সংযুক্ত আরব আমিরাতের আভিজাত্যের আরেক নাম দেশটির স্বর্ণের বাজার। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও আকর্ষণীয় স্বর্ণবাজার দুবাই ক্রেতা-বিক্রেতা ও দর্শণার্থীদের পদচারণায় মুখরিত থাকে বছরের বেশির ভাগ সময়।
আর এই স্বর্ণ কেনাবেচায় বিশ্বের অভিজাত এবং শৌখিন মানুষ যেমন আছেন, তেমনি তালিকায় আছেন বাংলাদেশ, ভারতসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সাধারণ নাগরিক থেকে প্রবাসী ব্যবসায়ীরাও।
এখান থেকে বৈধ ও অবৈধ পথে প্রতিদিন স্বর্ণের চালান ঢুকছে বাংলাদেশে। এসব স্বর্ণ যাত্রীর নিজস্ব মালামাল হিসেবে আনা হলেও দেশে পৌঁছানোর পর চলে যায় স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের হাতে। বাংলাদেশগামী যাত্রীদের টার্গেট করে দুবাই এয়ারপোর্ট থেকেই স্বর্ণের চালান পাঠানো হচ্ছে।
স্বর্ণের ক্যারিয়ার ধরার জন্য দুবাই এয়ারপোর্টেই রয়েছে চোরাকারবারি চক্রের সদস্যরা। অর্থের লোভ দেখিয়ে যাত্রীদের সেখান থেকেই ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে স্বর্ণের বার। কেউ কেউ অধিক লোভে পড়ে অতিরিক্ত স্বর্ণের বার নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন। এদের মধ্যে সামান্য ধরা পড়লেও বড় বড় চালান থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, অবৈধ স্বর্ণ বাণিজ্যের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার হয়। বিদেশফেরত যাত্রীদের মাধ্যমে আনা স্বর্ণের বিপরীতে এলে সরকার রাজস্ব কম পায়। স্বর্ণ বাণিজ্যের সঙ্গে অস্ত্র, মাদক ও হুণ্ডির যোগসূত্র থাকে। স্বর্ণের বদলে মুদ্রা এলে তা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়াতে ভূমিকা রাখে।
দুবাই বিমানবন্দরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশি এক ব্যক্তি বলেন, ভাই দুইটা স্বর্ণের বার নিয়ে যান। ২৫ হাজার টাকা দেব। দুইটা বার নেয়া বৈধ। প্রত্যেক যাত্রী দুইটা নিতেই পারে।
আপনি কিছু টাকা আয় করলেন, আমরাও করলাম। কাস্টমসের ট্যাক্সের টাকাটাও আমি দিয়ে দেব। বিমানবন্দরে এসে আমাদের লোক বারগুলো নিয়ে যাবে। দুবাই বিমানবন্দরে কথা হয় স্বর্ণ চোরাকারবারি চক্রের সদস্য ঢাকার সাভারের বাসিন্দা ফাহিমের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ট্যাক্স দিয়ে বৈধভাবে দুইটি বার দেশে পাঠালেও প্রায় দুই লাখ টাকা লাভ থাকে। অধিকাংশ ব্যবসায়ী একজনকে দিয়ে একসঙ্গে অনেক বার আনায়। তাই তাদের লাভের অঙ্কটা আরো বাড়ে।
এছাড়া বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা বারগুলো গলিয়ে অলংকার বানিয়ে বিক্রির সময় ভ্যাট-মজুরি, খাদ দিয়ে অতিরিক্ত লাভ করে। তাই প্রতিটি বাংলাদেশিকেই ফ্লাইটে যাওয়ার আগে স্বর্ণ নেবে কি না জিজ্ঞেস করা হয়।ফাহিম বলেন, প্রতিটি ফ্লাইটে কমপক্ষে ২০-২৫ জন যাত্রীর কাছে বার দেয় চোরাচালানকারীরা। সবাইকে কমপক্ষে দুটি করে বার দেয়া হয়।
এদের মধ্যে ২-১ জনের তথ্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে তারাই দিয়ে দেয়। যাতে তাদের গ্রেপ্তার করতে পারে। অন্যান্য চালানগুলো খুব দ্রুত ও নিরাপদে বিমানবন্দর পার হয়ে যেতে পারে সেজন্য প্রায়ই এ প্রক্রিয়ায় বার বহনকারীদের দু’-একজনকে ধরিয়ে দেয়া হয়।
দুবাই থেকে যেসব প্রবাসী স্বর্ণ নিয়ে আসেন তাদের আগে থেকেই ঢাকায় এসে ফোন দেয়ার জন্য একজনের নাম্বার দেয়া হয়। ঢাকায় নামার পর প্রবাসীরা স্বর্ণগ্রহীতাকে ফোন দেন।
স্বর্ণগ্রহীতারা বেশির ভাগ বিমানবন্দরের ভেতরের কর্মচারী। তারা বিমানবন্দরের পার্কিং লট, টয়লেট, নামাজের ঘরসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টে স্বর্ণ হাতবদল করেন। বিশেষ করে বিভিন্ন সংস্থার কর্মরত নিরাপত্তা প্রহরী, ট্রলিম্যান, বোর্ডিং ব্রিজের কর্মকর্তা ও ম্যাকানিকরা প্রবাসীদের কাছ থেকে স্বর্ণ সংগ্রহ করে থাকেন।
স্বর্ণ চোরাকারবারি চক্রের আরেক সদস্য শামীম হোসেন বলেন, অনেক প্রবাসী ভিজিট বা টুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশ থেকে চাকরির জন্য দুবাই আসেন। ভিসা না থাকায় তারা চাকরি পান না।
চাকরি পেলেও টুরিস্ট ভিসা থাকায় অনেক কম টাকা বেতন পান। স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা এসব প্রবাসীদের টার্গেট করেন। তাদের অর্থের লোভ দেখিয়ে নিজেদের এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেন।
মৌখিকভাবে নিয়োগ পাওয়া এসব প্রবাসী দুবাইয়ে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা ও টুরিস্ট স্পটে ঘুরে বেড়ান। বাংলাদেশি পর্যটকদের সঙ্গে দেখা হলেই ‘ভাই বার নেবেন’ বলে স্বর্ণ নেয়ার অফার দেন।
সরেজমিনে দুবাইয়ের গোল্ড সোক মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, এটি একটি ঐতিহ্যবাহী মার্কেট, যেখানে শুধুমাত্র স্বর্ণই কেনাবেচা হয়ে থাকে। এই সোক দুবাইয়ের ব্যবসার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
সঠিক দামে উন্নতমানের স্বর্ণ কেনার উদ্দেশ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ক্রেতারা এই সোকে চলে আসেন। স্বর্ণের তৈরি সবচেয়ে বড় আংটি, স্বর্ণের তৈরি পোশাকসহ নানাকিছু রয়েছে এই গোল্ড মার্কেটে। এ মার্কেট থেকেই বাংলাদেশের অধিকাংশ স্বর্ণের চাহিদা মেটানো হয়।
বাংলাদেশি এক ক্রেতা বলেন, জমজমাট বেচাকেনার পাশাপাশি স্বর্ণ চোরাকারবারিদের কর্মকাণ্ড চলে এই বাজার ঘিরে। প্রায়ই বাংলাদেশসহ বিভিন্ন বিমানবন্দরে ধরা পড়ে স্বর্ণের চোরাচালান। এ অবস্থায় পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য বন্ধের আহ্বান জানান ওই ক্রেতা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গোল্ড সোকের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা সরাসরি বাংলাদেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন না। তারা কয়েকজন বাংলাদেশি ডিলারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ডিলারদের অর্ডার অনুযায়ী স্বর্ণের বার প্রস্তুত রাখেন তারা।
আর ডিলাররা বাংলাদেশের স্বর্ণের দোকানগুলোতে সাপ্লাই করেন। স্বর্ণের বার প্রস্তুত করার পর তারা নিজেদের ব্রোকারকে দিয়ে বাহক খোঁজেন। বাহকদের সঙ্গে দরকষাকষি করে বাংলাদেশে স্বর্ণ পাঠান।
বাহকদের অধিকাংশই প্রবাসী শ্রমিক। তাদেরকে স্বর্ণের বার এবং এর অফিসিয়াল ট্যাক্সের পাশাপাশি পারিশ্রমিক হিসেবে ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়। অনেক প্রবাসী লোভে পড়ে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত বার আনতে চায়। তাদেরকে চাহিদা অনুযায়ী বার দেয়া হয়।
কাস্টমস সূত্র জানায়, দেশে বৈধ উপায়ে যেসব স্বর্ণ দেশে আসছে এর চাহিদা বাংলাদেশে নেই। এটির বড় একটি অংশ ভারতে পাচার হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল গত ৯ ডিসেম্বর ‘বুলিয়ন ট্রেড: ইন্ডিয়ান গোল্ড মার্কেট সিরিজ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে বছরে ১০০ টনের মতো স্বর্ণ অবৈধ পথে ঢোকে। যার উৎস বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীন।
কাস্টমস জানায়, গত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাগেজ রুলের আওতায় স্বর্ণের বার আমদানিতে সুবিধা বাড়ানো হয়। তবে দেশে স্বর্ণের দাম বেড়েই চলেছে। দাম বাড়ার সময়ে আকাশপথে প্রতিদিন দেশে ঢুকছে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ।
মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে দুবাই ফেরত যাত্রীরা দেশে ফেরার সময় বৈধ উপায়ে ঘোষণা দিয়ে স্বর্ণের বার নিয়ে আসছেন। এভাবে দিন দিন স্বর্ণ আমদানি বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশফেরত যাত্রীদের মাধ্যমে দেশে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণের বার আসছে।
সূত্র জানায়, প্রতিটি সোনার বার শুল্ককর দিয়ে আনা হলেও বাজারমূল্যের চেয়ে গড়ে ১০-১২ হাজার টাকা দাম কম পড়ে। আবার সোনার বারে খাদ মেশানোর পর মূল্য সংযোজন আরো বেশি হয়।
এ কারণে যাত্রীদের মাধ্যমে দুটি করে স্বর্ণের বার নিয়ে আসছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ সরকারকে রাজস্ব দিয়ে বিদেশফেরত যাত্রীদের মাধ্যমে স্বর্ণের বার আনার ক্ষেত্রে শুল্ক কর বাবদ বাড়তি খরচ হলেও ঝুঁকি অনেক কম। এ জন্য এখন যাত্রীদের মাধ্যমে বৈধভাবে স্বর্ণের বার আনার ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করেন কাস্টমস কর্মকর্তা ফখরুল ইসলাম।
ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড এর মালিক দীলিপ আগাওয়াল জানান, দুবাই থেকে এখন প্রায় প্রতি ভরি স্বর্ণের বার আমদানিতে শুল্ক-করসহ খরচ পড়ে প্রায় প্রায় ৭০ হাজার টাকা। প্রতিটি বারে (১০ ভরি) প্রায় ১০-১২ হাজার টাকা মুনাফার সুযোগ রয়েছে। এ কারণে প্রবাসীরা দেশে ফেরার সময় স্বর্ণ নিয়ে আসছেন। বাড়তি আয়ের আশায় অনেকে দেশে ফেরার সময় জমানো টাকায় স্বর্ণের বার নিয়ে ফিরছেন।
এদিকে বৈধ পথের পাশাপাশি অবৈধ পথেও স্বর্ণের বার আসছে। যেসব চালান ধরা পড়ছে, সেগুলো শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। তবে মূল হোতারা ধরা পড়ছে না। বাজুসের এক নেতা বলেন, অবৈধ পথে যেসব স্বর্ণের বার আসছে, সেগুলো দেশের স্বর্ণশিল্পে যুক্ত হচ্ছে না। অবৈধ পথে আনা স্বর্ণের বার মূলত দেশের বাইরে আবার পাচার হয়ে যায়।
শুল্ক কর্মকর্তারা বলছেন, বৈধভাবে সোনার আমদানি বাড়ায় সরকার রাজস্ব পাচ্ছে। এতে ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশও বজায় থাকবে।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে বছরে ২০ থেকে ২৫ টন স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে। অথচ বাংলাদেশে বছরে আমদানি হয় মাত্র ৬৫ থেকে ৭০ কেজি স্বর্ণ। এত স্বর্ণের জোগান আসে কোথা থেকে? জানতে চাইলে বাজুসের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার দাবি করেন, ব্যবসায়ীরা পুরোনো স্বর্ণ রিফাইনিং করে চাহিদা মেটাচ্ছেন!
কয়েকজন জুয়েলারি ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে হাতেগোনা কয়েকটি জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান বৈধভাবে দুবাই থেকে স্বর্ণ আমদানি করে। অর্থাৎ পণ্য আমদানির নিয়ম মেনে এলসি খুলে তারা বিদেশ থেকে স্বর্ণ কেনেন। বাকি সিংহভাগ ব্যবসায়ী প্রবাসীদের কাছ থেকে লাগেজে করে আনা স্বর্ণের বারের ওপরই নির্ভর করেন।
মন্তব্য