-->
শিরোনাম

দিনে টোকাই, রাতে ভয়ংকর!

* ছিনতাইয়ে বাধা দিলেই অঘটন * দলে রয়েছে একাধিক সদস্য * মাদকাসক্ত হয়ে রাস্তায়ই মারা যায় * যৌন নির্যাতনের শিকার হন মেয়েরা

ইদ্রিস আলম
দিনে টোকাই, রাতে ভয়ংকর!
প্রতীকী ছবি

রাজধানীর কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলস্টেশনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি ছিনতাইকারী চক্র। ওরা আগেও ছিল। কিন্তু ঈদ সামনে রেখে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চক্রটি। সময় সুযোগ বুঝে যাত্রীদের ব্যাগ, মোবাইল ও গুরুত্বপূর্ণ মালামাল ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ওরা দিনে টোকাই বেশে ঘুরে বেড়ায়। রাত হলেই হয়ে ওঠে ভয়ংকর।

সরেজমিন রাজধানীর কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলস্টেশন ঘুরে জানা যায় ছিনতাইকারীদের কৌশল সম্পর্কে। ছিনতাইয়ের সময় বাধা দিলেই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। তাদের কাছে রাখা হয় ব্লেট ও টিপ চাকু। দলে থাকে ১৫-২০ সদস্য। ছিনতাই করে পালিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়েও মারা যাওয়ার ঘটনাও রয়েছে। এমনই একটি ঘটনা ঘটে ২০২০ সালে। ঘড়ির কাঁটায় রাত সাড়ে ১২টা। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে টোকাইরা। হঠাৎ বিকট শব্দ। দৌড়ে গিয়ে দেখে মারুফ ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা গেছে।

চোখের সামনে বন্ধুর ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাটি জানতে চাইলে ভোরের আকাশকে রমজান জানান, ‘আমরা বিমানবন্দর রেলস্টেশন দিনে বোতল টোকাই। রাত হলে চুরি-ছিনতাই করি। সেদিন রাস্তার পাশে প্রতিদিনের মতো চুরির প্ল্যান করছিলাম। হঠাৎ মারুফ দৌড় দিয়ে একটি মুরগি বহনকারী পিকআপে ওঠে। পরে নামতে গিয়ে পেছনে পড়ে যায়। ঠিক সেসময় পেছন থেকে আসা একটি ট্রাক পিষে দিয়ে চলে যায়।’

এছাড়া অপরাধী চক্রগুলো এদের মাদকসহ নানা অবৈধ ব্যবসায় কাজে লাগায়। এরা আসলে অপরাধী নয়। এরা অপরাধের শিকার হয়।

কমলাপুর স্টেশনের প্ল্যাটফরম থেকে শাহজাহানপুরের দিকে যেতে পুরোনো ট্রেনের বগির সামনে অনেকের জটলা। তাদের দেখেই বোঝা যায় তারা স্বাভাবিক নয়। ধোঁয়া উড়ছে। গাঁজার গন্ধে একাকার। রমজান মাসেও তাদের নেই কোনো ধ্যান-জ্ঞান।

মূলত এরাই এ ছিনতাইকারী দলের সদস্য। কিছুটা সময়ক্ষেপণ করার চেষ্টা করে তারা। কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে তাদের আলাপচারিতার একপর্যায়ে শোনা যায়, কে কত টাকা পেয়েছিস। সঙ্গে সঙ্গে তিনজন পকেট থেকে তিনটি মোবাইল আর ম্যানিব্যাগ বের করে একজনের কাছে দিল। যার হাতে দিল, সে তাদের বয়সে বড়। তাকে কেউ ভাই কেউ বস বলে সম্বোধন করছে। টিম লিডারকে রাজু ভাই নামে ডাকতে শোনা যায়। রাজু বলে, ‘সামনে ঈদ। বেশি বেশি কাজ করতে হবে। পুলিশ যেন না ধরে, সেই দিকে খেয়াল রেখে কাজ করবি। ধরা পড়লে কিন্তু সমস্যা কইলাম। খুব কৌশল করে কাজ করতে হবে।’

ভোরের আকাশের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে তাদের টোকাই থেকে ছিনতাইকারী হয়ে ওঠার গল্প। জানা যায়, সারা দিন যেসব টোকাইবেশের শিশুরা বোতল পলিথিন খুঁজে বেড়াই, তারাই মূলত সন্ধ্যার পর জড়িয়ে পড়ে চুরি ছিনতাই থেকে শুরু করে নানারকম অপরাধের সঙ্গে। ধীরে ধীরে হয়ে যায় বড় ধরনের অপরাধী। রাজুর জন্ম কমলাপুর স্টেশনে। বেড়ে ওঠা ও এটাই তার ঘরবাড়ি। একসময় বোতল টোকাইতে টোকাইতেই আজ সে ছিনতাইকারী দলের লিডার। তার বাবা-মায়ের পরিচয় জানে না। এখন তার একটি টোকাই গ্যাং রয়েছে। তাদের দিয়ে মূলত স্টেশন এলাকাই অপরাধের কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে থাকে।

বিমানবন্দর রেলস্টেশনে মোবাইল চুরির ভুক্তভোগী লিটন বলেন, ‘ট্রেনে করে রংপুর যাওয়ার জন্য গেটে ওঠার সময় গেটের সামনে অনেক জটলা। উঠে সিটে গিয়ে দেখি, আমার মোবাইল নেই। বুঝতে পারলাম, তাহলে সে চুরির উদ্দেশে এমন করছিলেন।’

একাধিক ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানায়, ছিনতাইয়ের আগে থেকে অনেক যাত্রীকে নজরদারিতে রাখেন ছিনতাইকারী সদস্যরা। বেশিরভাগ দামি মোবাইল ব্যবহারকারীরা তাদের টার্গেট। ঠিক ট্রেনে ওঠার সময় গেটের সামনে কিছু মানুষকে দেখাযায় অযথাই ভির করতে। সেই সময় সুযোগমতো পকেট থেকে মানিব্যাগ ও মোবাইল চুরি করে নিয়ে যান।

বিমানবন্দর এলাকার লিডার সনি বলে, ‘ভাই আমগো কোনো কাম-কাজ দিবার চায় না কেউ। তাই হারাদিন স্টেশনে বোতল টোকাই বিক্রি করে খাবার কিনি। অল্প টাকা দিইয়্যা কিচু হয় না। তাই রাত হইলে এই ভাবে মুরগি, মাছ, কাঁচামাল চুরি কইরা বিক্রি কইরা ঐ টাকা দিইয়া নেশা করি আবার খাবার খাই।’

বিমানবন্দরের পাশের মার্কেটের একজন নাইটগার্ড নুরুজ্জামান বলেন, ‘আমি মাঝে মাঝে তাদের দৌড়ানি দিই- যাতে করে ভয় পেয়ে চলে যায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘একদিন এমন চলন্ত গাড়ি থেকে চুরি করতে গিয়ে গাড়ির নিচে পড়ে মারুফ নামে এক শিশুর মৃত্যু ও হয়। মাঝে মাঝে এমন ঘটনা ঘটে এখানে। আসলে তাদের তো মা-বাবা নেই শাসন করারও কেউ নেই।’

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পথশিশুদের ৫১ ভাগ ‘অশ্লীল কথার শিকার’ হয়। শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ২০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয় মেয়েশিশু। ১৪.৫ শতাংশ পথশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। আর মেয়ে পথশিশুদের মধ্যে ৪৬ ভাগ যৌন নির্যাতনের শিকার।

শিশুদের নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থার তথ্য মতে, পথশিশুদের কেউ কেউ মাদকাসক্ত হয়ে রাস্তায়ই মারা যায়। কেউ কেউ বিভিন্ন চক্রের মাধ্যমে পাচার হয়ে যায়। যারা পাচারের শিকার হয়, তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি হয়। নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় তারা। যারা মেয়ে, তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। কোনো কোনো গ্যাং তাদের যৌনকর্মী হতে বাধ্য করে।

এ বিষয়ে বিমানবন্দর রেলস্টেশনে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষরা বলছেন, ‘আমরা যথেষ্ট নিরাপত্তার মধ্যে এনেছি। আগে আরো বেশি ছিল। আর রাতে যারা রাস্তায় গিয়ে ছিনতাই করে, সে ব্যাপারে তো আমরা বলতে পারি না। স্টেশন এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা নেই বললেই চলে।’

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের সভাপতি ইমরানুল হক চৌধুরী জানান, ‘ঢাকা শহরে অনেক বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ আছে এ পথশিশুদের জন্য। সরকারি কিছু উদ্যোগও আছে। কিন্তু এর কোনো উদ্যোগই টেকসই নয়। আসলে তাদের দরকার স্থায়ী পুনর্বাসন। ফ্যামিলি অ্যাটাচমেন্ট। সেটা কীভাবে করা যায়, তা সরকারকে ভাবতে হবে।’

মন্তব্য

Beta version