-->
শিরোনাম
তিন বছরে আড়াই শতাধিক গ্রেপ্তার

অভিজাত এলাকা ঘিরে বিদেশিদের অপরাধ সিন্ডিকেট

নিজস্ব প্রতিবেদক
অভিজাত এলাকা ঘিরে বিদেশিদের অপরাধ সিন্ডিকেট

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাস করছেন প্রায় ১৫ হাজার বিদেশি নাগরিক। রাজধানীর উত্তরা, গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি, বনশ্রীসহ অভিজাত এলাকায় ঘাঁটি গেড়েছেন নাইজেরিয়া, ঘানা, সেনেগাল, ক্যামেরুন, লাইবেরিয়া, কেনিয়াসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশের নাগরিকরা। কয়েক হাজার অবৈধ ভারতীয়, পাকিস্তানি ও নেপালি নাগরিকের বিরুদ্ধেও রয়েছে একই ধরনের অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ। অনলাইনে প্রতারণা, এটিএম কার্ড জালিয়াতি, জাল মুদ্রা, হুন্ডি, মাদক কারবার, মুদ্রা পাচার ও স্বর্ণ চোরাচালান; এমনকি ছিনতাইসহ সব অপকর্মে জড়িত এসব অবৈধ বিদেশি নাগরিকরা। তাদের অপরাধের সিন্ডিকেট গড়ে তুলতে সাহায্য করছে স্থানীয় কিছু বাসিন্দা। গত তিন বছরে আড়াই শতাধিক অবৈধ বিদেশি নাগরিককে গ্রেপ্তারের পরও তাদের লাগাম টানা যায়নি। জামিনে বেরিয়ে উল্টো নাম-পরিচয় পাল্টে নিত্যনতুন কৌশলে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠছে পাসপোর্টের মেয়াদহীন এসব বিদেশি।

 

একই সূত্রমতে, এমন পরিস্থিতিতে অন্তত ১০টি দেশের কয়েক হাজার অপরাধীর তালিকা তৈরি করে অভিযান শুরু করা হয়েছে। একইসঙ্গে অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের অপরাধ করার সঙ্গে সহায়তাকারী দেশীয় অপরাধী চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধেও অভিযানে নেমেছে পুলিশ, র‌্যাব, সিআইডি, এসবি। এছাড়া অবৈধ বিদেশিদের কাছে বাড়ি ভাড়া দিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে পুলিশ। বিদেশিদের কাছে বাসা ভাড়া দেয়ার সময় বাড়ির মালিককে অবশ্যই তার পরিচয় নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রাখতে হবে। একইসঙ্গে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানাকেও অবহিত করতে হবে। থানায় ওই বিদেশির সব তথ্য রাখা হবে।

 

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, এসব বিদেশি ট্যুরিস্ট, খেলোয়াড়, বিজনেস কিংবা স্টুডেন্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ফিরে না গিয়ে অবৈধভাবে বসবাস করছে। নিজেদের নাম-পরিচয় পাল্টে স্থানীয় তরুণীসহ কিছু মানুষকে দলে ভিড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতারণার ফাঁদ পাতাসহ সব অপকর্ম চালাচ্ছে। দিনকে দিন তাদের অপরাধের মাত্রা বেড়ে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।

 

সূত্র জানায়, গত তিন বছরে দুই শতাধিক বিদেশি অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাংলাদেশে ফেসবুকে উপহার পাঠানোর নামে প্রতারণা; হেরোইন, কোকেন ও অপ্রচলিত মাদকের কারবার; ব্যাংকের এটিএম বুথে জালিয়াতি, বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রার কারবার, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, স্বর্ণ চোরাচালান, অনলাইনে ক্যাসিনো এবং মানব পাচারে জড়িত অন্তত ১৫টি দেশের নাগরিক। তাদের ৮০ শতাংশ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের। সূত্রমতে, রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলোয় থাকা এসব বিদেশির ওপর সমন্বিত কোনো নজরদারি নেই দেশে। নেই সঠিক পরিসংখ্যানও। অপরাধ করে গ্রেপ্তারের পর জামিনে ছাড়া পেয়ে আত্মগোপনে থেকে ফের অপরাধে জড়াচ্ছে তারা।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এমন অবৈধ বিদেশ নাগরিকদের অনেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্রের সদস্য। তারা মাস্টার কার্ড, ভিসা কার্ড, এটিএম কার্ড তৈরি, জাল ডলার, মাদক, মানব পাচারসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িত। তারা জাল এটিএম কার্ড, ভিসা কার্ড ও মাস্টার কার্ড তৈরি করার এদেশীয় একাধিক চক্র গড়ে তুলেছে। ওইসব চক্রের সহায়তায় বিদেশিরা হাতিয়ে নিচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশিদের মধ্যে আফ্রিকানদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। আর বিদেশি নাগরিক হওয়ার কারণ ছাড়াও আইনের নানা ফাঁকফোকরে গ্রেপ্তার বিদেশি নাগরিকদের অধিকাংশই জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। পাশাপাশি গ্রেপ্তার আফ্রিকানদের সম্পর্কে তদন্ত করতে গিয়েও নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। কারণ গ্রেপ্তার অধিকাংশ আফ্রিকান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তাদের পাসপোর্ট বা বাংলাদেশে প্রবেশের বৈধ কোনো কাগজপত্রের হদিস মেলে না। ফলে তাদের নাম-ঠিকানা যাচাই করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে গ্রেপ্তারের পর তাদের বিরুদ্ধে শক্ত চার্জশিটও দেয়া যায় না।

 

সর্বশেষ চলতি মাসের শুরুতে উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আফ্রিকান দেশ ক্যামেরুনের চার অবৈধ নাগরিকসহ ছয়জনকে। তারা মাদক কারবার ও অনলাইনে প্রতারণায় জড়িত। আগে ক্ষুদ্রাস্ত্র বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকার কথাও স্বীকার করেছে বিদেশি এ অপরাধীরা। এর আগে গত সেপ্টেম্বর মাসেও ঢাকায় একাধিক চক্র গ্রেপ্তার হয়েছে। তারও আগে গত ২৭ আগস্ট বারিধারা ও কাওলার থেকে সিসম, মরো মহাম্মদ, মরিসন, অ্যান্থনি নামে নাইজেরয়া ও ঘানার চার নাগরিককে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। গত ২১ জুলাই পল্লবী থেকে বাংলাদেশি নারীসহ ১২ নাইজেরিয়ানকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।

 

সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, এ চক্র ঢাকায় বসে ফেসবুক ব্যবহার করে এজেন্টের মাধ্যমে ভারতসহ আটটি দেশে প্রতারণার ফাঁদ পাতে। প্রথমে তারা ফেসবুকে আইডি খুলে বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে। ই-মেইল, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারেও তারা বন্ধুত্ব গড়ে। একপর্যায়ে তারা মোটা অঙ্কের টাকার লোভ দেখায়। ইন্টারনেট ও মোবাইলে লোভনীয় লটারি পাওয়ার মেসেজ পাঠিয়ে মূল্যবান গিফট পাঠানোর কথা বলে পার্সেল ফি আদায় করে প্রতারণা চালায়। এ চক্রে কাস্টমস কর্মকর্তা সেজে প্রতারণা করছিলেন রাহাত আরা খানম ওরফে ফারজানা মহিউদ্দিন ওরফে তূর্ণ আহসান নামে বাংলাদেশি এক তরুণী। এর আগে গত ২২ জুলাই ডিবির সাইবার ক্রাইম ইউনিট দুই নাইজেরিয়ানের সঙ্গে নূপুর খাতুন নামের স্থানীয় এক তরুণীকে গ্রেপ্তার করে। নূপুরও কাস্টমস কর্মকর্তা সেজে তাদের প্রতারণায় সহায়তা করছিলেন। গত ৬ আগস্ট রাজধানীর কাফরুল ও পল্লবী থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে চার নাইজেরীয়সহ প্রতারকচক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

 

র‌্যাব জানায়, ফেসবুকে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে দামি উপহার পাঠানোর লোভ দেখিয়ে প্রতারক চক্রের ‘কাস্টমস কর্মকর্তা’ ছিলেন বাংলাদেশি টুম্পা আক্তার। সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রেজাউল হায়দার বলেন, বিদেশিরা এদেশে বৈধভাবে এলেও ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরই মূলত তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। শুধু বাংলাদেশ নয়, এসব আফ্রিকান ভারত, সিঙ্গাপুর ও দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে মার্চেন্ডাইজিংসহ বিভিন্ন ব্যবসা করতে এসে অপরাধ করে চলেছে। তাদের অপরাধের ধরন এমন, কেউ ভিকটিম হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের প্রতারণার বিষয়টি টেরও পায় না।

 

তিনি আরো বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একার পক্ষে তাদের অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। যেসব বাড়িমালিক বা দেশীয় নাগরিক তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন তাদের সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। বাংলাদেশে স্বল্পমেয়াদি ভিসায় আসা আফ্রিকানদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। অপরাধ চক্রের প্রতারণার শিকার ব্যক্তিদেরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সূত্র আরো জানায়, এদেশে অবৈধ বা বৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশি প্রতারক চক্রের প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর বিদেশি নাগরিকের ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলছে। গত চার মাসে প্রায় ১ হাজার বিদেশির ওপর অনুসন্ধান ও নজরদারি করা হয়। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডাটাবেজ অনুযায়ী, দেশে প্রায় ২ লাখ বিদেশি অবস্থান করছে। তাদের মধ্যে ১৭ হাজার আফ্রিকানসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিক রয়েছে, যারা দেশের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এদের মধ্যে বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাসকারী ১৫ হাজার বিদেশিকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

 

ডিএমপি ডিবির উপপুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, আফ্রিকানসহ অনেক বিদেশি ভিসার মেয়াদ শেষ হলে পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে। কিছু বাংলাদেশি টাকার লোভে তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ডে সহায়তা করে। তাদের ধরার পর জামিনে বেরিয়ে গা-ঢাকা দেয়। তাদের শনাক্ত করার পাশাপাশি ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে কী করণীয়, তা নির্ধারণে দুই বছর আগে সংশ্লিষ্ট বিভাগে চিঠি দেয়া হয়েছে। আর আমরা ইতোমধ্যে একটি তালিকা তৈরি করে অভিযানও শুরু করেছি।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version