রোহিঙ্গা ক্যাম্পে টার্গেট কিলিং

ইমরান আলী
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে টার্গেট কিলিং

ইমরান আলী: মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ক্যাম্পগুলোয় টার্গেট কিলিং বাড়ছে। প্রত্যাবর্সনের পক্ষের নেতা মুহিবুল্লাক খুনের পর টার্গেট করে একেক নেতাকে হত্যা করা হচ্ছে। গত শনিবার রাতেও উখিয়া ক্যাম্প-১৫ এর ‘এ’ ব্লকে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে রশিদ আহমদ (৩৬) নামে এক হেড মাঝি (নেতা) হত্যা করে।

 

তারও আগে ২৬ ডিসেম্বর মোহাম্মদ হোসেন নামে অপর এক নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া সন্ত্রাসীরা সেখানে অস্ত্রের মুজত বাড়াচ্ছে। শনিবার ক্যাম্পে তাজা গ্রেনেডও উদ্ধার করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। আগামীতে বড় ধরনের নাশকতা চালাতে পারে সন্ত্রাসীরা এমন আশঙ্কা গোয়েন্দাদের। এ অবস্থায় সেখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জোরদারের সুপারিশ করা হয়েছে।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, উখিয়া ক্যাম্প-১৫ এর এ-ব্লকে সন্ত্রাসীরা ছুরিকাঘাত করে রশিদ আহমদ (৩৬) নামে এক রোহিঙ্গা হেড মাঝিকে হত্যা করে। তিনি উখিয়ার পালংখালীর ক্যাম্প-১৫, জামতলীর ব্লক -এ/৪, শেড নম্বর-৩৩২-এর বাসিন্দা মৃত আব্দুল হাকিমের ছেলে। তার- এফসিএন-২৩০১৮১ এবং তিনি ব্লক হেড মাঝির দায়িত্ব পালন করছিলেন। সেদিন রাত ৮টায় ‘এ’ ব্লকে দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়।

 

জানা যায়, রাতে ব্লক এ/৫-এ অবস্থিত তার দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে অবস্থান করছিলেন রশিদ। এ সময় মুখে কাপড় বাঁধা তিন সন্ত্রাসী সেই ঘরে প্রবেশ করে রশিদকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। ছুরিকাঘাতে তার বুকের ডান পাশে, পেটে, তল পেটে, ডান কানের লতিতে এবং বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে গিয়ে জখম হয়। ভিকটিমের স্ত্রী ও প্রতিবেশীদের চিৎকারে ক্যাম্পের ভলান্টিয়াররা ভিকটিমকে উদ্ধার করে ক্যাম্প-১৫-এর এমএসএফ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

 

এর আগে গত ২৬ ডিসেম্বর উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের মোহাম্মদ হোসেন (৪০) নামে আরেক নেতাকে হত্যা করা হয়। তিনি ক্যাম্প ১৮-এর ব্লক-৮-এর মোহাম্মদ শফিকের ছেলে। তিনি ওই ক্যাম্পের হেড মাঝি হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। নিহতের ছোট ভাই নুর হাশেম সাংবাদিকদের জানান, সকালে তার ভাই ঘরের পাশে বসেছিলেন। হঠাৎ মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা ঘটনাস্থলে এসে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে পালিয়ে যান। এতে মোহাম্মদ হোসেন গুলিবিদ্ধ হলে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এর একদিন পর একই ক্যাম্পের শফি উল্লাহ (৪০) নামে এক রোহিঙ্গা নেতা (মাঝি) খুন হন।

 

এদিকে গত ৪ মাসে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩২টি আশ্রয়শিবিরে খুন হন ১৮ রোহিঙ্গা নেতা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে নেতৃত্ব না মানার প্রবণতা, অপরাধের প্রতিবন্ধকতা আধিপত্য বিস্তারের কারণে এসব খুন হয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে সংঘবদ্ধ হয়ে নিজের অধিকারের কথা বলতে না পারেন, তার জন্য এসব টার্গেট খুন বলে মত রোহিঙ্গা বিশেষজ্ঞদের।

 

কক্সবাজার জেলা পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১১৫টি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে গত ৪ মাসে ১৮টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর এসব খুনের শিকার হওয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতা (মাঝি) ও স্বেচ্ছায় পাহারারত স্বেচ্ছাসেবক। উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্পে আর্মড পুলিশ ৩টি ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে।

 

এসব এপিবিএনের তথ্যমতে, ২২ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ এরশাদ (২২) নামে একজন স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ২১ সেপ্টেম্বর খুন হন মোহাম্মদ জাফর (৩৫) নামে এক নেতা (মাঝি)। ১৮ সেপ্টেম্বর খুন হন আরেক স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ ইলিয়াস (৩৫)। ৯ আগস্ট দুই রোহিঙ্গা নেতা, ৮ আগস্ট টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ১ আগস্ট একই ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক নেতা মারা যান।

 

১ আগস্ট উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক, গত ২২ জুন কথিত আরসা নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং ১৫ জুন একই গ্রæপের সদস্য মো. সেলিম (৩০) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। ১৬ জুন রাতে উখিয়া ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক, ১০ জুন কুতুপালংয়ের ৪ নম্বর ক্যাম্পের আরেক স্বেচ্ছাসেবক, ৯ জুন এক রোহিঙ্গা নেতা, জুনের শুরুতে মে মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানা উল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬)।

 

৮ এপিবিএনের উপ-অধিনায়ক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম জানান, ক্যাম্প-১৮-এর একটি মাদরাসায় ৬ জনকে হত্যা করা হয়। এর আগে ২৯ সেপ্টেম্বর হত্যা করা হয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে। এসব হত্যাকান্ডের পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা নিয়ে সবাই যখন উদ্বিগ্ন, তখন বিকল্প হিসেবে চালু হয় স্বেচ্ছায় পাহারার। ক্যাম্পটির প্রতিটি ব্লকে পাঁচজন করে রাতে স্বেচ্ছায় পাহারা দেয়া শুরু করে।

 

এরপর পর্যায়ক্রমে ৮ এপিবিএনের আওতাধীন ১১টি ক্যাম্পের ৬৪টি ব্লক এর ৭৭৩টি সাব-ব্লকে চালু হয় এ স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা। প্রতি রাতে ৩ হাজার ৮৬৫ রোহিঙ্গা পাহারা দিচ্ছেন এ ১১টি ক্যাম্প। তারা কোন সন্দেহজনক লোকের আনাগোনা, চিহ্নিত অপরাধী, মাদক বেচাকেনাসহ নানা অপরাধের তথ্য দিচ্ছে এপিবিএনকে। তিনি আরো জানান, গত ২৩ অক্টোবর থেকে চালু হওয়া স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থার কারণে ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মতো অপরাধ কমেছে কয়েকগুণ।

 

অন্যদিকে মাদক উদ্ধার বেড়েছে ৩.৬৬ গুণ, অস্ত্র উদ্ধার বেড়েছে ৬.৫ গুণ আর গ্রেপ্তারের সংখ্যা বেড়েছে ৩.৬৩ গুণ। রবিউল ইসলাম জানান, জামতলী ক্যাম্প থেকে চালু হওয়া স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা এখন উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলছে। তিনি জানান, স্বেচ্ছায় পাহারা দেয়ার এ পদ্ধতির কারণে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা প্রতিবন্ধকতায় পড়েছে। যার জের ধরে এসব অপরাধীরা এখন স্বেচ্ছাসেবক এবং মাঝিকে প্রতিপক্ষ হিসেবে টার্গেট করেছে। এতে স্বেচ্ছাসেবক ও মাঝিরাও হত্যার শিকার হচ্ছে।

 

এ পরিস্থিতিতে ক্যাম্পের নিরাপত্তা আরো জোরদার করা হয়েছে বলে জানান তিনি। অভিবাসন ও রোহিঙ্গা বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর জানান, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ। যিনি রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত নিতে কাজ শুরু করেছিলেন। আন্তর্জাতিক মহলে হয়ে উঠেছিলেন রোহিঙ্গাদের মুখপাত্র। কিন্তু ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বন্দুকধারীদের হাতে নিহত হন তিনি। মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠা মেনে নিতে না পেরে রোহিঙ্গাদেরই একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে বলে মামলার তদন্তে উঠে এসেছে।

 

তিনি জানান, মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ড টি সুনির্দিষ্ট টার্গেট কিলিং হিসেবে ধরা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মুখপাত্র হয়ে ওঠা, হওয়ার চেষ্টা এমন মানুষকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় খুন করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নিজেদের উদ্যোগে বা আধিপত্য বিস্তারের জন্য খুন করছেন এমনটা মনে হচ্ছে না। এখানে ভিন্ন কোনো মহলের ইন্ধন থাকতে পারে।

 

উখিয়া কুতুপালং এলাকা স্থানীয় ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন জানান, ‘সম্প্রতি ক্যাম্পের পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। ক্যাম্পভিত্তিক মাঝি (নেতা), সাব-মাঝি, স্বেচ্ছাসেবকদের খুন করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা তাদের অবস্থান ঘোষণা করে যাচ্ছে।’ কক্সবাজার পিপলস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল জানান, রোহিঙ্গারা স্বাভাবিকভাবে নেতা মানতে চান না। কেউ নেতা হয়ে উঠবে বা তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে তা না মানার প্রবণতা তাদের রয়েছে।

 

এ সুযোগ কাজ লাগিয়ে নেতৃত্বশূন্য করার কোনো মিশন সশস্ত্র গোষ্ঠী বা ভিন্ন কোনো মহল করছে কিনা, তা দেখা জরুরি। এদিকে খুনের পাশাপাশি ক্যাম্পকে সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মজুতও বাড়াচ্ছে। শনিবার রাতে তাজা গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, গ্রেনেডটি দেখতে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ভয়াবহ হামলায় ব্যবহৃত পাকিস্তানে তৈরি ‘আর্জেস গ্রেনেড’র মতো হলেও বিশেষজ্ঞ দলের মতে, এটি মিয়ানমারের তৈরি।

 

গ্রেনেডটির বিস্ফোরণ হলে ব্যাপক প্রাণহানি হতো বলে মন্তব্য করেছেন তারা। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা বাড়াতে গোয়েন্দারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছেন। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন অপরাধে ক্যাম্পের ঘটনায় যেসব মামলা হয়, তা গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ক্যাম্পের বাইরে পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে। প্রয়োজনে ক্যাম্পের ভেতরে এপিবিএনকেও সহায়তা দেয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে বাড়ানো হচ্ছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য