা জোরদার নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীরা মামলা না করে ঝক্কিঝামেলা এড়াতে শুধু জিনিসপত্র হারানোর জিডি করেন। মামলা না হওয়ার কারণে পুলিশ, র্যাব ও ডিবি পুলিশের সদস্যরা আসামি গ্রেপ্তার করেন না। ডিএমপির একটি সূত্র বলেছে, ছিনতাই প্রতিরোধে এলাকাভিত্তিক টহল জোরদারসহ বেশকিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে এসব নির্দেশনার পরও প্রায় সব এলাকার চিত্র আগের মতোই। নিয়মিত টহলের পরিবর্তে আগের মতোই দায়সারা দায়িত্ব পালন করতে দেখা যাচ্ছে।
গুলিস্তান এলাকায় পকেটমারের অভাব নেই। এমন কোনো লোক নেই, গুলিস্তান গেছেন আর পকেটমারের শিকার হয়নি। গুলিস্তানের পকেটমারের টাকার টাকা তিন ভাগ হয়। গুলিস্তানের একজন পকেটমারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একজন পকেটমার সারাক্ষণ নেশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকে। নেশার টাকা জোগাড় করতেই সাধারণ মানুষের পকেট মারতে হয়। খুব সুন্দর করে দুই আঙুল পকেটে ভরে দিয়ে মোবাইল-ম্যানিব্যাগ নিয়ে নেয়। বেশিরভাগ সময়ই কেউ ধরতে পারে না। আর ধরতে পারলেও জনগণ মারধর করে কিন্তু টের পায় না, নেশার কারণে। তাছাড়া আমাদের মারার আগেই এলাকার বড় ভাইরা তাদের বাঁচিয়ে নেয়, এজন্য অবশ্য তাদের ভাগ দিতে হয়।
সূত্র জানায়, গত ২২ মার্চ গুলিস্তানে ছুরিকাঘাতে শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক জাহাঙ্গীর হোসেন (৪৮) আহত হন। রাত ৯টার দিকে গোলাপ শাহ মাজার ও টিঅ্যান্ডটি অফিসের পাশের ফুটপাতে ঘটনাটি ঘটে। আহত পুলিশ সদস্য জাহাঙ্গীর জানান, পুরান ঢাকার সিএমএম কোর্টে মামলাসংক্রান্ত কাজ শেষে বাসে ফিরছিলেন। তিনি গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজার এলাকায় বাস থেকে নামেন। হেঁটে এগোনোর সময় পেছন থেকে এক যুবক তার পিঠে ছুরি মেরে পালিয়ে যান। যুবকটির পরনে জামা বা পায়ে জুতা ছিল না, শুধু লুঙ্গি ছিল। হামলাকারী এ পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে টাকা-পয়সা বা মুঠোফোন নেয়নি। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন আবু সাঈদ হাসান নামের এক পথচারী। হামলাকারী যুবকের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছর হতে পারে বলে জানান তিনি। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে শাহবাগ থানার পরিদর্শক (অপারেশন) মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘যে যুবক তাকে ছুরিকাঘাত করেছে, সে পাগল বা নেশাগ্রস্ত বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেন সে এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা তদন্তের পর বলা যাবে।’
এদিকে গত ২৩ মার্চ রাতে গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া এলাকায় থেকে ইমন ও জুয়েল নামে দুই ছিনতাইকারীকে পুলিশ হাতেনাতে ধরে ফেলে। পরে তাদের বংশাল থানার সামনে নিয়ে আসা হয়। থানার সামনে গাড়ি থেকে নামিয়ে তাদের চেক করার সময় হঠাৎ ছিনতাইকারী ইমন পকেটে থাকা সুইচ গিয়ার চাকু বের করে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে। এতে পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন। এরা হলেনÑ এসআই এম রবি হাসান, এএসআই তাজুল ইসলাম, কনস্টেবল নজরুল, সজীব ও শফিকুল। বংশাল থানার ওসি আবুল খায়ের জানান, গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া এলাকায় ইমন ও জুয়েল নামে দুই ছিনতাইকারীকে হাতেনাতে ধরে পুলিশ। পরে তাদের থানার গাড়িতে বংশাল থানার সামনে নিয়ে আসা হয়। থানার প্রবেশপথে গাড়ি থেকে নামিয়ে শরীর তল্লাশি করার সময় হঠাৎ ছিনতাইকারী ইমন সুইচ গিয়ার চাকু বের করে পাঁচ পুলিশকে এলোপাতাড়ি আঘাত করে। এতে পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন।
গত ১৮ মার্চ সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে বৃহস্পতিবার ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে আহত হয়েছেন সাংবাদিক কামাল হোসেন তালুকদার। ছিনতাইকারীর ধাক্কায় পাশের একটি গাড়িতে পড়ে আহত হন তিনি। ঠোঁট কেটে যাওয়ায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে সেলাই নিতে হয়েছে তাকে। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। আহত সাংবাদিক কামাল হোসেন তালুকদারের স্ত্রী শাহনাজ পারভীন বলেন, ওইদিন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির আয়োজনে মুন্সীগঞ্জে ‘ফ্যামিলি ডে’ ছিল। সেই অনুষ্ঠান থেকে বাসে ঢাকায় ফেরার পর গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের অফিসের সামনে নেমে যাই। সেখান থেকে আজিমপুরের যাওয়ার জন্য রিকশায় উঠতে যাব, এমন সময়ে পেছন থেকে দ্রুত গতিতে এক লোক দৌড়ে এসে তাকে জোরে ধাক্কা দেয়। তিনি সামলাতে না পেরে দু-তিন পাক ঘুরে একটি মাইক্রোবাসের সঙ্গে ধাক্কা খান। ধাক্কা খেয়ে তার ঠোঁট অনেকখানি কেটে যায় এবং প্রচুর রক্তপাত হয়। কামালের হাতে তখন ব্যাগ ও মোবাইল ফোন ছিল জানিয়ে শাহনাজ বলেন, তা ছিনিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই হামলা করে। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো কিছুই নিতে পারেনি। তার চিৎকারে লোকজন জড়ো হয়ে যাওয়ায় ধাক্কা দেওয়া লোকটা খুব দ্রুতগতিতে পালিয়ে যায়।
এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজারসংলগ্ন টেম্পো স্ট্যান্ডের সামনে ট্রাভেল এজেন্টকে মারধর করে ৩৫ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগ করা হয়েছে। আহত ব্যাবসায়ী শহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, বংশালে তার বন্ধু রানার কাছ থেকে ৩৫ লাখ টাকা একটি ব্যাগে করে রিকশাযোগে মতিঝিল যাওয়ার পথে গুলিস্তান টেলিফোন ভবনের সামনের টেম্পো স্টেশনে রিকশাটিকে গতিরোধ করে তাকে মারধর করে রক্তাক্ত জখম করে তার কাছ থেকে টাকার ব্যাগটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, ওই ব্যাগটিতে ৩৫ লাখ টাকা ছিল। মতিঝিলের সিটি ব্যাংক প্রিন্সিপাল ব্রাঞ্চে জমা করতে চেয়েছিলেন। পথিমধ্যে ছিনতাইকারীরা তা নিয়ে গেছে।
অন্যদিকে গত ৩ মার্চ গুলিস্তানে অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়ে মো. রফিক নামে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের এক সদস্য সর্বস্ব খুইয়েছেন। অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ল্যাডার আনোয়ার পারভেজ বলেন, রফিক ডেমরা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের গাড়ি চালক। ৩ মার্চ দুপুরে তিনি গুলিস্তানে বাসে অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়েন। পরে আমরা খবর পেয়ে গুলিস্তান আহাদ পুলিশ বক্স থেকে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই। পাকস্থলী ওয়াশ দিয়ে তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে রেফার্ড করেছেন চিকিৎসক। তিনি আরো বলেন, আমরা তার কাছে মোবাইল ফোন পাইনি। প্রতারক চক্র তার কাছ থেকে কী কী নিয়ে গেছে জ্ঞান ফিরলে সেটা জানতে পারব। বিষয়টি নিশ্চিত করে ঢামেক হাসপাতালে পুলিশ ক্যাম্পের ওসি বাচ্চু মিয়া বলেন, ফায়ার সার্ভিসের এক গাড়ি চালককে অচেতন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়েছে। তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা জানান, তিনি অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়েছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিনিয়তই বিচ্ছিন্নভাবে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ছেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। এসব ঘটনায় দেখা যায়, ছিনতাইকারীরা আগের তুলনায় বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। পথে কিংবা বাসের জানালা দিয়ে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে তাদের জিনিসপত্র। রিকশায় যাতায়াতের সময় মোটরসাইকেল থেকে ছোঁ মেরে নগদ টাকা, মোবাইল ফোন ও জিনিসপত্রসহ ব্যাগ নিয়ে যাওয়ার ঘটনা কম ঘটছে না। এতে আহত এবং নিহতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কিন্তু এভাবে কী পরিমাণ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে, তার সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে জানা যাচ্ছে যারা মামলা করতে যাচ্ছেন তাদের মামলা নেওয়া হচ্ছে না, আবার মামলা নেওয়া হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে চুরির মামলা নেওয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অধিকাংশ ভুক্তভোগীই পুলিশের দ্বারস্থ হচ্ছেন না। ডিএমপির এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ২০২১ সালে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ঢাকা মহানগরীতে মামলা হয় ১৪৫টি, ২০২০ সালে ১৭৬, ২০১৯ সালে ১৫৫, ২০১৮ সালে ২১৬, ২০১৭ সালে ১০৩, ২০১৬ সালে ১৩২, ২০১৫ সালে ২০৫ ও ২০১৪ সালে ২৬৫টি মামলা হয়।
৯৯৯-এর তথ্যে দেখা যায়, আগের তুলনায় গত কয়েক মাসে ছিনতাইয়ের শিকার ভুক্তভোগীদের কলের পরিমাণ বাড়ছে। এর মধ্যে রাজধানীতে গত ডিসেম্বরে ১১২টি, এরপর কিছুটা বেড়ে জানুয়ারিতে ১৩৪, ফেব্রুয়ারিতে ১২৮ এবং মার্চের ১২ তারিখ পর্যন্ত ৬৬টি কল এসেছে। তবে সারা দেশের তুলনায় ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে বলে ধারণা করা যাচ্ছে ৯৯৯-এর তথ্যে। এতে দেখা যায়, ডিসেম্বর ১৬১টি কলের ১১২টি ছিল রাজধানীর এবং জানুয়ারিতে ২০৭ ও ফেব্রুয়ারিতে ২১৮টি কল ছিল সারা দেশের। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর গণমাধ্যম কর্মকর্তা ওসি আনোয়ার সাত্তার বলেন, আমাদের কাছে নিয়মিতই ছিনতাইয়ের শিকার ভুক্তভোগীদের কল আসছে। এটি শুধু ছিনতাই বেড়ে যাওয়াকেই ইঙ্গিত করছে না, ৯৯৯-এর প্রতিও যে আস্থা বাড়ছে এজন্য বেশি কল পাচ্ছি। কলের পর স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ করিয়ে দিই। তবে অনেকেই সকালের ছিনতাইয়ের ঘটনায় সাহায্য চান বিকেলে, এমন কলেও তাদের থানার ডিউটি অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছি আইনগত সাহায্য পাওয়ার জন্য।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার আব্দুল আহাদ ভোরের আকাশকে বলেন, গুলিস্তান এলাকায় ছিনতাইসহ অপরাধীদের দৌরাত্ম্য কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। থানার টহল জোরদার ছাড়াও পুলিশের অন্য ইউনিটগুলোও কাজ করছে। এছাড়া ভুক্তভোগীদের মামলা নেওয়ার জন্য থানাগুলোকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ছিনতাইয়ের অধিকাংশ ভুক্তভোগীই মামলা করতে আসেন না। ফলে সব ঘটনায় আমরা অবগত হয়ে ব্যবস্থা নিতে পারছি না। এদিকে মাসিক অপরাধ সভায় ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম চুরি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে অপরাধীদের তালিকা তৈরি করে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, শুধু পাহারা দিয়ে অপরাধ দমন করা যায় না, অপরাধীদের শনাক্ত করে তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনে অপরাধ প্রতিরোধ করতে হবে, এটাই আসল পদ্ধতি। ঈদকে ঘিরে বিপণিবিতানগুলোয় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশনা দিয়েছেন কমিশনার।
মন্তব্য