-->

বছরের পর বছর সৎকার হয় না লাশের

রুদ্র মিজান
বছরের পর বছর সৎকার হয় না লাশের
প্রতীকী ছবি

বছরের পর বছর লাশ পড়ে আছে হিমঘরে। মৃত্যুর পর ধর্মীয় নিয়মে সৎকার করার কথা। কিন্তু ব্যতিক্রম ঘটেছে এই লাশগুলোর ক্ষেত্রে। সৎকার করা হচ্ছে না। ধর্মীয় পরিচয় এবং আইনি জটিলতার কারণে তিন জনের লাশ পড়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে। এর মধ্যে দুজনই বিদেশি। একজন মার্কিন নাগরিক, অপরজন দক্ষিণ আফ্রিকার। আরো একজনের লাশ পড়ে রয়েছে দীর্ঘ আট বছর ধরে। তিনি খোকন নন্দী ওরফে খোকন চৌধুরী।

২০১৪ সালের ২৬ জুন বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান খোকন নন্দী ওরফে খোকন চৌধুরী। তিনি একজন ব্যবসায়ী। ঢাকার ফার্মগেটে মার্কেট, বাড়িসহ বিপুল সম্পত্তির মালিক ছিলেন তিনি। তার লাশের দাবিদার দুই স্ত্রী। একজন হিন্দু অন্যজন মুসলিম। মিরা নন্দী ও হাবিবা আক্তার বাবলি। বাবলির দাবি তাকে বিয়ে করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন খোকন। কিন্তু মিরা নন্দীর দাবি সনাতন ধর্ম বিশ্বাসে থেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন তিনি। বিষয়টি গড়িয়েছে আদালতে। রাজধানীর উত্তর শাহজাহানপুরে দ্বিতীয় স্ত্রী বাবলিকে নিয়ে থাকতেন খোকন। মাঝেমধ্যে মসজিদে নামাজেও যেতেন। অন্যদিকে প্রথম স্ত্রী মিরা নন্দীর দাবি রায়েরবাগের বাসায় তার সঙ্গেও থাকতেন খোকন। সনাতন ধর্মের সব আচার-অনুষ্ঠানও পালন করতেন।

বারডেম হাসপাতালে তার মৃত্যুর পর লাশ নিয়ে শুরু হয় টানটানি। হাসপাতালে এসময় তার সঙ্গে ছিলেন বাবলি। তিনি লাশ নিয়ে যেতে চাইলে বাধা দেন মিরা ও তার দুই সন্তান বাবলু এবং চন্দনা। বিষয়টি আদালতে গড়ালে এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি। ১৯৮৪ সালের ২ জুলাই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্রী বাবলিকে বিয়ে করেন খোকন। এর আগে হাবিবুর রহমান নামে প্রথম শ্রেণির একজন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এফিডেভিট করে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন তিনি। এ-সংক্রান্ত প্রমাণ রয়েছে বাবলির কাছে। অন্যদিকে, এসব কাগজপত্রকে ভুয়া বলে দাবি করেন মিরা নন্দী। এই জিটলতায় আট বছর ধরে হিমঘরে পড়ে আছে খোকনের লাশ। তিনি হিন্দু না মুসলিম, এই প্রশ্নের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সৎকার হচ্ছে না মৃতদেহের।

থিইসিয়া সিকেওয়েস্ট। দক্ষিণ আফ্রিকার ছাব্বিশ বছর বয়সি তরুণী। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের দেবীপুরের হাসানুজ্জামান রিপনকে। ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে মৃত্যু ঘটে তার। মাত্র কয়েক মাস আগে দেশে এসেছিলেন তিনি। জানা গেছে, হাসানুজ্জামান রিপন থাকতেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানেই পরিচয় থিইসিয়ার সঙ্গে। পরবর্তীতে বিয়ে করেন তাকে। বাংলাদেশে আসার পর জানতে পারেন রিপন আগেও বিয়ে করেছেন। তার স্ত্রী, সন্তান রয়েছে। এর মধ্যেই রিপনের সংসার করছিলেন থিইসিয়া। নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় তিশা জামান। স্থানীয়রা জানান, দু-তিন মাস যেতে না যেতেই মৃত্যু ঘটে থিইসিয়ার। চৌদ্দগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শুভ রঞ্জন চাকমা জানান, থিইসিয়া আত্মহত্যা করেন। এ বিষয়ে একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। তার লাশটি এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে পড়ে রয়েছে। লাশ নিতে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করায় জটিলতা রয়ে গেছে বলে জানান তিনি। তবে পারিবারিক কলহের কারণেই থিইসিয়া আত্মহত্যা করেন বলে স্থানীয়রা জানান।

২০১৮ সালের ২৫ মে ঢাকায় মারা যান আটাত্তর বছর বয়সি মার্কিন নাগরিক রবার্ট মায়রন বার্কার। বছরের পর বছর কেটে গেলেও এই মার্কিন নাগরিকের লাশের সৎকার হয়নি। রবার্ট মায়রন বার্কারের ভিসার বিবরণ অনুসারে তিনি আনপেইড বা অবনৈতিক র্কমর্কতা। দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশে আসা-যাওয়া ছিল তার। ২০১৪ সালে মাজেদা বেগম নামে বাংলাদেশি এক নারীকে বিয়ে করেন তিনি। মাজেদা সাংবাদিকদের জানান, তিনি উত্তরা কমিউনিটি হাসপাতালে আয়া পদে চাকরি করতেন। ওই সময়ে বার্কারের সঙ্গে পরিচয়। তা প্রায় ১১ বছর আগের কথা। ওই হাসপাতালে রোগী হিসেবে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন রবার্ট। তাকে দেখাশোনা করার মতো কেউ না থাকায় আয়া মাজেদা তার সেবা করেন। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

২০১৪ সালের ১ এপ্রিল খ্রিষ্টান ধর্মানুসারে বাড্ডার একটি চার্চে মাজেদাকে বিয়ে করেন বার্কার। বিয়ের পর থেকে দক্ষিণখানের ৭৩৯/২ চালাবন (মাটির মসজিদ) এলাকার একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন এই দম্পতি। রবার্ট একজন উন্নয়ন কর্মকর্তা জানলেও কোন সংস্থায় তিনি কাজ করতেন জানাতে পারননি মাজেদা। মাজেদার এটি দ্বিতীয় বিয়ে। তার প্রথম সংসারের দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্ত্রী ও এক মেয়ে এবং এক ছেলে রয়েছে বার্কারের। মাজেদাকে বিয়ের পর কয়েকবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন তিনি। মাজেদা জানিয়েছেন, বার্কারের মৃত্যুর পর মার্কিন দূতাবাসে তা জানানো হয়েছে। তারা পাসপোর্ট নিয়েছে। কিন্তু বার্কারের লাশের কোনো সুরাহা হয়নি। এখন পর্যন্ত বার্কারের কোনো স্বজন যোগাযোগ করেনি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ মাকসুদ বলেন, নানা কারণে দীর্ঘদিন ধরে লাশগুলো মর্গে পড়ে আছে। এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

মন্তব্য

Beta version