-->
অর্থ-অস্ত্রের সহায়তায় দিন দিন বেপরোয়া

আইএসআই মদদ দিচ্ছে ‘আরসা’কে, সীমান্তে সক্রিয় সশস্ত্র ৫ সহস্রাধিক 

ইমরান আলী
আইএসআই মদদ দিচ্ছে ‘আরসা’কে, সীমান্তে সক্রিয় সশস্ত্র ৫ সহস্রাধিক 

ইমরান আলী: বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তে সশস্ত্র সংঘাত ও ক্যাম্পে ধারাবাহিক খুনে রোহিঙ্গাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মিকে (আরসা) মদদ দিচ্ছে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। আরসাকে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তার কারণে দিন দিন বাংলাদেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে এই সংগঠনটি।

 

বুধবার বাংলাদেশের বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) ওপর হামলা করতেও দ্বিধাবোধ করেনি তারা। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরতে নানা রকম উদ্যোগ নেয়া নেতা মুহিবুল্লাকে হত্যাসহ তার শত শত অনুসারীকে টার্গেট করে একের পর এক খুন করে যাচ্ছে আরসা। অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ পেয়ে ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে উঠছে বিচ্ছিন্নতাবাদী এই জঙ্গি সংগঠনটি।

 

আগামী নির্বাচন সামনে রেখে আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠার পরিকল্পনাও করছে। পুরো বছরই একের পর এক ঘটনা ঘটিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তরা করছে বলে আশঙ্কা করেছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। আর এ কারণে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।

 

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বলছেন, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সবসময় বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক কাজ করে থাকে। আরসাপ্রধান আতাউল্লাহ পাকিস্তানি হওয়ায় এ এলাকায় অস্থিরতা সৃষ্টি করতে বিশেষ সহায়ক। তারা তাদের অস্ত্র ও অর্থ দুটোই সরবরাহ করছে। এ কারণে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাউন্টার ইন্টিলিজেন্স বাড়ানোর পরামর্শ এই নিরাপত্তা বিশ্লেষকের।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্তে আরসা ও অপর আরেকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরএসওর মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত শুরু হয়। এ সময় আরসার জঙ্গিরা বিজিবির ওপর হামলা করে। এ সময় বিজিবিও প্রতিরোধ গড়ে। দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় আধাঘণ্টা চলে তুমুল গোলাগুলি। পরে পিছু হটে আরসা। পরবর্তী সময়ে আরসা ও আরএসওর মধ্যে দুই দিনব্যাপী গোলাগুলি হয়।

 

সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থানরত ৫০০-এর বেশি রোহিঙ্গার ঘরবাড়িতে আগুন দেয়া হয়। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করে, সেখান থেকে রোহিঙ্গারা পালিয়ে সীমান্তের ওপারে তুমব্রæ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। আর কিছু রোহিঙ্গা সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলে যায়। সর্বশেষ গত শনিবারও সেখানে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। এর আগে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে টার্গেট কিলিং শুরু করে আরসা নামধারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা।

 

কক্সবাজার জেলা পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, গত ৪ মাসে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩২টি আশ্রয় শিবিরে খুন হয়েছেন ১৮ রোহিঙ্গা নেতা।

 

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১১৫টি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। আর এসব খুনের শিকার হওয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতা (মাঝি) ও স্বেচ্ছায় পাহারারত স্বেচ্ছাসেবক।

 

উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্পে আর্মড পুলিশ ৩টি ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) নিরাপত্তায় নিয়োজিত। এসব এপিবিএনের তথ্যমতে, ২২ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ এরশাদ (২২) নামে একজন স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ২১ সেপ্টেম্বর খুন হন মোহাম্মদ জাফর (৩৫) নামের এক নেতা (মাঝি)। ১৮ সেপ্টেম্বর খুন হন আরেক স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ ইলিয়াস (৩৫)। ৯ আগস্ট দুই রোহিঙ্গা নেতা, ৮ আগস্ট টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ১ আগস্ট একই ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক নেতা মারা যান।

 

১ আগস্ট উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক, গত ২২ জুন কথিত আরসা নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং ১৫ জুন একই গ্রæপের সদস্য মো. সেলিম (৩০) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। ১৬ জুন রাতে উখিয়া ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক, ১০ জুন কুতুপালংয়ের চার নম্বর ক্যাম্পের আরেক স্বেচ্ছাসেবক, ৯ জুন এক রোহিঙ্গা নেতা, জুনের শুরুতে মে মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানাউল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬)।

 

অভিবাসন ও রোহিঙ্গা বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর জানান, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ, যিনি রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত নিতে কাজ শুরু করেছিলেন। আন্তর্জাতিক মহলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন রোহিঙ্গাদের মুখপাত্র। কিন্তু ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বন্দুকধারীদের হাতে নিহত হন তিনি। মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠায় মেনে নিতে না পেরে রোহিঙ্গাদেরই একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে বলে মামলার তদন্তে উঠে এসেছে।

 

তিনি জানান, মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডটি সুনির্দিষ্ট টার্গেট কিলিং হিসেবে ধরা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মুখপাত্র হয়ে ওঠা, হওয়ার চেষ্টা এমন মানুষকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় খুন করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নিজেদের উদ্যোগে বা আধিপত্য বিস্তারের জন্য খুন করছেন এমনটা মনে হচ্ছে না। এখানে ভিন্ন কোনো মহলের ইন্ধন থাকতে পারে।

 

এদিকে সম্প্রতি আরসা প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনির ভাই মো. শাহ আলীকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বেরিয়ে আসে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য।

 

বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ভারতে এদের যোগাযোগ রয়েছে। আর সংগঠনটির নেতা আতাউল্লাহ ‘আবু আম্মার জুনুনি’ নামেও পরিচিত। তার বাবা অবশ্য রাখাইন থেকে পাকিস্তানের করাচিতে পাড়ি দিয়েছিলেন। সেখানেই আতাউল্লাহর জন্ম। বেড়ে উঠেছেন মক্কায়। পড়াশোনা করেছেন সেখানকার মাদরাসায়। রাখাইনের রোহিঙ্গারা যে ভাষায় কথা বলে সেটিও আরবি- দুটি ভাষাতেই তিনি অনর্গল বলতে পারেন। ২০১২ সালে আতাউল্লাহ অবশ্য সৌদি আরব থেকেও ‘অদৃশ্য’ হয়ে যান। এরপর ২০১৭ সালে আরাকানে নতুন করে সহিংসতা শুরুর পর তার নাম শোনা যায়। ওই বছর মিয়ানমার জান্তা সরকারের রোষানলে পড়ে নিজের ভূখন্ড ছেড়ে পালিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয় লাখো রোহিঙ্গা।

 

রোহিঙ্গাদের জন্য তৈরি করা হয় অনেকগুলো ক্যাম্প। সেখানে বসবাসের শুরু থেকেই ‘আরসা’র নাম ব্যবহার করে নানা ধরনের অপকর্মের অভিযোগ পাওয়া যায়। কুতুপালং ক্যাম্পে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ। তখন নিহতের পরিবার থেকে অভিযোগ তোলা হয়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করায় মুহিবুল্লাকে হত্যা করেছে আরসার সন্ত্রাসীরা। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ অবশ্য মনে করে, আতাউল্লাহর নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র সংগঠনটি মূলত মিয়ানমার সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করে।

 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আরসার আতাউল্লা যেহেতু পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ছিলেন, সেহেতু সেখানকার কানেকশন তার রয়েছে। মূলত পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার মদদেই তারা দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে। অস্ত্র ও অর্থ দুটোতেই তারা স্বাবলম্বী হচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিপক্ষের এ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনটি নিজেদের প্রায় ৫ হাজার প্রশিক্ষিত বাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। চলতি বছর বাংলাদেশের রাজনীতি উত্তপ্ত থাকবে।

 

আগামী বছরের শুরুতে হবে সাধারণ নির্বাচন। আর এ সময়টাকে বেছে নিয়ে বছরের শুরু থেকে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা শুরু করেছে। তারা বড় ধরনের নাশকতা চালাতে পারে এমন আশঙ্কাও রয়েছে গোয়েন্দাদের। সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাজা গ্রেনেড পাওয়ায় গোয়েন্দাদের এ আশঙ্কা তীব্র হচ্ছে।

 

বর্তমান এ পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গারা দিন দিন বিষফোঁড়া হয়ে যাচ্ছে। আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।

 

সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা বরাবরই এমন করে থাকে। রোহিঙ্গাদের দিয়ে যেন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে, এ জন্য কাউন্টার ইন্টিলিজেন্স আরো বাড়াতে হবে। সবসময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

 

তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের পক্ষে আরো জনমত গড়ে তুলতে কাজ করতে হবে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version