-->

গাঁজা পাওয়া যায় হোম ডেলিভারিতে

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ
গাঁজা পাওয়া যায় হোম ডেলিভারিতে
প্রতীকী ছবি

রাজধানীর কারওয়ানবাজারে যেখানে আগে প্রজাপতি গুহা ছিল তার পাশে বহুজাতিক কোম্পানি বাটার শোরুম। পাশেই খোলা ফুটপাত। সারা দিন লোকে লোকারণ্য থাকে ফুটপাতটি।

সন্ধ্যার পরপরই ভিড় কমতে থাকে। চিত্র বদলে যায়। বাড়ে ভাসমান মানুষের আনাগোনা। ভেসে আসে উৎকট গন্ধ। সহজে বোঝা যায় আশপাশে কেউ গাজা সেবন করছে। দেখা মেলে গাঁজা বিক্রেতার।

ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে সংকেত দেন মামা লাগবে? যে বোঝার সে বুঝে যায়। চটপট কিনে নিয়ে চম্পট দেয়। যারা বুঝে না, তারা ভয় পায়, বিব্রত হয়। কোনো করম পালিয়ে বাঁচে।একই অবস্থা পান্থকুঞ্জের। রাত হলেই ভাসমান মানুষের ভিড় বাড়ে। প্রধান সড়কের পাশেই কিছু মানুষ দেখা যায়। এসব লোক দেখলে যে কেউ ভেবে নেবেন এরা প্রতিবন্দি কিংবা পাগল। দিনেও এদের দেখা মেলে।

এরাই সুযোগ বুঝে পথচারীদের গাঁজা বা মাদক কেনার প্রস্তাব দেন। উঠতি বয়সি কিশোর-যুবক বা শ্রমজীবী মানুষেরই এদের প্রধান লক্ষ্য। এদের কেউ কেউ বেপরোয়া।

ফুটপাতে বসেই গাঁজা সেবন করে। দ্রুত সে গন্ধ বাতাসে ছড়ায়। এতে বেকায়দায় পড়েন পথচারীসহ নারী ও শিশুরা। বাড়তে থাকে স্বাস্থ্যঝুঁকি।

এদিকে রাজধানীর পল্টন, শাহবাগ, মৎস্য ভবন মোড়, কাকরাইল মোড় দিয়ে রমনা পার্কের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেই গাঁজার উৎকট গন্ধ নাকে আসে। আশপাশেই পাওয়া যায় বিক্রেতাদের।

জানা যায়, কমলাপুর বিশ্বাস টাওয়ারের সামনে গাঁজা বিক্রির বিশাল স্পট, সূত্র জানায় এটা মতিঝিল, খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ীর মধ্যে বড় স্পট। একইভাবে, খিলগাঁও রেলগেট, মানিকনগর ওয়াসা রোড ব্রিজ, শাহজানপুর রেলওয়ে কলোনি, খিলগাঁও জোড় পুকুরের মাঠের পাশে, মৌচাক, মোহাম্মদুর, নাখালপাড়া, মীরপুরের বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যেই গাঁজা বিক্রি হয়। এসব স্থানে প্রতিদিন ভোর থেকে শুরু হয়ে এ বাজার সকাল ১০টার আগেই শেষ হয়ে যায়। আবার বিকাল থেকে শুরু হয়ে চলে গভীর রাত পর্যন্ত। এ এলাকায় মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বহু মানুষ।

যাদের অনেকেই নারী। মাদক ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে ভিন্নতা। সকালের ক্রেতা সাধারণত ত্রিশোর্ধ্ব ব্যক্তিরা আর বিকালের ক্রেতাদের অধিকাংশ ছাত্র-যুবক, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে।তথ্যমতে এসব স্থানে ১০০ টাকায় পাওয়া যায় গাঁজার পোটলা। এরপর পরিমাণ বুঝে ধাপে ধাপে দর বাড়তে থাকে। তবে ১০০ টাকার ক্রেতাই বেশি। শ্রমিক ও উঠতি বয়সি কিশোর তরুণরাই এক/দুবার সেবন করার জন্য এই পোটলা সংগ্রহ করে থাকেন।

কেউ কেউ আবার একসঙ্গে বেশি করে সংগ্রহ করে রাখতে পছন্দ করেন। সাধারণত তাদের ২৫ গ্রাম করে কিনতে দেখা যায়। এই ক্রেতাদের ২৫ গ্রাম গাঁজা সংগ্রহ করতে খরচ করতে হয় এক হাজার থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত।

গাঁজা ক্রেতা-বিক্রেতাদের লেনদেনের ধরনও আলাদা। চলন্ত রিকশা, মোটরবাইক বা সিএনজি চালকরা চলন্ত অবস্থায় সংগ্রহ করেন এই মাদক। তারা টাকা হাতে রাখে অন্যদিকে বিক্রেতা রেডি রাখে পোটলা। ফলে সেকেন্ডের মধ্যেই বিক্রেতার হাতে টাকা এবং ক্রেতার কাছে পোটলা চলে যায়।

আবার হোম ডেলিভারির মাধ্যমেও গাঁজা বিক্রির তথ্য মিলেছে। গাঁজা বিক্রেতার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে এই ভয়ংকর মাদক। এই ক্ষেত্রে মূলদর ছাড়াও ক্রেতাকে গুনতে হয় সার্ভিস চার্জ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যাত্রাবাড়ী এলাকার এক বাসিন্দা জানান, গাঁজার হোম ডেলিভারি শুরু হয়েছে লকডাউনের সময় থেকে। তখন গাঁজা বিক্রেতার বাইকে করে বাসায় বাসায় গাঁজা পৌঁছে দিয়েছেন।

বর্তমানেও এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। তবে এখন হোম ডেলিভারির ব্যবসা কিছুটা কম।

এ বিষয়ে কথা হয় পথচারী আবদুল হালিম মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, অফিসের কাজ শেষ করে বের হতে রাত হয়। যেতে হয় কারওয়ানবাজার থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত। যানজট থাকার কারণে হেঁটেই যাই।

এইটুকু পথ যেতেই গাঁজার উৎকট গন্ধে অস্বস্তিতে পড়ি। প্রায় প্রতিদিনই বাটা শোরুমের পাশের ফুটপাত এবং তেজগাঁও বালিকা বিদ্যালয়ের পাশে ওভার ব্রিজের নিজ থেকে এই গন্ধ আসে। কখনো কখনো গাঁজা কেনার অফারও পাই।

তিনি বলেন ঢাকার বাতাস তো এমনিতেই বিষ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গাঁজার গন্ধ। সবমিলে রাস্তায় চলা দায় হয়ে পড়েছে।

জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রক অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা ভোরের আকাশকে বলেন, মাদকদ্রব্য আইন ২০১৮ অনুযায়ী গাঁজা বিক্রি নিষেধ।

যারা এই কাজটি করছেন অবশ্যই অপরাধ করছেন। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা উচিত। গাঁজার গন্ধে শিশু ও নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেউ গাঁজা সেবন করলে ৫০০ মিটার দূর থেকে এর গন্ধ পাওয়া যায়। এতে যে কারো স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে।

স্বাস্থ্যবিজ্ঞান বলছে, গাঁজা সেবনের কারণে মানসিক ও শারীরিক সব ধরনের ক্ষতি হয়। সামাজিক দক্ষতা কমে যায়। দীর্ঘদিন গাঁজা খেলে এর ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি হয়। দিন দিন গাঁজা খাওয়ার মাত্রা অনেক বেড়ে যায়।

গাঁজা সেবনকারীরা ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়। কখনো অতি আনন্দে আত্মহারা থাকে। আবার কখনো মনমরা থাকে। অনেক সময় কোনো কিছু মনে রাখাতে পারে না।

অর্থহীন কথাবার্তা বলে। হাত-পা কাঁপতে থাকে। হাঁটাচলা করতে কষ্ট হয়। চোখ লাল হয়ে যায়। প্রথমদিকে খাওয়াদাওয়া বেশি করে। ধীরে ধীরে খাওয়ার রুচি একেবারে কমে যায়।

রক্তচাপ কমে যায়। বুক ধড়ফড় করে। ধীরে ধীরে সবকিছু থেকে আনন্দ হারায়। নিজেকে সব সময় গুটিয়ে রাখে। ঘুমের নিয়ম বলে কিছু থাকে না। মানসম্মান ও ব্যক্তিত্ব নষ্ট হয়। হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়।

তখন অন্যকে আঘাত করে। অনেক সময় আত্মহত্যার চেষ্টাও করে। বিনা কারণে অন্যকে সন্দেহ করে। স্বাস্থ্য ভাঙতে ভাঙতে দুর্বল হয়ে পড়ে। হৃদরোগ, ফুসফুস, লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একপর্যায়ে যৌনশক্তি নষ্ট হয়ে যায়।

জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, গাঁজা যে স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর তা সর্বজন স্বীকৃত।

গাঁজা সেবন করলে শরীরের কিডনি, লিভার, হার্ট ও ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি হয়। সুস্থ চিন্তাশক্তি কমে যায়। মস্তিষ্কে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হয়।

খাবারে অরুচি বেড়ে ওজন কমে যায়। এ ছাড়া গাঁজা সেবনের আরো নানাবিদ অপকারিতা রয়েছে।

২০১২ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, গাঁজা সেবনকারীরা ৭০ শতাংশ সময় সঠিকভাবে বুঝতে পারেন না। ১৯৯৮ সালের আরেকটি গবেষণায় বলা হয়, গাঁজা মস্তিষ্কের সেরেবেলাম অংশে রক্ত চলাচলে প্রভাববিস্তার করে।

এমআরআই পরীক্ষায় দেখা গেছে, এতে সময়জ্ঞান কাজ করে না। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বলা হয়নি যে, গাঁজা বিষন্নতা আনে বা বিষন্ন মানুষ গাঁজায় আসক্ত হয়। তবে

নেদারল্যান্ডসের এক গবেষণায় বলা হয়, যারা বিষন্নতায় ভোগেন, গাঁজা তাদের এ সমস্যা আরো বৃদ্ধি করতে পারে।

গাঁজার নেশা থেকে মুক্তি পেতে সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা। কেউ যাতে গাঁজা খেতে না পারে, সে জন্য পরিবারে অভিভাবকদের সচেতন থাকতে হবে। বাংলাদেশে গাঁজা সহজলভ্য, এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, কখন ফিরছে, এসব ব্যাপারে মা-বাবাকে খোঁজখবর রাখতে হবে।

সন্তানকে গুণগত সময় বা কোয়ালিটি টাইম দিতে হবে। সন্তানের বন্ধু হতে হবে। তার সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে হবে। বন্ধু হয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে।

ক্ষতিকর দিকগুলো ভালোভাবে বোঝাতে হবে। যদি কারো মধ্যে হঠাৎ করে আচরণের পরিবর্তন দেখা যায় যেমন রাত জাগে, দিনে ঘুমায়।

কারণে-অকারণে মিথ্যা কথা বলে। ঠিকমতো স্কুলে যায় না, দেরি করে বাড়ি ফেরে, নতুন বন্ধুবান্ধব তৈরি হয়। অকারণে টাকা চায়। খারাপ আচরণ করে। এসব লক্ষণ দেখা দিলে তাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিতে হবে।

মন্তব্য

Beta version