-->
শিরোনাম
অপরিকল্পিত আবাসনে বিপর্যস্ত পরিবেশ-২

পাহাড়-টিলা কেটে সিলেটকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে

খালেদ আহমদ, সিলেট
পাহাড়-টিলা কেটে সিলেটকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে

খালেদ আহমদ, সিলেট: অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বলে খ্যাত উঁচু-নিচু নান্দনিক পাহাড়-টিলা, খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়বেষ্টিত প্রাচীন জনপদ এবং দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ সিলেট। হাজার বছর ধরে সিলেট অঞ্চলে যেসব পাহাড়-টিলা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল, নগর সভ্যতার চাপে দু-তিন দশকের মধ্যেই সেগুলো বিলীন হতে বসেছে। সবুজ-শ্যামল নৈসর্গিক সিলেট রুক্ষ বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়-টিলা কেটে সিলেটের পরিবেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভারত সীমান্তঘেরা এ অঞ্চলটি যেন প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যের আঁচলে ঢাকা। যেখানে পর্যটকরা মুগ্ধ হন, প্রেমে পড়েন শীতল প্রকৃতির এ লীলাভূমির। সিলেটের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রকৃতির রূপ-লাবণ্যের অপূর্ব সৌন্দর্যের ভাণ্ডার।

 

কালের বিবর্তনে মানুয়ের লোভ আর অজ্ঞতার কারণে এবং আইনের কঠোর প্রয়োগের অভাবে নির্বিচারে পাহাড়-টিলা কাটার ফলে সিলেটের প্রকৃতি-পরিবেশে চরম বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সিলেটে অর্ধশতাধিক পাহাড়-টিলা কেটে ফেলা হয়েছে। ফলে পাহাড় ও টিলাধসের ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট অঞ্চল। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। এছাড়া মারাত্মক ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট অঞ্চল। ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেটের জাফলং অংশে ডাউকি ফল্টে ভূমিকম্পের ঝুঁকির ফলে সিলেট এবং চট্টগ্রাম অঞ্চল ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট মহানগর ও এর আশপাশ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জে প্রায় প্রতিদিন পাহাড়-টিলা কাটা হচ্ছে। ভরাট করা হচ্ছে দীঘি ও পুকুর। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে সিলেটের প্রকৃতিতে। অবাধে পাহাড় টিলা কর্তন ও সাবাড় করে সমতল ভূমিতে পরিণত করার প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। ফলে ঘন ঘন ভূকম্পন অনুভূত হচ্ছে সিলেটে। ভূমির স্থিতিশীলতা রক্ষায় ও ভূকম্পন রোধে পাহাড়-টিলার বিকল্প নেই। এটাই ভূতত্ত্ববিদদের অভিমত। এ কারণে পরিবেশ ও প্রতিবেশের বিপর্যয় ঠেকাতে পাহাড়-টিলা কর্তন সব দেশেই নিষিদ্ধ। তাই ভূমিকম্পপ্রবণ সিলেট নগর ও সিলেট জেলার পাহাড়-টিলা রক্ষার্থে কর্তন বন্ধ করতে হবে। কিন্তু সে কর্তব্য পালন করছে না সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও সংস্থাগুলো। অবৈধভাবে টিলা ও পাহাড়ের মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ার কারণে সিলেটের পরিবেশ ও প্রতিবেশগত অবস্থা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ কারণে ভূমির স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে ভূমিধসে প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার এ তথ্য জানান।

 

তিনি জানান, সিলেট সিটি করপোরেশনসহ সিলেট সদর, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারে টিলাকাটা রোধে বেলার করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে (রিট পিটিশন নং-৯৭৫০/১১) ২০১২ সালের ১ মার্চ উচ্চ আদালত পাহাড় ও টিলাকাটা রোধ করে তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ এবং টিলার পাদদেশে বসবাসকারী দরিদ্র জনগণকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু এ রায়ের কার্যকর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, গত ৩০ বছরে সিলেটের ৫০ শতাংশ পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। পাহাড়-টিলা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। সিলেট মহানগরে ও আশপাশ উপজেলায় প্রায় ৭০ শতাংশ জলাভূমি, পুকুর ও দীঘি ভরাট হয়ে গেছে। জলাভূমি বিলীন হওয়ার কারণে জলাভূমিকেন্দ্রিক বৃক্ষ হিজল-করচ এখন বিলুপ্তির পথে। এ কারণে ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্যও। পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন বলেন, ‘সিলেটে পাহাড়-টিলাকাটা বন্ধে আমরা সক্রিয় রয়েছি। সীমিতসংখ্যক জনবল নিয়ে টিলাকাটা বন্ধে আমরা সর্বোচ্চভাবে চেষ্টা করছি। তারপরও কেউ পাহাড়-টিলা কাটলে পরিবেশ অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা আদায় করছে।’

 

তিনি জানান, টিলাকাটার অপরাধে ১৬৮টি মামলা বর্তমানে আদালতে পরিচালিত হচ্ছে। এত বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চলতে থাকা টিলাকাটা বন্ধ করা কঠিন। তবু আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, নিয়মিত অভিযান পরিচালনাও করছি। টিলাকাটা পুরোপুরি বন্ধে সরকারের সব দপ্তরের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

 

গত বছরের মাঝামাঝি ১০ দিনের ব্যবধানে লাগাতার ১৫ বারের মতো ভূকম্পন হয় সিলেট মহানগরসহ ও আশপাশ এলাকায়। ফলে প্রায় ১০ দিন বন্ধ রাখতে হয় নগরের বহুতল বাণিজ্যিক ভবন, বিপণিবিতান ও মার্কেটগুলো। পাহাড়-টিলা কর্তন ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন করে যাচ্ছে বেলা। বেলার এ আন্দোলনের মুখে সিলেটের বিভিন্ন পাথর কোয়ারি থেকে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ হলেও বন্ধ হয়নি পাহাড়-টিলা কর্তন। তাই বাধ্য হয়েই বেলা হাইকোর্টে মামলা করে। এ মামলার প্রেক্ষিতে ২০১২ সালের ১ মার্চ হাইকোর্ট মামলা সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর পাহাড়-টিলা রক্ষা ও কর্তন বন্ধ করার নিমিত্তে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্নিষ্টদের নির্দেশ দেন। উচ্চ আদালতের এ সুস্পষ্ট নির্দেশনার পরও সিলেট জেলার মামলাভুক্ত বিভিন্ন এলাকায় নির্বিচারে পাহাড়-টিলাকাটা হচ্ছে।

 

সম্প্রতি বেলার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সিলেটে সিটি করপোরেশন এলাকার আখালিয়া করেরপাড়া, হাওলাদারপাড়া, বালুচর, তারাপুর, বাদামবাগিচা, জাহাঙ্গীরনগর, বনকলাপাড়া ও শাহী ঈদগাহ, সদর উপজেলার টিলাগড়, খাদিম বাগমারা, জালালাবাদ, এয়ারপোর্ট এলাকা, টুলটিকর, মেজরটিলা, শাহপরান ও বড়শালা, জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর, বারমাটি, ঠাকুরের মাটি, চিকনাগুল ও বাঘেরখাল, গোয়াবাড়ী ও কমলাবাড়ী এলাকা, গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ রামনগর, গোলাপগঞ্জ উপজেলার হেতিমগঞ্জ, ঘোষগাঁও, ঢাকা দক্ষিণ, রনকেলি, বাঘা ও ধারাবহর এলাকা এবং বিয়ানীবাজার উপজেলায় টিলাকাটা চলছে। অথচ দেশের প্রচলিত আইনানুযায়ী পাহাড় টিলাকাটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু ভূমিখেকোরা নানা কৌশলে বিভিন্ন প্রলোভনে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীদের ম্যানেজ করে পাহাড়-টিলা কর্তনের সুযোগ নিচ্ছেন বলে অভিযোগে উঠেছে।

 

উচ্চ আদালতের এ নির্দেশনা মোতাবেক সংশ্লিষ্টরা পাহাড়-টিলা কর্তন বন্ধে কার্যকরি ব্যবস্থা না নেয়ায় গত বছরের অক্টোবর মাসে সিলেট সিটি করপোরেশন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ মামলা ও পরিবেশ রক্ষা সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও দপ্তরের ১৫ জনকে নোটিশ দেয় বেলা। বেলার নোটিশে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সিলেটের পাহাড়-টিলাকাটা ও পাহাড়ি বন উজাড় বন্ধ এবং পাহাড়ে নির্মিত বিভিন্ন স্থাপনা নির্মূল-উচ্ছেদে কঠোর, দ্রুত ও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করা হয়। পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ আদায় ও দোষীদের শাস্তির আওতায় এনে পাহাড়-টিলাকাটা মামলাভুক্ত এলাকায় দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে বনায়নের দাবিও জানানো হয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আদালত অগ্রাহ্য করে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোয় আজ অবধি চলমান রয়েছে পাহাড়-টিলা কর্তন।

 

কখনো দিন-দুপুরে আবার কখনো রাতের আঁধারে কেটে সাবাড় করা হচ্ছে পাহাড়-টিলা। সূত্রমতে, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রকল্প, রাস্তাঘাট ও হাউজিংয়ে পাহাড়-টিলার মাটি দিয়েই ভরাটের কাজ করা হচ্ছে। খাদকরা পরিবেশ অধিদপ্তরসহ প্রশাসন ও পুলিশকে ম্যানেজ করেই পাহাড় কর্তন ও মাটি বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। সিলেট নগরীর আখালিয়া করেরপাড়া, জাহাঙ্গীরনগর টিলা, তারাপুর, বালুচর, এলাকায় পাহাড়-টিলা কেটে খাদকরা ট্রাক ও ট্রলি দিয়ে বালুমাটি ও লালমাটি বিক্রি করছে। পাশাপাশি টিলার স্থানগুলোয় হাইজিং প্লট তৈরি করে তা অধিক মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। জৈন্তাপুরের চিকনাগুল ও হরিপুর এলাকার বিভিন্ন টিলা কেটে সিলেট শহরতলি শাহপরান এলাকাস্থ বিভিন্ন হাউজিং ভরাটে মাটি বিক্রি করছে।

 

পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা মাঝেমধ্যে আইওয়াশ অভিযান ও আইওয়াশ দু-একটি মামলা দিয়ে তদের পকেট আরো বেশি ভারী করা ছাড়া আর কোনো কর্তব্য পালন করছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। পাহাড়-টিলা কর্তনের ফলে একদিকে যেমন সিলেটে ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ছে, তেমনি টিলার মাটি দিয়ে হাওর-বিল হাউজিংসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রকল্প ভরাটের কারণে নিম্নাঞ্চলে পানির ধারণক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে সিলেট অঞ্চলে বন্যার ভয়াবহতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সব মিলিয়ে পাহাড়-টিলা কর্তনের মাধ্যমে পুণ্যভূমি সিলেটের পরিবেশ ও প্রতিবেশকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে বলে অভিজ্ঞমহল মনে করছেন।

মন্তব্য

Beta version