-->
শিরোনাম

গুজব ছড়াচ্ছে জামায়াত-শিবির

ইমরান আলী
গুজব ছড়াচ্ছে জামায়াত-শিবির

ইমরান আলী: আর্থিক খাতকে টার্গেট করে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। বিশেষ করে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ব্যাংককে টার্গেট করে নানা গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সাধারণ মানুষ ও আমানতকারীদের আশ্বস্থ করে বারবার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলেও ওই গোষ্ঠীটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউব ব্যবহার করে দেশে-বিদেশে গুজব ছড়িয়েই চলেছে।

 

সম্প্রতি ব্যাংকিং খাত নিয়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে রাজধানীর গুলশান থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা হয়। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের সোশ্যাল মিডিয়া ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম। এর পরপরই মাঠে নামেন গোয়েন্দারা। ইতোমধ্যে দুদফায় ৯ জনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করত।

 

আর এরা স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী বলে জানান কর্মকর্তারা। এ গোষ্ঠীটি সুপরিকল্পিতভাবে ব্যাংক খাতকে টার্গেট করে একের পর গুজব ছড়াচ্ছে। যারা এভাবে অপপ্রচারে লিপ্ত থাকবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন কর্মকর্তারা।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। দেশের বাইরে অবস্থান করে কিছু ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ অপপ্রচার চালাচ্ছেন। দেশের ভেতরেও কিছু মানুষ এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। এসব ব্যক্তি আগেও বাংলাদেশ নিয়ে, সরকারকে নিয়ে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা খবর ছড়িয়েছেন।

 

ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ‘বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হবে’ বলে এতদিন গুজব ছড়িয়ে যারা ব্যর্থ হয়েছে, তারাই এখন ‘ব্যাংকে টাকা নেই, আমানত তুলে নিচ্ছে মানুষ’ বলে অপপ্রচার করছে। দীর্ঘদিন থেকে ছড়ানো গুজব অনুযায়ী বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়নি।শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশে হয়নি দেখে সুযোগসন্ধানীরা এখন ব্যাংক নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করেছে।

 

মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে বসে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি অর্থনীতি নিয়ে কল্পিত সব তথ্য ফেসবুক, ইউটিউবসহ নানা মাধ্যমে প্রকাশ করছেন। দেশে বসে অনেকেই সেই গুজবে আগুন ঢালছেন। আর বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা সেসব গুজবের তথ্য বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত করার চেষ্টা করছেন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

 

এরই মধ্যে গত ৯ জানুয়ারি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত নিয়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবির সাইবার ক্রাইম বিভাগ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেনÑ মোহাম্মদ নুর উন নবী, আফসার উদ্দিন রোমান, আবু সাঈদ সাজু, স্বাধীন মিয়া ও আব্দুস সালাম।

 

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে মো. সাইদ উল্লা, মো. মোশাররফ হোসেন, শহিদুল্লাহ মজুমদার ও ক্যাপ্টেন (অব.) হাবিবুর রহমান। গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই একসময় জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল।

 

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ দাবি করে বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে জামায়াতে ইসলামী গুজব ছড়াচ্ছে। ইসলামী ব্যাংক ও দেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সারা দেশে পোস্টার লাগিয়ে গুজব ছড়িয়েছে জামায়াত-শিবিরের একটি চক্র।

 

তিনি জানান, চক্রটি দেশ ও বিদেশে বসে ব্যাংকে টাকা নেই, রিজার্ভ নেই, তাই ব্যাংক থেকে আমানত তুলে ফেলার মতো বিভিন্ন গুজব রটাচ্ছে।

 

হারুন অর রশীদ বলেন, গ্রেপ্তার আসামিরা দেশে ও বিদেশে বসে গুজব ছড়িয়েছে। পাশাপাশি তাদের সহযোগীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংকিং খাত নিয়ে গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে। তারা প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠাতে অনুৎসাহিত করছে। এ চক্রের অনেকেরই নাম পাওয়া গেছে। এই চক্রের সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের সাবেক পরিচালকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা জড়িত রয়েছেন। আমরা সবার নাম পেয়েছি, দ্রæতই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।

 

ডিবিপ্রধান বলেন, বিদেশে অবস্থানরত এই চক্রের বেশ কয়েকজনের নাম পেয়েছি। তাদের নিয়ে কাজ চলছে। মামলায় তাদের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

এই চক্রের সদস্যরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিনা জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা ছাড়া অন্য কোনো দলের সম্পৃক্ততা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

 

গুজবে কান না দেয়ার আহŸান জানিয়ে হারুন অর রশীদ বলেন, দেশে বর্তমানে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার বিষয়টি একটি গুজব। আতঙ্কিত হয়ে ব্যাংক থেকে আমানত উত্তোলন থেকে বিরত থাকতে হবে।

 

হারুন অর রশীদ আরো বলেন, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড দেশের একটি স্বনামধন্য ব্যাংক। ব্যাংকটি একসময় ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দন্ডে দন্ডিত মীর কাসেম আলীসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের দখলে ছিল। ব্যাংকটি পরবর্তী সময় স্বাধীনতাবিরোধীদের দখল থেকে মুক্ত হলে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির চক্র ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা নিয়ে অপপ্রচার চালাতে থাকে। দেশবিরোধী চক্র সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাংকিং খাত নিয়ে আস্থার সংকট তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে আসছিল।

 

তিনি বলেন, এই চক্রের মূল উদ্দেশ্য দেশের আর্থিক খাতকে অস্থিতিশীল করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। তারা এস আলম গ্রুপ সহ স্বনামধন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানদের নামে ব্যাংকিংসংক্রান্ত মিথ্যা অপপ্রচার ও প্রোপাগান্ডা চালিয়ে আসছে। ব্যাংকিং খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে বলে অপপ্রচার চালালেও পরবর্তী সময়ে এর পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ধরনের সাক্ষ্য-প্রমাণ তারা দিতে পারেনি। তারা প্রবাসীদের রেমিট্যান্স না পাঠানোর বিষয়ে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে, ব্যাংকে টাকা নেইÑ এমন নানাবিধ গুজব রটানোর কাজে জড়িত। এসব গুজবের বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন থাকার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিভিন্ন সময় পরিপত্র জারি করা হয়েছে।

 

আমানত নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের : গুজব যখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে তখনই বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গত ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ব্যাংকে গচ্ছিত আমানত নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশের ব্যাংকব্যবস্থা অত্যন্ত সুদৃঢ় অবস্থায় রয়েছে। দেশের ব্যাংকগুলোতে রক্ষিত আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ। এর পরও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাংকের আমানত তুলে নেয়ার জন্য ষড়যন্ত্রমূলক খবর প্রচার হচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা অত্যন্ত সুদৃঢ় অবস্থায় রয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় তারল্যের কোনো সংকট নেই।

 

বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১ বছরে কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়নি। আশা করা যায়, আগামী দিনেও বাংলাদেশের কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না। ব্যাংকগুলোতে জনগণের আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ রয়েছে। এর পরের দিন ১৪ নভেম্বর একই বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদও বলেন, দেশের ব্যাংক খাতে কোনো তারল্য সংকট নেই।

 

ব্যাংক ও আর্থিক খাত নিয়ে পুলিশের পরামর্শ : চলমান এ গুজব নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকেও সাধারণ মানুষের কাছে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ দেশে বর্তমানে পর্যাপ্ত বৈদিশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার প্রচারণা একটি গুজব। আতঙ্কিত হয়ে ব্যাংক থেকে আমানত উত্তোলনে বিরত থাকুন। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করতে হবে। এ বিষয়ে গুজব থেকে সচেতন থাকুন। গুজব রটনাকারীদের বিষয়ে পুলিশকে তথ্য প্রদান করুন।

 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ সালেহ উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, সংকটের সময় একটি মহল সুযোগ বুঝে নানা গুজব ছড়ায়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ভুল করেছে। তারা প্রকাশ করেছে যে, ১০টি ব্যাংকের অবস্থা খারাপ। এটা প্রকাশ করার দরকার ছিল না। এটা প্রকাশ পাওয়ার পরই সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে গেছে। এটা সাধারণত ব্যাংকগুলোই জানে।

 

তিনি বলেন, ‘কিছু ব্যাংক দুর্বল থাকতেই পারে। তাদের হাতে কী পরিমাণ অর্থ আছে, ক্রেডিট রেটিং কী সেগুলো ব্যাংক জানবে, বাংলাদেশ ব্যাংক জানবে। জনসমক্ষে বলা হবে কেন? লোকজন বোঝে না তারল্য কী। কিন্তু লোকজন মনে করেছে, না জানি কী হয়ে গেছে। অলরেডি আইএমএফ আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ কমে যাচ্ছে।

 

মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংক নতুন ঋণ দিচ্ছে না। এমনিতেই এই কয়টি ঘটনায় আস্থায় কিছুটা চিড় ধরেছে। তার মধ্যে আবার রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংকের বিষয়ে বলা হচ্ছে, তাদের ঋণখেলাপি অনেক বেশি। লোকজন হয়তো কিছু টাকা তুলে ফেলেছে। কেউ কেউ হয়তো সঞ্চয় ভেঙেছে।

 

এ সুযোগে একটি মহল ষড়যন্ত্র করে গুজব ছড়াচ্ছে বলে মনে করেন সালেহ উদ্দিন আহমেদ।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version