-->
শিরোনাম

স্বর্ণ চোরাচালানে শক্তিশালী ৩০ সিন্ডিকেট

#৭টি বিদেশি, শাহজালালকে ঘিরে ১১টি #জড়িত বাংলাদেশ বিমানের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী #উদ্ধার হওয়া ৭৩ ভাগই বহন করা হয়েছে বাংলাদেশ বিমানে

রুদ্র মিজান
স্বর্ণ চোরাচালানে শক্তিশালী ৩০ সিন্ডিকেট

কিছুতেই থামছে না স্বর্ণ চোরাচালান। নানা কৌশলে অবৈধভাবে দেশে আনা হচ্ছে স্বর্ণ। অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশকে স্বর্ণ চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে জড়িত দেশি-বিদেশি শক্তিশালী ৩০ সিন্ডিকেট। এর মধ্যে সাতটি সিন্ডিকেটে জড়িত বিদেশিরা। দেশের বাইরে থেকে সিন্ডিকেটগুলো পরিচালনা করেন আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্রের হোতারা। দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে এতে জড়িত রয়েছেন বাংলাদেশ বিমানের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। উদ্ধার হওয়া স্বর্ণের ৭৩ ভাগই বাংলাদেশ বিমানে বহন করা হয়েছে।

গোয়েন্দা তথ্যানুসারে দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে ৩০টি সিন্ডিকেট স্বর্ণ পাচার করে থাকে। এর মধ্যে সাতটি বিদেশি সিন্ডিকেট রয়েছে। দেশের ২৩টি সিন্ডিকেটের মধ্যে ১১টি সরাসরি আর ১২টি মানি এক্সচেঞ্জের আড়ালে। সরাসরি স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত ১১টি দেশি সিন্ডিকেটের মধ্যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘিরেই রয়েছে সাতটি। বাকি চারটির মধ্যে তিনটি চট্টগ্রামের শাহআমানত বিমানবন্দর ও একটি রয়েছে সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরকে ঘিরে ।

স্বর্ণ পাচার নিয়ে গোয়েন্দার সংস্থার এই প্রতিবেদনটি ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এতে চোরাকারবারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থধাগ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ সকল সিন্ডিকেটের মূল হোতারা দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। কিছু দেশীয় সিন্ডিকেট বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীদের সহায়তায় স্বর্ণের চালান বিমানবন্দর থেকে পার করে দেয়। আর এর বিনিময়ে মাসিক অথবা প্রতি বার অনুযায়ী উৎকোচ গ্রহণ করে জড়িতরা। প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, দেশে মানি এক্সচেঞ্জের আড়ালে স্বর্ণ পাচার করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে আলামিন মানি এক্সচেঞ্জ, ফারহান মানি এক্সচেঞ্জ, অনিক মানিএক্সচেঞ্জ, ঢাকা মানি এক্সচেঞ্জ, প্যরামাউন্ট মানি এক্সচেঞ্জ ও জাকির মানি এক্সচেঞ্জ। এরমধ্যে ফারহান মানি এক্সচেঞ্জের মালিক হারুনুর রশিদ গোয়েন্দা পুলিশের হাতে একবার আটকও হয়েছিলেন।

আলামিন মানি এক্সচেঞ্জের মালিক মামুন আল আজাদ ওরফে সুমন বিদেশে রয়েছেন । গত ২ বছর আগে বিদেশি অর্থসহ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি। পরবর্তীতে জামিন নিয়ে দুবাই অবস্থান করছেন। দুবাই থেকেই মূলত নিয়ন্ত্রণ করা হয় স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেট। দুবাইয়ে শফিউল আজম পিন্টু নামের আরেক ব্যক্তি বিভিন্ন নামে প্রতিষ্ঠান দিয়ে এই স্বর্ণ পাচার করে থাকেন। দুবাইয়ের এমরান মানি এক্সচেঞ্জের মালিক এমরান হোসেন স্বর্ণ চোরাচালানের একজন গড ফাদার হিসেবে পরিচিত। দুবাই থেকে যেসব স্বর্ণ দেশে আসে তার অধিকাংশই তিনি পাচার করে থাকেন। লেনদেনের হিসাব নিকাশ হয় তার প্রতিষ্ঠান থেকে। বিমানের অনেক সদস্য দুবাই গিয়ে তার আথিতীয়তায় থাকেন। শাহীন নামের আরেক ব্যক্তি। যিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ছদ্মনাম ব্যবহার করে স্বর্ণ পাচার করে থাকেন। চট্রগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর ব্যবহার করে যে সকল স্বর্ণ পাচার হয় তার হোতা হাসান ও আব্বাস। দেশে যে ১১টি স্বর্ণের সরাসরি সিন্ডিকেট রয়েছে এতে জড়িত অধিকাংশই চট্রগ্রামে থাকেন। চট্রগ্রাম জুয়েলারি সমিতির এক শীর্ষ নেতার পুত্র এই সিন্ডিকেটের অন্যতম গডফাদার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।স্বর্ণ চোরাচালানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত। বিশেষ করে বাংলাদেশ বিমানের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের মাধ্যমেই নির্বিঘ্নে স্বর্ণ পাচার করা হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে স্বর্ণ চোরাচালানে সহযোগিতার জন্য গ্রেপ্তারও হয়েছেন বাংলাদেশ বিমানে কর্মরত অনেকে। গোয়েন্দাদের অভিযোগ, বিমানকর্মীদের সহযোগিতা ছাড়া উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ খুলে স্বর্ণ লুকিয়ে রেখে পাচার করা সম্ভব নয়। চোরাচালান বন্ধে এসব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

৩ কোটি টাকা মূল্যের স্বর্ণ ও বিপুল বৈদেশিক মুদ্রাসহ গত ২৬ জানুয়ারি আটক করা হয় বাংলাদেশ বিমানের ক্রু রুহুল আমিন শুভকে। ফ্লাইটে উঠার আগ মুহূর্তে সৌদি আরবের জেদ্দা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে আটক করা হয়। সূত্রমতে, বিমানের ঢাকাগামী ফ্লাইট বিজি ৪০৩৬ এর ফ্লাইট স্টুয়ার্ড হিসেবে ডিউটি ছিল শুভর। বিমানে উঠার আগে তারা জানতে পারেন তার লাগেজে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে। এরপর পুলিশ তার ব্যাগ তল্লাশি করে।

বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে বিশেষ কায়দায় লুকানো ছিল স্বর্ণ। এয়ারক্রাফটের পেছনের দিকে কার্গো হোলের বর্জ্য ট্যাঙ্ক ড্রেন অ্যাক্সেস প্যানেনের ভেতরে নীল ও কফি কালারের তিনটি কাপড়ের মধ্যে স্বর্ণ সেলাই করা অবস্থায় তা উদ্ধার করা হয়। এতে ৮৮টি স্বর্ণবার পাওয়া যায়। যার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৯৭ হাজার ৬০০ টাকা। গত ২৪ এপ্রিলের ঘটনা। বেলা ১২টার সময় শারজাহ থেকে ঢাকায় ফিরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ওই ফ্লাইট। এভাবে বিভিন্ন সময়ে বিমানে স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে। কখনও কখনও জড়িতদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জড়িতরা থাকের ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং-৭৭৭ এর বিমান থেকে যাত্রীদের মালামাল রাখার স্থান (কার্গো হোল) থেকে ১৪ কেজি স্বর্ণ জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। কালো কাপড়ে সেলাই করে সেখানে স্বর্ণের বারগুলো রাখা ছিল। এভাবে বিমানের এসব স্থানে স্বর্ণের বার সাধারণ যাত্রীর পক্ষে লুকিয়ে রাখা সম্ভব না। ঘটনার পরদিন ১৫ জানুয়ারি সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আবুল হোসেন বাদী হয়ে দু’জনের নাম উল্লেখ করে বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন। তারা হলেন বাংলাদেশ বিমানের মেকানিক এমরানুল ইসলাম ও ওসমান গনি। মামলায় বলা হয়, এমরানুল ও ওসমান সংঘবদ্ধ চক্রের অন্য সদস্যদের সহায়তায় স্বর্ণ বাইরে পাচার করতেন।

২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ থেকে ৬৪ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। কাঠের চারটি ক্যারেটের কাঠামোর মধ্যে লুকিয়ে রাখা ছিল বারগুলো। এগুলো ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সেই (বিজি০৮৫) ঢাকা আনা হয়েছিল। তার আগে ওই বছরের ২৩ নভেম্বর ৭ কেজি ১৯০ গ্রাম স্বর্ণসহ বিমানকর্মীকে আটক করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। সেদিন দুবাই থেকে আসা বিমানের ফ্লাইটের (বিজি০৪৮) সিটের নিচে রাখা ৪ কেজি ৬৪০ গ্রাম স্বর্ণের বার পাওয়া যায়। একইদিনে আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের বহিরাংশসংলগ্ন রানওয়ে এলাকায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের টেকনিক্যাল হেলপার মেহেদি হাসানের কাছ থেকে ২ কেজি ৫৫০ গ্রাম স্বর্ণ পাওয়া যায়। ১৩ নভেম্বর আবুধাবি থেকে আসা বিমানের একটি উড়োজাহাজ থেকে ৮ কেজি ৮০০ গ্রাম সোনা উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। উড়োজাহাজটির সিটের নিচের পাইপের মধ্যে এসব তা লুকানো ছিল। এ ঘটনায়ও উড়োজাহাজটি জব্দ করে ঢাকা কাস্টমস হাউস।

এর আগে, ২০১৯ সালের ১৩ জুলাই শাহজালাল বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গার গেটের কাছ থেকে বিমানের ট্রাফিক হেল্পার এমদাদ হোসেন চৌধুরী ও তার সহযোগী আব্দুর রহিমকে ৪ কেজি সোনাসহ আটক করেন বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের সদস্যরা। শুধু তাই নয়, ২০১৭ সালে সোনা চোরাচালানের দায়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে ২০ লাখ টাকা জরিমানাও করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। একইসঙ্গে চোরাচালানের পণ্য বহনের দায়ে বিমানের বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ (এস২-এএইচভি) ময়ূরপঙ্খীকে বাজেয়াপ্ত করে কাস্টমস। তবে ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়ে উড়োজাহাজটি অবমুক্তির সুযোগ দিয়েছিল কাস্টমস। এভাবে বাংলাদেশ বিমানের এমন অসংখ্য ফ্লাইট থেকে স্বর্ণ জব্দ করেছে কাস্টমস এবং শুল্ক গোয়েন্দা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিমানের এমডি আবু সালেহ মোস্তফা কামাল বলেন, স্বর্ণ চোরাচালানে বিমানের কেউ জিড়ত থাকলেও আমরা তাৎক্ষণিকভাবে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এক্ষেত্রে আমাদের যেমন নজরদারি রয়েছে তেমনি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও সক্রিয় রয়েছে বলে জানান তিনি।

শুল্ক গোয়েন্দার হিসাবে, আটকের চেয়ে স্বর্ণ চোরাচালান হয়েছে অনেক বেশি। আবার স্বর্ণ উদ্ধারে বেশিরভাগ সময়ই সহযোগিতা পাওয়া যায় না বিমানের। এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের রাজস্ব কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

মন্তব্য

Beta version