-->
ঢাকা টু দুবাই-২

ড্যান্সক্লাবের আড়ালে বাংলাদেশি তরুণীদের নীরব কান্না

এমদাদুল হক খান, দুবাই থেকে ফিরে
ড্যান্সক্লাবের আড়ালে বাংলাদেশি তরুণীদের নীরব কান্না

ভালো নাচেন কামরাঙ্গীরচরের হোসনে আরা। বয়স ২২ কি ২৩। দেখতেও সুন্দরী। একটি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় মামুন নামের এক নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে। ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্ক গভীর হয়। সংসারের অভাব-অনটনসহ নানা বিষয় শেয়ার করেন বন্ধু মামুনকে।

মামুন তাকে দুবাই নাইটক্লাবে ড্যান্সার হিসেবে চাকরির প্রস্তাব দেন। প্রলোভন দেখান, অল্প দিনেই ঘুঁচে যাবে সব অভাব-অনটন। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা, সন্তানের লেখাপড়া কোনো কিছুই থেমে থাকবে না। মাসিক বেতনও প্রায় লক্ষাধিক টাকা হবে।

মামুনের এসব প্রলোভন ও লোভের বশবর্তী হয়ে দুবাই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন হোসনে আরা। দুবাই যাওয়ার পাসপোর্ট, ভিসাসহ সকল খরচই ম্যানেজ করেন মামুন। এছাড়া হোসনে আরার মায়ের হাতে তুলে দেন আরো ৫০ হাজার টাকা। সব ঠিকঠাক। অনেক স্বপ্ন হোসনে আরার। আর থাকবে না সংসারের অভাব।

জীবনে ফিরে আসবে স্বচ্ছলতা। কিন্তু তার জন্য সেখানে কি নির্মমতা অপেক্ষা করছে, তা ঘুনাক্ষরেও টের পাননি। দুবাই এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন শেষে বাইরে বের হওয়ার পর সেখানকার দালাল চক্র তাদের রিসিভ করে। এরপর নেওয়া হয় একটি কক্ষে। এ সময় তার সঙ্গে বাংলাদেশি আরো ৭ তরুণী ছিল।

ওই কক্ষে প্রবেশের পরই তাদের ওপর নেমে আসে অন্ধকার। জোর করে খাওয়ানো হয় মদ। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় করা হয় ধর্ষণ। শত বাধা, আকুতি-মিনতি কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করেননি চক্রের সদস্যরা। প্রথমে ঠিকমতো খাবার দেওয়া হতো না। করত মারধর। শুধু তাই নয়, ব্লেড দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে কেটে নির্যাতন করা হতো।

একসময় সবই মেনে নেন হোসনে আরা। সম্প্রতি দুবাইয়ের বাংলাদেশি এক নাইটক্লাবে বসে এভাবেই নিজের জীবনের কথাগুলো বলছিলেন তিনি। সুমনা নামে এক তরুণী অভিযোগ করেন, অনেক সময় দুই হাত ও পা বেঁধে দীর্ঘক্ষণ ফেলে রাখা হয়।

এ অবস্থায় মুখে মদ বা নেশাজাতীয় পানীয় পান করিয়ে রাজি করানো হয়। অনেক মেয়ে নির্যাতনের মুখে দেশে ফিরে আসতে চান। মালিকরা তখন তাদের হাত-পা বেঁধে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করেন। পরে ওই ভিডিও দেশে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। একপর্যায়ে ওই মেয়ে অনৈতিক কাজে বাধ্য হন।

ভুক্তভোগী ওই তরুণী আরো জানান, কম বয়সী মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হন বেশি। কারণ, সেখানকার ব্যবসায়ীরা তাদের সঙ্গে রাত কাটাতে বেশি আগ্রহ দেখান। অন্যদিকে, নাচের বাইরে অন্যকিছু করতে চান না মেয়েরা।

এ কারণে নির্যাতন করে তাদের পাঠানো হয়। একজন তরুণীর সঙ্গ পেতে বাংলাদেশি গ্রাহকরা সর্বোচ্চ দুই হাজার দিরহাম (প্রায় ৫৪ হাজার টাকা) পর্যন্ত দিতে রাজি থাকেন।

সরেজমিনে দুবাই, শারজাহ ও আজমান এলাকায় ঘুরে বেশ কিছু বাংলাদেশি নাইটক্লাব পাওয়া গেছে। এ নাইটক্লাবগুলোর মালিক বাংলাদেশি। তারাই বাংলাদেশি নারী পাচারকারীর মূলহোতা। দেশের ভেতরেই রয়েছে তাদের এজেন্ট। তারা গ্রামের অভাবী ও অসহায় নারীদের টার্গেট করে পাচার করছে দুবাই।

সরেজমিনে আজমানের বৈশাখী ও রঙিলা নাইটক্লাবে গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার অধিকাংশ মেয়ের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। তাদের নাচ দেখতে গেট থেকেই ৫০ দিরহাম দিয়ে টোকেন সংগ্রহ করতে হয়। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ হাজার ২৫০ টাকা।

কোনো মেয়ের নাচ ভালো লাগলে গ্রাহক টাকার বদলে ৫০ দিরহামের ওই টোকেন ছুড়ে মারেন। সেখানে মেয়েদের নাচ ভালো লাগলে টোকেনের বদলে দেওয়া হয় গোল্ড প্লেটের তাজ বা ফুলের মালা। টোকেনের মতো এসব মালা বা তাজেরও একটা উপযুক্ত মূল্য আছে।

মেয়েরা নাচ শেষে আগতদের ছোড়া টোকেন, মালা বা তাজ নিয়ে মালিকের কাছে জমা দেন। প্রতিটি টোকেন, মালা বা তাজের জন্য মেয়েরা অর্ধেক টাকা পান। বাকি অর্ধেক রেখে দেন মালিক।

অর্থাৎ কোনো মেয়ে যদি ৫০ দিরহামের টোকেন আয় করেন, মালিক তাকে নগদ ২৫ দিরহাম দিয়ে দেন। বাংলাদেশি বারগুলোতে নাচের মেয়েদের মাসিক ৩০০ টোকেন সংগ্রহ করা বাধ্যতামূলক। অন্যথায় তাদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হয়।

নাইটক্লাবে কর্মরত এক তরুণী এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রতিদিন রাত ১০টায় শুরু হয় নাইটক্লাবের কর্মকাণ্ড। নাচ পছন্দ হলে আগতরা মেয়েদের ওপর টোকেন ছুড়তে থাকেন। রাত ৩টার দিকে শেষ হয় নাচ। এর মধ্যে আগতদের অনেকেই নাচে অংশ নেওয়া মেয়েদের প্রেমে পড়ে যান।

তারা পছন্দের মেয়েকে নিজ বাসা বা হোটেলে নিয়ে যেতে চান। অধিকাংশ মেয়েই যেতে চান না। তখন মালিকরা তাদের নির্যাতন করেন। মারধর করে নিজ গাড়িতে গ্রাহকের সঙ্গে হোটেলে পাঠান। পরদিন দুপুরে তাদের ফিরিয়ে আনা হয়। নাচের মেয়েদের সঙ্গে রাত কাটাতে ৫০০ থেকে ১০০০ দিরহাম খরচ করতে হয়।

কয়েকটি নাইটক্লাব ঘুরে কথা হয় কয়েকজন বাংলাদেশি তরুণীর সঙ্গে। তাদের বয়স ২০ থেকে ২৫-এর মধ্যে। বার ড্যান্সারে কথা বলে বাংলাদেশি এসব মেয়েকে দুবাই আসতে প্রলুব্ধ করা হয়েছে। দেওয়া হয় আর্থিক সচ্ছলতার স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্নের অপমৃত্যু হতে বেশি সময় লাগে না।

কয়েকজন ভুক্তভোগী তরুণী জানান, বাংলাদেশি দালালদের মাধ্যমে মূলত তিন উপায়ে মেয়েদের দুবাই আনা হয়। প্রথমে টার্গেট করা হয় নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণীদের। যারা মূলত বাংলাদেশের বিভিন্ন ড্যান্সক্লাবে নৃত্য পরিবেশন করেন।

অনেকে আবার এখানে নাচ শিখতে আসেন। এসব ক্লাবের সঙ্গে দেশীয় অনেক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মের চুক্তিও আছে। বিভিন্ন দেশে ‘মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’ পরিবেশনের নামে এসব ড্যান্সক্লাব থেকে মেয়েদের ভাড়া করে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মগুলো।

এখানে দেখানো হয় মোটা অঙ্কের অর্থের প্রলোভন। ড্যান্সক্লাবে আসা অধিকাংশ মেয়েই নিম্নবিত্ত পরিবারের। তাদের টাকার প্রয়োজন। এসব ড্যান্স ক্লাব ও ফার্ম দুবাইয়ের বিভিন্ন হোটেল ও রেস্টুরেন্টের এজেন্ট হিসেবেও কাজ করে। দুবাইয়ের হোটেল-রেস্টুরেন্টের মালিকদের চাহিদা অনুযায়ী ড্যান্সক্লাব অথবা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মের মালিকরা মেয়েদের সরবরাহ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুবাইয়ে মেয়েদের পাচার করা এক দালাল বলেন, ড্যান্স ক্লাবে আসা অধিকাংশ মেয়েই নিম্নবিত্ত পরিবারের। তাদের টাকার প্রয়োজন। ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় কর্তারা অনেক মেয়েকে দেখে বলেন, ‘তুমি তো ড্যান্স পার না, তোমাকে কীভাবে নেব?’ তখন অনেক মেয়েই বলেন, ‘তারা শিখে নেবেন।’ কেউ কেউ বলেন, ‘যে কাজ দেবেন, সেটাই করব।’

এমন সুযোগে মেয়েদের দুবাই নিয়ে ‘যা ইচ্ছা তাই’ করানোর সুযোগ পান মালিকরা। দুবাই পৌঁছে প্রথমে তাদের রাখা হয় বাংলাদেশিদের অধীন কয়েকটি ফ্ল্যাটে। সেগুলোর নিরাপত্তায় থাকেন বাংলাদেশি দালালরা।

মাহমুদ নামে এক দালাল বলেন, মেয়েদের দুবাই পাঠাতে একজন দালাল পান ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশকে কন্ট্রাক্টের জন্য দেওয়া হয় ৭০ হাজার টাকা। দুবাইয়ে যাওয়ার পর কোনো মেয়ে যদি ভালো কাজ দেখাতে পারেন, তাহলে মালিক তার ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর ব্যবস্থা করেন। আর যারা উদাসীন হন, তাদের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে সবাইকে ন্যূনতম তিন মাস সেখানে থাকতেই হয়।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার (সদ্য অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) সাইদুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যদের প্রধান টার্গেট দরিদ্র মানুষ।

পাচারকারীরা ভালো বেতনে বিদেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সহজ-সরল মানুষদের ফাঁদে ফেলে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার জগতে। তাদের পাতা জালে জড়িয়ে অবৈধপথে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে এসব মানুষ। যার অধিকাংশই নারী। পাচারের পর নারীদের বিক্রি করে দিচ্ছে চক্রের সদস্যরা।

তিনি বলেন, এর আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নারী পাচারকারী চক্রের বড় হোতা চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির আজম খান দুই সহযোগীসহ গ্রেপ্তার হন দুবাই পুলিশের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বাসিন্দা দুবাইপ্রবাসী আজম খান দুবাইয়ে চাকরির কথা বলে দেশ থেকে আট বছরে সহস্রাধিক কিশোরী-তরুণীকে দুবাই পাচার করেন।

তিনি ও তার সহযোগীরা পাচার হওয়া এসব মেয়েকে বাধ্য করেন যৌনকর্মী হিসেবে ও ডান্স ফ্লোরে কাজ করতে। দুই সহযোগীসহ আজম খানকে রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করার পর তার সঙ্গে পাচার হওয়া বেশ কিছু নারীর কথোপকথনের অডিও-ভিডিও ক্লিপও সিআইডি পেয়েছে, যেগুলোর একটিতে এক তরুণীকে অনুনয়-বিনয় করে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘ভাইয়া আমার নাম। ভাইয়া বাড়িতে আমার মা খুব অসুস্থ।

আমি ছাড়া মাকে দেখার আর কেউ নেই। আমার ভিসার মেয়াদ তিন মাস হয়েছে। আমার ভিসার মেয়াদ আর বাড়াবেন না। আমাকে দেশে ফিরতে দেন।নারী নিয়ে ব্যবসা করেই আজম খান দুবাইয়ে তিনটি ফোর স্টার ও একটি থ্রি স্টার হোটেলের মালিক হন। নিজের এসব হোটেলে কাজ দেওয়ার নাম করে দেশ থেকে ১৫-২০ বছরের মেয়েদের অর্থের লোভ দেখিয়ে দুবাই পাচার করতেন আজম খান।

তাদের প্রথমে কিছুদিন কাজে রাখার পরই শুরু হতো নির্যাতন। নিয়ে যাওয়া হতো ড্যান্সবারে। পরে জোর করে দেহব্যবসায় নামানো হতো। আজম খানের এই অপকর্মের ইন্ধনদাতা হিসেবে তার ভাইও আছেন। এমনকি পাকিস্তানি নাগরিকও রয়েছেন তার চক্রে।

বাংলাদেশ দূতাবাসের দুবাই কনস্যুলেট জেনারেল বিএম জামাল হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, এ ধরনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুবাই ও বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু দালালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কেউ কেউ জামিনে ছাড়া পেয়ে পুনরায় একই অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন।

বাংলাদেশের অভাবী মানুষগুলো দালালদের প্রলোভনে পড়ে কোনো কিছু যাচাই না করেই দুবাই চলে আসছে। এখানে আসার পর তাদের চরম বিভীষিকাময় জীবন পাড়ি দিতে হচ্ছে। নির্যাতনের শিকার কেউ কেউ আবার আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। কেউ কেউ মুখ বুঝে সহ্য করছেন।

তিনি বাংলাদেশি তরুণীদের লোভের বশবর্তী না হয়ে বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন।

মন্তব্য

Beta version