ইমরান খান: পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যা মামলায় দেশ ছেড়ে পালানো আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম এখন দুবাই পুলিশের নজরদারিতে। তাকে সেখানে গ্রেপ্তারের গুঞ্জন উঠলেও সরকারের পক্ষ থেকে তা নাকচ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দুবাইয়ে নিজ ফ্ল্যাটেই নজরদারির মধ্যে আছেন আরাভ খান। এদিকে আরাফ খানকে ঢাকায় ফেরাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। আরাভ খানের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির আবেদন গ্রহণের বিষয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের পক্ষ থেকে বলা হলেও এখনো আরাভ খানের বিরুদ্ধে সেই নোটিশ জারি হয়নি।
বুধবার দুপুর পর্যন্ত ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে দুবাইয়ের আলোচিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের বিরুদ্ধে ‘রেড নোটিশ’ জারির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। রেড নোটিশের তালিকায় জাতীয়তা বাংলাদেশি সিলেক্ট করে সার্চ করার পর দেখা যায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদসহ মোট ৬২ জনের নাম রয়েছে।
একই সঙ্গে তাদের প্রত্যেকের অপরাধের ধরন, ঠিকানা, বয়স ও ছবি দেয়া রয়েছে। তবে এ তালিকায় আরাভ খান বা রবিউল ইসলাম নামে কেউ নেই। এরপর ‘ওয়ানটেড বাই বাংলাদেশ’ সিলেক্ট করে সার্চ করার পর ৪৭ জনের একটি তালিকা প্রদর্শিত হয়। সেখানেও নেই আরাভের নাম।
এদিকে পুলিশ পরিদর্শক মামুন হত্যা মামলায় ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে মামলার বাদী জাহাঙ্গীর আলম খানের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন করা হয়েছে। এ অবস্থায় আগামী ৪ জুন মামলার পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়েছে। চার বছর আগে গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার উলুখোলা এলাকার একটি জঙ্গল থেকে পুলিশ পরিদর্শক মামুনের হাত-পা বাঁধা বস্তাবন্দি পোড়া মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
সেই খুনের আসামি হয়ে দেশ ছেড়েছিলেন আরাভ খান। দেশ থেকে পালিয়ে তিনি প্রথমে ভারতে যান। কলকাতার একটি বস্তিতে কয়েক বছর বসবাস করার পর তিনি আরাভ খান নামে ভুয়া ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করে দুবাই চলে যান। এখন তিনি দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী।
সম্প্রতি দুবাইয়ে বাংলাদেশি স্বর্ণ ব্যবসায়ী বিতর্কিত আরাভ খানের স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন করার জন্য সেখানে যান ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, ইউটিউবার হিরো আলম ও নায়িকা দীঘিসহ আরো অনেক তারকা। এর পরই আলোচনায় আসে আরাভ খানের নাম। জানা যায়, সে আরাভ খানই পুলিশ পরিদর্শক মামুনের হত্যা মামলার আসামি।
এদিকে আরাভ খানের স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন করতে দুবাই যাওয়ার কারণে মামলার তদন্তের স্বার্থে ক্রিকেট আইকন সাকিব আল হাসান ও ইউটিউবার হিরো আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলে জানিয়েছিলেন ডিবিপ্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। এ বিষয়ে বুধবার কথা হয় হিরো আলমের সঙ্গে।
তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আমরা সেখানে গিয়েছি বলেই প্রশাসন জানতে পেরেছে যে সে-ই আরাভ খান। আর তিনিই (আরাভ) পুলিশ কর্মকর্তার হত্যা মামলার পলাতক আসামি। আমাদের কারণেই প্রশাসন তার সঠিক অবস্থান সম্পর্কে জানতে পেরেছে।’ দেশে ফেরার পর ডিবি পুলিশের কেউ যোগাযোগ করেছে কিনা এ বিষয়ে হিরো আলম বলেন, ‘আমার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কেউ যোগাযোগ করেনি।’
রাজধানীর বিভিন্ন থানায় বিভিন্ন মামলার নথি ঘেঁটে জানা যায়, আরাভ একসময় চুরি, ছিনতাই, অস্ত্র ঠেকিয়ে টাকা আদায়সহ নিজের মামলায় অন্য ব্যক্তি দিয়ে সাজা খাটানোসহ অসংখ্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নাম ব্যবহার করে এসব অপরাধ করে বেড়াতেন আরাভ। তার বিরুদ্ধে হত্যা, চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ ও অস্ত্র মামলাসহ অন্তত ৯টি মামলা রয়েছে।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন ইমরান খান খুন হন ২০১৮ সালের ৮ জুলাই। পরদিন গাজীপুরের জঙ্গল থেকে তার আধপোড়া মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় বাদী হয়ে রাজধানীর বনানী থানায় খুনের মামলা করেন মামুনের বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলম খান। মামলাটি তদন্ত করে পলাতক রবিউলসহ (আরাভ খান) ১০ জনের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ অভিযোগপত্র দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ।
আলোচিত এই হত্যা মামলার নথিপত্র বলছে, ফাঁদে ফেলে টাকা আদায় করতে টেলিভিশন অনুষ্ঠানের এক প্রযোজককে বনানীর একটি বাসায় ডেকে নেন আসামিরা। সেটি ছিল রবিউল ওরফে আরাভের কথিত অফিস। ওই প্রযোজকের ঘনিষ্ঠ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা মামুন। তিনি প্রযোজকের ডাকে ঘটনাস্থলে যান।
একপর্যায়ে সেখানেই পুলিশ কর্মকর্তা মামুনকে হত্যা করা হয়। পরে লাশ গোপন করার জন্য বস্তায় ভরে নিয়ে যাওয়া হয় গাজীপুরের জঙ্গলে। পরিচয় যাতে শনাক্ত না করা যায়, সে জন্য মরদেহটি পেট্রোল দিয়ে পোড়ানো হয়।
মামুন ইমরান খানকে খুনের পরই ঘটনাস্থল থেকে স্ত্রী কেয়াকে নিয়ে সটকে পড়েন রবিউল ইসলাম ওরফে আপন। পরে দেশ থেকে পালিয়ে প্রথমে ভারতে যান। সেখানে আরাভ খান নামে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে দুবাইয়ে চলে যান। মামলার অভিযুক্ত আসামি ১০ জন। এদের মধ্যে দুজন কিশোরী ।
রবিউলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ও তার স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার ধনী ব্যক্তিদের ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নিতেন। মামুন হত্যার ঘটনায় লাশ গোপন করতে সহায়তা করেছেন রবিউল । খুনে সরাসরি জড়িতরাও রবিউলের সহযোগী।
মামলাটিতে জামিন নিয়ে পলাতক রয়েছেন রবিউলের কথিত স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার কেয়া। কারাগারে রয়েছেন আসামি রহমত উল্লাহ (৩৫), স্বপন সরকার (৩৯), দীদার পাঠান (২১), মিজান শেখ (২১), আতিক হাসান (২১) ও সারোয়ার হোসেন (২৩) ।
মামলাটিতে ২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এরপর ২০২২ সালের ২৮ জুলাই মামলায় একজন সাক্ষীকে হাজির করে রাষ্ট্রপক্ষ। এর মধ্যে আর কোনো সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। গত বছরের ২০ ডিসেম্বর উচ্চ আদালত মামলাটি ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেন। সেটি বর্তমানে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল সাত্তার দুলাল বলেন, সাক্ষীদের আদালতে হাজির করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।
ডিবি জানিয়েছে, মামুন খুনের পর দেশ থেকে পালিয়ে রবিউল প্রথমে ভারতে যান। সেখানে আরাভ খান নামে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে দুবাইয়ে চলে যান। এদিকে তার সঙ্গে বাংলাদেশের সাবেক কোনো পুলিশ কর্মকর্তার সম্পর্ক রয়েছে বলে কথা উঠেছে। এরপর সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ তার এক ফেসবুক পোস্টে জানান, তিনি রবিউলকে চেনেন না, তার সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয়ও নেই তার ।
বিষয়টি নিয়ে সমপ্রতি চট্টগ্রামে আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, রবিউলের সঙ্গে পুলিশের ঊর্ধ্বতন সাবেক কোনো কর্মকর্তার সম্পর্কের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে । উপযুক্ত সময়ে তা জানানো হবে । তিনি আরো বলেন, পুলিশ হত্যা মামলায় যে নামে চার্জশিট হয়েছে, সেই নামে রেড নোটিশ জারির জন্য ইন্টারপোলকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ইন্টারপোল সেটি গ্রহণ করেছে।
রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে স্বর্ণ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। গত সপ্তাহে আরাভ জুয়েলার্স নামে দুবাইয়ে সোনার বড় দোকান চালু করে আবারো আলোচনায় আসেন তিনি।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য