-->
বখাটেপনা, মাদকবাণিজ্য ওপেনসিক্রেট ঘটছে খুনের ঘটনাও

হাতিরঝিলে বেপরোয়া অপরাধী চক্র

ইমরান আলী
হাতিরঝিলে বেপরোয়া অপরাধী চক্র

ইমরান আলী: রাজধানীর সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন বিনোদন স্পট হাতিরঝিল। ইট-পাথরের এই ঢাকায় পরিবেশ ও নান্দনিকতায় নগরবাসীর মনে জায়গা করে নিলেও এই স্পট ঘিরে দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠছে অপরাধী চক্র। বখাটেপনা, মাদকবাণিজ্য, দেহ ব্যবসাসহ নানামুখী অপরাধ এখন ওপেনসিক্রেট। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে হাতিরঝিলে ঘুরতে আসা লোকজন নিজেদের অনিরাপদ বোধ করছেন।

 

হাতিরঝিলে গভীর রাত পর্যন্ত বেপরোয়া মোটরসাইকেল রেসিংয়ে মগ্ন থাকে অপরাধ জড়তে পা বাড়ানো কিশোর ও তরুণ গ্যাং। চলে কাররেসিংও। এতে প্রভাবিত হয় আশপাশের তরুণ-যুবকরা। এখানে গাড়ি ও দৃষ্টিনন্দন ব্রিজগুলোতে বসে তরুণীদের উত্ত্যক্ত করে বখাটেরা। এ কারণে হাতিরঝিলের আশপাশের বাসিন্দারাও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। বাসিন্দারা সবসময় থাকেন আতঙ্কে ও উদ্বেগে।

 

সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই হাতিরঝিলের অন্ধকার স্থানে বসে মাদকসেবীদের আসর। আর অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয় রাতের গভীরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। চলে ছিনতাই, অসামাজিক কার্যকলাপ। ওই এলাকায় মাঝে মাঝে অভিযান চললেও অপরাধীরা বেপরোয়া।

 

জানা গেছে, দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিলে এখন অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, মাদকসেবী ও বখাটেরা হাতিরঝিলকে নিরাপদ আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করছে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন হাতিরঝিলের আশপাশে বসবাসকারী বাসিন্দারা। এ ছাড়াও ঘুরতে আসা লোকজন চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাতিরঝিলের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে ৩৮টি গলি। সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওইসব গলিতেই অবস্থান নেয় বখাটেরা। এ ছাড়াও প্রতিটি গলিকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে একাধিক অপরাধী চক্র। ওই চক্রের সদস্যরা নিজেদের এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। এমনকি অধিপত্য বিস্তার ও পূর্ব শত্রæতার জের ধরে হাতিঝিল এলাকায় একাধিক খুনও হয়েছে।

 

শুধু খুন নয়, হাতিরঝিলের চারটি ওভারব্রিজের অন্তত ৮টি স্পটে প্রতিনিয়ত ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন বিনোদন পিয়াসীরা। ওভারব্রিজের ওপর হাতিরঝিলের নিজস্ব সিকিউরিটি গার্ড না থাকা ও পুলিশের কম নজরদারির কারণে প্রায় প্রতিদিনই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি ভুক্তভোগীদের।

 

ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া ব্যক্তি, হাতিরঝিলের সিকিউরিটি গার্ড ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মধুবাগ ও মহানগর প্রজেক্ট এলাকায় দুটি ব্রিজের পাশাপাশি চারটি ওভারব্রিজ রয়েছে। মধুবাগ এলাকায় রয়েছে বেগুনবাড়ি ও মধুবাগ ওভারব্রিজ। মহানগর প্রজেক্ট এলাকায় রয়েছে আড়ং ও মহানগর সাইড ওভারব্রিজ। এই চারটি ওভারব্রিজের ওঠা ও নামার পথে আটটি স্পটে ছিনতাইয়ে ঘটনা বেশি হচ্ছে। তবে হাতিরঝিলে ছিনতাইয়ের সঙ্গে কারা জড়িত?

 

এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা, নিরাপত্তারক্ষী, পুলিশ ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তেজগাঁও, কুনিপাড়া, মধুবাগ এলাকার বখাটেরা এসব ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত। এদের অধিকাংশের বয়স ১৫-২০ বছর। এই বখাটেদের অন্তত ৫-৭টি গ্রæপ রয়েছে। প্রতি গ্রæপে সদস্যসংখ্যা ৫ থেকে ৮ জন। তারা সবাই আশপাশের এলাকায় বসবাস করে।

 

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, হাতিরঝিল এলাকা রয়েছে বখাটে ও মাদকসেবীদের দখলে। কোথাও দল বেঁধে চলছে নেশা। বসার জন্য বেঞ্চ, ওভারপাস ও আন্ডারপাসগুলো নিরাপদ আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করছে বখাটেরা। তবে কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেখা মেলেনি। তাই এখন হাতিরঝিলে ঘুরে বেড়ানো দূরের কথা, চলাচল করাও অনিরাপদ হয়ে পড়েছে।

 

মধুবাগ এলাকার বাসিন্দা শামীম আহমেদ। তিনি বলেন, হাতিরঝিল দিন দিনই উপভোগের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। পরিণত হয়েছে ছিনতাইকারী, মাদকসেবী আর ভাসমান দেহজীবীদের অভয়ারণ্যে। রাত যত বাড়তে থাকে ততই যেন নাজুক ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে পরিবেশ। ল্যাম্পপোস্টের আলো লেকঢালের যেসব স্থানে পৌঁছে না, সেসব স্থানেই মাদকসেবীরা অবস্থান করে। এ ছাড়াও সংযোগ সেতুর আশপাশেই মাদক বিক্রেতা ও সেবনকারীদের তৎপরতা বেশি বলে জানান তিনি।

 

হাতিরঝিল প্রজেক্টের আশপাশ এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রতিদিন বিকেল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বখাটে ছেলেমেয়ে ঢুকে পড়ে হাতিরঝিলে। একাধিক গ্রুপের ভাগ হয়ে নানামুখী উচ্ছৃঙ্খলতা আর খোলামেলা মাদক সেবনে রীতিমতো হৈ-হুল্লোড় সৃষ্টি করে তারা। বিশেষ করে মহানগর প্রজেক্ট এলাকায় অবিস্থত একটি ব্রিজে বখাটে তরুণ-তরুণীদের আনাগোনা বেশি দেখা যায়।

 

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রায় প্রতি রাতেই অর্ধনগ্ন তরুণ-তরুণীদের বেলেল্লাপনা চলে এখানে। রাস্তা ধরে ব্রিজটির নিচে লেকঘেঁষা ঢালে তরুণ-তরুণীদের বিব্রতকর আড্ডাবাজি চলে প্রতিনিয়ত। এ ছাড়াও কুনিপাড়া, বেগুনবাড়ী, মহানগর প্রজেক্টের আবাসিক এলাকা, উলন এলাকায় প্রকাশ্যেই মাদক কেনাবেচা চলে।

 

সরেজমিনে আরো দেখা যায়, হাতিরঝিল তেজগাঁওয়ের কুনিপাড়া ও বেগুনবাড়ী অংশের বস্তিঘরগুলোর সঙ্গেই লাগোয়া রয়েছে রাস্তা-ফুটপাত। বাসিন্দারা সীমানা দেয়ালের মধ্য দিয়েই বাড়িঘরের গেট বানিয়ে নিয়েছেন। গভীর রাত পর্যন্ত এসব বস্তির নারী-পুরুষ-শিশুরা দল বেঁধে বিচরণ করে থাকে। সেখানে বহিরাগত কোনো দর্শনার্থী গেলে নানাভাবে হেনস্তা হতে হয়। টিনশেড বেশকিছু বস্তিঘরের দরজা সীমানা দেয়ালে আটকে পড়লেও তারা বাঁশের মই বানিয়ে নিয়েছেন। দোতলা টিনের ঘর থেকে মই নামিয়ে দেয়া হয় রাস্তা ও ফুটপাতে।

 

এ ছাড়াও টিনশেড ঘরের পাশে রয়েছে বহুতলবিশিষ্ট কয়েকটি ভবন। ওই ভবনগুলোর বাসিন্দারা জানান, কুনিপাড়া, বেগুনবাড়ী, মধুবাগ, উলন এলাকায় কয়েকটি বাসায়ও অপরাধীরা অবস্থান নেয়। হাতিরঝিলে ঘোরাফেরার সুবাদে খদ্দের জুটিয়ে দেহজীবীরা নিজেদের বাসাবাড়িতে নিয়ে যান। রাতভর চলে আনন্দফুর্তি।

 

গতকাল মহানগর আবাসিক এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে সুউচ্চ একটি ব্রিজ রয়েছে। সেই ব্রিজ দিয়ে একপাশ থেকে অপর পাশে পায়ে হেঁটে মানুষ চলাচল করছেন। ব্রিজের একপাশ কুনিপাড়া। অপর পাশে রয়েছে মহানগর আবাসিক এলাকা। সুউচ্চ ব্রিজের রেলিংয়ে বখাটেরা আড্ডা দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, সেখানে বসে আশপাশের বাসার বাসিন্দাদের উদ্দেশে বিভিন্ন মন্তব্য করছেন।

 

এতে বাসার বাসিন্দারা ছাদে বা বারান্দায় বের হতে ভয় পাচ্ছেন। হাতিরঝিলে আসা এক দর্শনার্থী দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, এখানে অনেকে গাঁজার ব্যবসা করে, অনেকে এখানে এসে মদ খায়, মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করে।অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, মহানগর আবাসিক এলাকা ও পশ্চিম উলনে একটি ছোট খেলার মাঠ নির্মাণ করা হয়েছে। বিকেল হলেই ওই মাঠে শুধু মাদক বেচাকেনা। গভীর রাত পর্যন্ত মাদক বেচাকেনা হয় সেখানে। এ ছাড়াও গভীর রাতে সেই এলাকায় রিকশা আটকিয়ে ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে।

 

হাতিরঝিল থানার ওসি মো. আব্দুর রশিদ বলেন, হাতিঝিলে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ সবসময় তৎপর রয়েছে। কিন্তু জনবলের অভাবে অনেক সময় সেবা প্রদানে হিমশিম খেতে হয়। তারপরও হাতিঝিলে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

 

মন্তব্য

Beta version