মাওয়া সড়কে ভয়ংকর ১০ ডাকাত চক্র

ইমরান আলী
মাওয়া সড়কে ভয়ংকর ১০ ডাকাত চক্র

ইমরান আলী: রাজধানীর রায়েরবাগের হৃদয়, ইমামসহ ৮ বন্ধু দুটি সিএনজিযোগে মাওয়া বেড়াতে যান। রাত ২টার দিকে ইলিশভাজা দিয়ে খেয়ে ঢাকায় ফেরার পথে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের কেওয়াটখালী এলাকায় অস্ত্রশস্ত্রসহ সংঘবদ্ধ ৭-৮ জনের একটি ডাকাত দল তাদের দুটি সিএনজি আটকায়। এ সময় ডাকাত দল হৃদয় ও ইমামকে ছুরিকাহত করে। পাশাপাশি অন্যদের হাত-পা বেঁধে রাস্তার পাশে ফেলে রাখে।

 

তাদের সামনেই ওই ডাকাত আরো দুটি যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি করে। এ সময় পুলিশের গাড়ি এলে তারা পালিয়ে যায়। পালানোর সময় এক ডাকাতের মৃত্যুও হয়।

 

হৃদয় বলেন, তারা ৮ বন্ধু রাজধানীর রায়েরবাগ থেকে সিএনজিতে করে মাওয়া ঘুরতে আসেন। বাড়ি ফেরার পথে রাত ৩টার দিকে কেওয়াটখালী এলাকা এলে ৬ থেকে ৭ জনের একটি ডাকাত দল তাদের সিএনজিটি আটক করে। ডাকাতরা মারধর করে তাদের মোবাইল ফোন ও টাকা ছিনিয়ে নেয়। এতে হৃদয় ও তার বন্ধু ইমাম হোসেনও আহত হন। তিনি বলেন, আমাদের সামনেই কয়েকটি বাসে ডাকাতি করে ওই ডাকাত দল।

 

ডাকাতির সময় তারা বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুরও করে। পুলিশ আসার খবরে ডাকাতরা পালানোর সময় ডাকাত দলের এক সদস্য অজ্ঞান হয়ে রেল সড়কের পাশে পড়ে থাকে। সম্প্রতি ডাকাতের কবলে পড়া ভুক্তভোগীর এরকমই বর্ণনা। শুধু এটিই নয়, ঢাকা মাওয়া সড়কে বেপরোয়া ডাকাত চক্র। রাত গভীর হলেই এ সড়ককে ঘিরে ডাকাত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ডাকাতরা অনেকটা প্রকাশ্যই গাড়ি আটকিয়ে যাত্রীদের সর্বস্ব লুট করছে।

 

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েকে ঘিরে সক্রিয় অন্তত ১০টি ডাকাত চক্র। দিনে এবং রাতে এসব চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন অনেকেই। ঢিল মেরে গাড়ি থামিয়ে মালামাল লুট করছে চক্রের সদস্যরা। আর এসব চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা ঢিল ও বøক পার্টির সদস্য। বাসে ডাকাতির পাশাপাশি এ চক্র রাস্তার পাশে বাসা বাড়িতেও লোকজনকে জিম্মি করে ডাকাতি করছে।

 

গত দুই মাসে এ এলাকায় ডাকাতির অভিযোগে শুধু কেরানীগঞ্জ থানায় ৭টি মামলা হয়েছে। আর মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানায় আরো অন্তত ১০টি মামলা হয়েছে। ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, রাজধানীর পোস্তগোলা সেতু থেকে মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। চার লেন মহাসড়কের পাশ দিয়ে গেছে সার্ভিস লেনও। মহাসড়কটিতে দিনে ও রাতে প্রায়ই ঘটছে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা।

 

কখনো প্রাইভেটকারে যাত্রী তুলে ছিনতাই, কখনো গাড়ি থেকে যাত্রী নামার পর লুট করা হচ্ছে সর্বস্ব। রাতের বেলায় ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে। এমনই এক চক্র গত ৬ ডিসেম্বর মহাসড়কটির কেরানীগঞ্জের সাউথ টাউন এলাকায় ব্যারিকেড দিয়ে ঢাকাগামী দুটি গাড়িতে ডাকাতি করে। এরকম বেশ কয়েকটি ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে ডাকাত চক্রের সন্ধান মেলে। গ্রেপ্তার করা হয় এ চক্রের ৯ সদস্যকে।

 

পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, ঢিল পার্টি, ব্লক পার্টি নামে একাধিক চক্র সক্রিয় এ হাইওয়েতে। তিনি বলেন, এ সড়কে যখন প্রাইভেটকার বা প্রাইভেট যানবাহন যাচ্ছে, তখন তারা দূরে বসে থেকে গাড়িতে ঢিল মারছে, গাড়িতে ঢিল পড়ার পর চালক থেমে যান গাড়িটি দেখার জন্য, তখন তারা গাড়ির সামনে গিয়ে চালক বা আরোহীদের অস্ত্র ঠেকিয়ে তাদের মালামাল কেড়ে নেয়। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে দ্রæত স্থান ত্যাগ করার পরামর্শ দিয়ে পুলিশকে জানানোর কথাও জানান তিনি।

 

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ডাকাতি-ছিনতাই রোধে সিসি ক্যামেরা বসানোর পাশাপাশি হাইওয়ে পুলিশের টহল বাড়ানোর কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আমরা গোয়েন্দা অনুসন্ধানে এক্সপ্রেসওয়েকে ঘিরে ১০টি ডাকাত চক্রের সন্ধান পেয়েছি। এর মধ্যে একটি চক্রের প্রায় সব সদস্যই গ্রেপ্তার হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারে আমাদের বেশ কয়েকটি টিম কাজ করছে।

 

এদিকে স্থানীয়রা জানান, সিরাজদিখান উপজেলার ৫টি সড়কে ডাকাতি হচ্ছে। পুলিশ নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এটা খুবই দুঃখজনক। পুলিশ ডাকাতির সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনবে এটাই দাবি। উপজেলার কেয়াইন ইউপির চেয়ারম্যান মো. আশ্রাফ আলী বলেন, চালতিপাড়া এলাকায় ডাকাতির বিষয়টি আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনেকবার জানিয়েছি।

 

তাছাড়া পরিষদেও এ বিষয়ে কয়েকবার আলাপ-আলোচনা এবং উপজেলার মাসিক সভায় আলোচনা করেছি। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, যাতে করে ডাকাতি বন্ধ করা যায়। রাজানগর ইউপির চেয়ারম্যান মো. মজিবুর রহমান বলেন, কুচিয়ামোড়া-সৈয়দপুর সড়কে অনেক বছর ধরে ডাকাতি হয়ে আসছে। শীত মৌসুমে একটু বেশি হয়ে থাকে। তবে আমরা চেষ্টা করছি এ ডাকাতি বন্ধ করার জন্য।

 

এজন্য প্রতিদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং গ্রাম পুলিশ এখানে ডিউটি করে থাকে। যেদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং গ্রাম পুলিশ না থাকে সেদিনই এ সড়কে ডাকাতি হয়। সেজন্য আমাদের গ্রাম পুলিশ এবং পুলিশের সদস্যরাও রাতের ডিউটি বৃদ্ধি করেছে।

 

চালতিপাড়া ডাকাতির বিষয়ে হাসাড়া হাইওয়ে থানার ইন্সপেক্টর শামীম আল-মামুন বলেন, শীত মৌসুম হওয়ায় চালতিপাড়া এলাকায় ডাকাতি হয়েছিল। এরপর থেকে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে সন্ধ্যা থেকে পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত আমাদের পুলিশ সদস্যরা ডিউটি করে থাকেন। যেহেতু এক্সপ্রেসওয়ের ৪০ কিলোমিটার এলাকায় আমাদের কাজ করতে হয়। তাই বিভিন্ন এলাকায় আলাপ-আলোচনা এবং আমাদের নম্বর দিয়ে এসেছি ঘটনা ঘটার আগেই যেন মানুষজন আমাদের জানায়।

 

সিরাজদিখান থানার ওসি একেএম মিজানুল হক বলেন, কয়েকদিন আগে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একটি ডাকাতি হয়েছিল, এরপর একটি মামলা হয়েছিল, সেই মামলায় গ্রেপ্তার ও রয়েছে। আমরা পুলিশি টহল জোরদার করেছি। ভুক্তভোগী আবুল কালাম বলেন, রাত ২টার পর এ সড়ক যেন ডাকাতদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। বিশাল এ সড়কে সব জায়গায় পুলিশও থাকে না। ডাকাত সুযোগ বুঝে একটা জায়গায় সংঘবদ্ধভাবে থাকে।

 

গাড়ি যাওয়ার সময় তারা ইট বা পাথর ছুড়ে মারে। এ সময় চালকরা গাড়ি দাঁড় করানো মাত্রই অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে গাড়ির ভেতরে ঢুকে সর্বস্ব লুটে নেয়। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। আরেক ভুক্তভোগী পলাশ বলেন, ডাকাত চক্রের প্রধান কৌশল হলো ইট বা পাথর ছোড়া। আবার অনেক সময় মোটরসাইকেল আরোহীদের রশি দিয়েও আটকানো হয়।

 

বেশিরভাগ সময় রাত ২টা থেকে শুরু করে ভোর পর্যন্ত এরা মাওয়া পর্যন্ত কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে রাস্তার দুপাশে থাকে। পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে এখন যেহেতু সারারাত গাড়ি চলে সেহেতু এ সুযোগটি তারা নিচ্ছে। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার ওসি আমিনুল ইসলাম বলেন, আমাদের রাতে টহল পার্টি থাকে। কিন্ত এরপরও চক্রটি নানা কৌশলে ডাকাতি করছে। আমরা ইতোমধ্যে ডাকাতি বন্ধে নানা পদক্ষেপ নিয়েছি।

 

গত কয়েক মাসে কয়েকজন ডাকাতকেও গ্রেপ্তার করেছি। আমরা সড়কটিতে নিরাপদ করতে কাজ করে যাচ্ছি।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য