-->
শিরোনাম

শাহজালালের কার্গোতে ভয়ংকর চুরি, শুল্ক ছাড়াই ডেলিভারি

রুদ্র মিজান ও ইমরান খান
শাহজালালের কার্গোতে ভয়ংকর চুরি, শুল্ক ছাড়াই ডেলিভারি

রুদ্র মিজান ও ইমরান খান: হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কঠোর নিরাপত্তাবলয়। তারপরও কার্গো কমপ্লেক্স থেকে চুরি হচ্ছে আমদানিকৃত পণ্য। চুরি যাওয়া পণ্য অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে শুল্ক ছাড়াই আমদানিকারকদের কাছে পৌঁছে দেন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা। ফলে প্রতি মাসে শত শত কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অন্যদিকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন বিমানের কার্গো হাউসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট।

 

২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অবতরণ করা একটি পণ্যের চালান রাখা হয় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো আমদানি কমপ্লেক্সে। কিন্তু পরে আর এই চালানটি নির্দিষ্ট স্থানে পাওয়া যায়নি। চলতি বছরের ২০ মার্চ এই চালানটি জালিয়াতির মধ্য দিয়ে ডেলিভারি হয়েছে মর্মে স্বীকার করে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত সার্কেল এয়ারফ্রেইট ঢাকার উপপরিচালককে একটি চিঠি দেন বিমান আমদানি পণ্য টার্মিনালের ব্যবস্থাপক, আমদানি (ভারপ্রাপ্ত) মো. রেজা খান।

 

এছাড়া সম্প্রতি জাল নথিপত্র দিয়ে ট্রলিতে করে বিমান গুদামঘর থেকে কোটি টাকার পণ্য চুরির ঘটনা ঘটে। শুল্কায়ন ও বিমানের হ্যান্ডলিং চার্জের কোনো নিয়ম না মেনে পণ্য নিয়ে যায় একটি সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট। সরকারের বিপুল টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে দিনদুপুরে ট্রলি ঠেলে পণ্য নিয়ে যায় তারা। এ বিষয়ে কার্গো কমপ্লেক্সের উপপরিচালক বরাবর লিখিতভাবে এ ঘটনার তদন্ত করতে ইতোমধ্যে নির্দেশ দিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

 

সেইসঙ্গে পণ্য চালানের অবস্থান জানতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ওয়্যার হাউস ইনচার্জের কাছে জানতে চেয়েছে ঢাকা কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ। এসব ঘটনার জন্য বিমানবন্দরে আমদানি-রপ্তানিতে কার্গো হ্যান্ডলিং ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং এজেন্ট হিসেবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে দায়ী করছেন কাস্টমস ও ব্যবসায়ীরা।

 

জানা গেছে, বিদেশ থেকে আমদানি করা সব পণ্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সের কার্গো হাউসে রাখা হয়। আর বিমানবন্দরের আমদানি-রপ্তানিতে কার্গো হ্যান্ডলিং ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং এজেন্ট হিসেবে এসব পণ্যের হেফাজতের দায়িত্ব বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের। অভিযোগ উঠেছে, বিমানের কিছু অসাধু জুনিয়র কর্মকর্তার যোগসাজশেই চুরি হচ্ছে কার্গো কমপ্লেক্সের হেফাজতে থাকা শত শত কোটি টাকার পণ্য। আর সেই চুরি যাওয়া পণ্য অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে শুল্ক ছাড়াই বুঝিয়ে দেয়া হয় আমদানিকারকদের। এর ফলে প্রতি মাসে শত শত কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অন্যদিকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন বিমানের কার্গো হাউসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট।

 

সূত্র বলছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সের এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ১২ জন জুনিয়র কর্মকর্তার একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। কার্গো আমদানি কমপ্লেক্সে আমদানিকৃত পণ্যগুলো দেখভাল করার দায়িত্ব বিমানের কার্গো শাখার জুনিয়র কমার্শিয়াল অফিসারদের। অথচ চুরি যাওয়া পণ্য নিয়ে কোনো তদারকি নেই তাদের। আর এসব অব্যবস্থাপনার কারণেই হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো হাউসে বাড়ছে চুরির ঘটনা।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের মালিক বলেন, বিমানের এসব জুনিয়র অফিসার অল্পদিনের মধ্যে একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট ও গাড়ির মালিক হয়েছেন। তাদের ছত্রছায়ায় কার্গো কমপ্লেক্সে রাখা শত শত কোটি টাকার পণ্য চুরি হচ্ছে। তা শুল্ক বা কোনোরকম কাগজপত্র ছাড়াই আমদানিকারকদের পৌঁছে দিচ্ছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দায়িত্বরত কিছু অসাধু সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চুরির পর শুল্ক ছাড়াই পণ্যের চালান বুঝিয়ে দেয়া হয় প্রকৃত আমদানিকারকদের। আবার অনেক ক্ষেত্রে চালানটি চুরি করে অন্যদের কাছে বিক্রি করে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে। এসব বিষয়ে মামলা হলেও কোনো প্রতিকার মিলছে না ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের।

 

জানা গেছে, কয়েক বছর আগে কার্গো কমপ্লেক্সে রাখা একটি পণ্যের চালান থেকে পাঁচটি মোবাইল ফোন চুরি হয়। এ বিষয়ে আমদানিকারক সংশ্লিষ্ট থানায় জিডি করেন। পরে বিমানের কার্গো কমপ্লেক্সের এক কমার্শিয়াল সুপারভাইজারের স্ত্রীর কাছ থেকে ওই পাঁচটি মোবাইল ফোনের একটি উদ্ধার করা হয়। এরপর গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন ওই কমার্শিয়াল সুপারভাইজার। তবে সম্প্রতি এই মোবাইল ফোন চুরির মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। এ ঘটনার কারণে গত চার বছরে কোনো পদন্নোতি পাননি ওই কমার্শিয়াল সুপারভাইজার ।

 

সূত্র বলছে, কার্গো কমপ্লেক্সে জুনিয়র কমার্শিয়াল অফিসার পদে কর্মরত ১২ কর্মকর্তার প্রত্যেকেই আট থেকে ১৩ বছর আগে বিমানের কার্গো শাখায় নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এদের অনেকেই এসব চুরির ঘটনায় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের সহযোগিতা করে থাকেন। বিগত ১৩ বছরেও তাদের কোনো বদলি হয়নি। পদোন্নতি হলেও দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন উপায়ে নিজেদের বদলি ঠেকাচ্ছেন এসব কর্মকর্তা। যদিও নিয়মিত বদলি বিমানের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই বর্তমান বিমান শ্রমিক লীগ কার্গো শপ কমিটির বিভিন্ন পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। বিমান শ্রমিক লীগকে ব্যবহার করে এই সিন্ডিকেট রোস্টার বাণিজ্য, মালামাল চুরিসহ বিভিন্ন অবৈধ কার্যক্রম চালাচ্ছে দিনের পর দিন। এতকিছুর পরেও শক্তিশালী এই সিন্ডিকেটের সবাই বহাল তবিয়তে রয়েছেন এক যুগ ধরে।

 

এক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগে নিষিদ্ধ হওয়া সাবেক ক্রিকেটার শরীফুল হক প্লাবনও রয়েছেন এই সিন্ডিকেটে। কার্গো ভিলেজে জুনিয়র কমার্শিয়াল অফিসার পদে কর্মরত রয়েছেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে ফিক্সিংয়ের বিষয়টি গোপন করে বিমানে চাকরি করছেন এই সাবেক ক্রিকেটার। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে শুল্ক গোয়েন্দাসহ আরো কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে প্লাবনসহ এই সিন্ডিকেটের জড়িত থাকার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে শরীফুল হক প্লাবনের সাথে কথা হলে এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, আমি এসব ঘটনার সাথে কোনোভাবেই জড়িত না। এছাড়া ফিক্সিংয়ের ঘটনায় বিসিবি থেকে আমার নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি বিমানের এমডিসহ সকল কর্মকর্তাই জানেন বলেও দাবি করেন তিনি।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কার্গো কমপ্লেক্সে কর্মরত চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারী বলেন, জুনিয়র কমার্শিয়াল অফিসারদের কথা না শুনলে তারা রোস্টার পরিবর্তন করে আমাদের হয়রানি করে। এজন্য সবকিছু জানার পরও আমাদের মুখ বন্ধ রাখতে হয়। শাহজালাল বিমানবন্দরে হওয়া চুরি ও বদলি এবং রোস্টার বাণিজ্যসহ অন্যান্য বিষয়ে জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উর্ধতন কর্মকর্তাদের কেউই কথা বলতে রাজি হননি। রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিও (অতিরিক্ত সচিব) শফিউল আজিমের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তার পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

 

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক, প্রশাসন ও মানবসম্পদ (উপসচিব) মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, বলাকার প্রশাসনিক বিভাগের সঙ্গে কার্গো বিভাগের কোনো সম্পর্ক নেই। কার্গো বিভাগ সরাসরি মার্কেটিংয়ের সঙ্গে কাজ করে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা চুরির বিষয়গুলো তদন্তাধীন রয়েছে বলে শুনেছি। এর বেশি কিছু জানতে হলে কার্গো কমপ্লেক্সের মহাব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।

 

বিমানের কার্গো কমপ্লেক্সের মহাব্যবস্থাপক মো. রাশেদুল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। বিষয়টি জানার পর তিনি তা এড়িয়ে যান।

 

এদিকে কার্গোতে চুরির সঙ্গে জড়িত এত দীর্ঘ সময় একই বিভাগে কীভাবে বহাল রয়েছেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে বিমান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) জুলফিকার আলী বলেন, মার্কের্টিং অ্যান্ড সেলসের সেন্ট্রাল অ্যাডমিন সেলে আমি কর্মরত। এখানে কর্মকর্তাদের ছুটি, অ্যাটেন্ডেন্টস বিষয় নিয়ে কাজ করা হয়। তবে কোন কর্মকর্তাকে কখন বদলি করা হবে, সে বিষয়ে প্রত্যেক বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বদলি করা হয় বলে জানান তিনি।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version