ইমরান আলী: নানা কৌশলে বিকাশ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। দিন দিন টাকা খোয়া যাওয়া ভুক্তভোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অনলাইন ব্যাংকিং-বিকাশের দোকান ঘুরে অ্যাকাউন্ট নম্বর সংগ্রহ, পরে দোকানদার সেজে গ্রাহককে ফোন করে নানা তথ্যের ভিত্তিতে হাতিয়ে নিচ্ছে গ্রাহকের লাখ লাখ টাকা।
সম্প্রতি এমনই একটি চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করার পর গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে, ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার এক গ্রামের প্রায় সবাই এ প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। সারা দেশে বিকাশকেন্দ্রিক যত প্রতারণা হয়, তার ৯০ শতাংশের ওপরে এ গ্রামের লোকজন জড়িত। পাশাপাশি মাগুরা ও মাদারীপুরেও রয়েছে কিছু বিকাশ প্রতারক।
ডিএমপি গোয়েন্দা বিভাগের (গুলশান) উপকমিশনার মশিউর রহমান বলেন, আইফোনে কিছু তথ্য শেয়ার করার সুযোগ থাকে। এই সুবিধা নিয়ে প্রতারকরা যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগের কথা বলে পিন নম্বর নিয়ে গ্রাহকের অ্যাকাউন্টের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পুরো টাকা হাতিয়ে নেয়। বিকাশ বা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের কাস্টমার কেয়ার থেকে কখনো পাসওয়ার্ড চাওয়া হয় না। তাই এসব ফোন এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন তিনি।
বিকাশকেন্দ্রিক প্রতারকদের নতুন নতুন ফাঁদ : বিকাশকেন্দ্রিক প্রতারকদের নানান ফাঁদের বিষয়ে কথা হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তা ধরের সঙ্গে। তিনি জানান, পুরোনো কিছু কৌশলের পাশাপাশি নতুন নতুন উদ্ভাবনী কৌশল অবলম্বন করছেন প্রতারকরা। ভুল নম্বরে ভুল করে টাকা পাঠানোর কথা বলে সেটা ফেরত চাওয়া বা ওটিপি নম্বর নেয়ার ফাঁদ পুরোনো।
মুক্তা ধর বলেন, নতুন কৌশলের মধ্যে দেখা গেছে, টিকা নিবন্ধনের এসএমএস পাঠিয়ে প্রতারণা করা। এক্ষেত্রে প্রতারক বলে, আমি টিকার নিবন্ধন করেছি। তবে ভুলক্রমে আপনার নম্বরে চলে গেছে। যদি কোডটা একটু কষ্ট করে দেন, না হলে আমার আবার রেজিস্ট্রেশন করা লাগবে। না হলে আমার দেরি হয়ে যাবে। তখন ভিকটিম মানবিক দিক বিবেচনা করে কোডটা দিয়ে দেয়। তারা মানসিকভাবে দুর্বল করে প্রতারণা করছে।
বিকাশের প্রতারণা নিয়ে কাজ করেন সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম সেলের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার কামরুল আহসান। গত নয় মাসে ঢাকা থেকে টিম পাঠিয়ে ফরিদপুরে অভিযান চালিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ জনের মতো বিকাশ প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছেন তারা।
তিনি বলেন, ফেসবুকে একটা পেজে দেখলাম লেখা, উপবৃত্তির টাকার জন্য এই নম্বরে যোগাযোগ করুন। আমি তখন লোকেশনটা চেক করে দেখলাম ভাঙ্গা, ফরিদপুর। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিকাশ এজেন্টকেও ফোন দেয় প্রতারকরা। ফোন দিয়ে বলে, আপনি তো দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ কমিশন পান। আমাদের অফিস থেকে কমিশন দ্বিগুণ করে পাঁচ শতাংশ করা হয়েছে।
এটা অ্যাক্টিভেট করার জন্য আমরা যা বলি তাই করেন। প্রতারকদের কথামতো কাজ করলে টাকা অন্য নম্বরে ট্রান্সফার হয়ে যায়। প্রতারক টাকা নিয়ে একাধিক নম্বরে ট্রান্সফার করে দেয়। পরে একটা জায়গা থেকে ক্যাশআউট করে নেয়। এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির নামে বিভিন্ন অফারের কথা বলে প্রতারক। ১৬২৪৭ বিকাশের হটলাইন। এই নম্বরের সামনে অনেক সময় +৮৮ যুক্ত করে প্রতারক ফোন দিয়ে নানা ধরনের প্রলোভন দেখায়। এই বিকাশকেন্দ্রিক চক্রের ৯০ শতাংশ ফরিদপুরের। বাকিরা মাদারীপুর ও মাগুরার।
প্রতারকরা যেভাবে জানে গ্রাহকের তথ্য : সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার কামরুল আহসান বলেন, এজেন্টের দোকান একটা খাতা ব্যবহার করে, যে খাতায় বিকাশের ট্রানজেকশনের বিকাশ নম্বর লেখা হয়। অনেক সময় প্রতারক বিকাশের টাকা তোলা বা পাঠানোর নামে গিয়ে গোপনে ওই খাতার ছবি তুলে আনে। অনেক সময় এই প্রতারণায় বিকাশের এজেন্ট ও বিকাশ কর্মকর্তারাও জড়িত থাকে।
এ ছাড়া অনেক সংস্থা ভোক্তার ডাটা সংগ্রহ করে বলেও জানান কামরুল আহসান। তারা থার্ড পার্টির কাছে ডাটা বিক্রি করে। এ ধরনের সংস্থার কাছ থেকেও প্রতারক ডাটা সংগ্রহ করে থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন লোভ দেখিয়েও প্রতারক নিশ্চিত হয়, গ্রাহকের নম্বরে বিকাশ অ্যাকাউন্ট খোলা।
অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার কামরুল আহসান বলেন, ‘আমরা যেসব প্রতারক গ্রেপ্তার করেছি, তাদের তথ্যমতে, একদল অসাধু সিম বিক্রেতা রয়েছে, যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে সাধারণ মানুষকে ফ্রি সিমের সঙ্গে কিছু টাকা দেবে বলে সিম গ্রাহকের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে।
এ ছাড়া তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর সংগ্রহ করে এবং এই আঙুলের ছাপ দিয়ে একাধিক সিম রেজিস্ট্রেশন করে। এই চক্রগুলোর কাছ থেকে সাধারণ দামের থেকে কয়েক গুণ বেশি দামে সিম কেনে প্রতারকরা। এ কারণে প্রতারকের পরিচয় পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, ‘সিআইডির যে ট্রেসিং পদ্ধতি সেটা দিয়ে এরিয়া ট্রেসিং করা যায়। যেমন প্রতারক কোন এলাকায় আছে বা কোন টাওয়ারের আওতায় আছে। এছাড়া পিনপয়েন্ট করে প্রতারকের স্থান নির্ণয় করা সম্ভব। তবে পিনপয়েন্ট করার যে ব্যবস্থা আছে, সেটা খুব ব্যয়বহুল।
রাষ্ট্রীয় অপরাধ ছাড়া পিনপয়েন্ট ট্রেসিং ব্যবহার হয় না, তাই প্রতারক গ্রেপ্তার করতে ঝামেলায় পড়তে হয়। অনেক সময় ঢাকা থেকে টিম পাঠিয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রতারকরা অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলে। ফরিদপুরে আমাদের দল থাকলেও এ কাজের জন্য বিশেষজ্ঞ দল প্রয়োজন। আর এই বিশেষজ্ঞ দল ঢাকায় আছে শুধু।
প্রতারণার শিকার হয়েও মামলা বা অভিযোগে অনীহা : বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তা ধর বলেন, প্রতারকরা গ্রাহকদের কাছ থেকে ১ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেয়। সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ পেয়েছি। ভিকটিম হয়তো মনে করেন, মাত্র তো ২ হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু প্রতারণা করে দিনে ২-৩ লাখ টাকাও হাতিয়ে নেয় প্রতারক।
ভিকটিম আমাদের জানালে আমরা বিকাশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাদের বলি প্রতারক তথ্য নিয়েছে, আপনারা এ নম্বর থেকে ট্রানজেকশনটা বন্ধ করে দেন। টাকা ট্রানজেকশন হয়ে গেলে এটা বের করতে কঠিন হয়ে যায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভিকটিম অভিযোগ করেন না।
তিনি আরো বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা ছোট ছোট অঙ্কের টাকা প্রতারকের কাছে খোয়ান। এই অল্প টাকার কারণে তারা মামলা করেন না। সে কারণে অপারেশনও ওভাবে হয় না। ফলে প্রতারকরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য