-->

বঙ্গবাজারে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি

রুদ্র মিজান
বঙ্গবাজারে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি

রুদ্র মিজান: বঙ্গবাজার রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী পুরোনো মার্কেট। কাঠ ও টিনশেডের মার্কেটটি সম্প্রতি আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে। দীর্ঘদিনের এই পুরোনো মার্কেটটিতে ছিল অপরিকল্পিত দোকানঘর। সুরক্ষার কথা না ভেবেই মার্কেটের যত্রতত্র গড়ে তোলা হয়েছিল অবৈধ দোকান। বঙ্গসহ বেশ কয়েক মার্কেটের দোকান থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায়ের অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

 

যে কারণে পরিকল্পিতভাবে মার্কেটগুলো অগ্নিনিরাপত্তাসহ আধুনিকায়ন করা সম্ভব হয়নি। মূলত বছরের পর বছর প্রভাবশালীদের অর্থ জোগানের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এই মার্কেট। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে নিয়ন্ত্রকও পাল্টেছে। এসব মার্কেটের প্রতি ইঞ্চি জায়গা ভাড়া দেয়া হয় চড়া দামে।

 

বঙ্গবাজার মার্কেটে রয়েছে মোট চারটি ইউনিট। বঙ্গবাজার শপিং কমপ্লেক্স ছাড়াও এর অংশ হিসেবে রয়েছে গুলিস্তান, মহানগর ও আদর্শ ইউনিট। এর বাইরে রয়েছে অ্যানেক্সকো এবং মহানগর কমপ্লেক্স। তবে শেষের দুটি মার্কেট বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের আওতাভুক্ত নয়।

 

বঙ্গবাজার আগুনে পুড়ে গেলেও অন্যান্য মার্কেটের চাঁদাবাজি থেমে নেই। গুলিস্তানের সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেট, ফুলবাড়িয়া মার্কেট, রেলওয়ে সুপার মার্কেটের আশপাশে অবৈধভাবে গড়ে তোলা প্রতি দোকান থেকে দৈনিক ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়।

 

মার্কেটের ভেতরেও নানাভাবে অবৈধ তৈরি দোকানের পজিশন বিক্রি করে চাঁদাবাজ চক্র। পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে সিটি করপোরেশনের নিবন্ধিত দোকান ছিল ৮৬৩টি। একইভাবে গুলিস্তান মার্কেটে ৬শ, মহানগরী মার্কেটে ৫৯৯, আদর্শ মার্কেটে ৬৭১ এবং ঢাকা সুপার মার্কেটে নিবন্ধিত দোকান ৮০২। এছাড়া অবৈধ দোকান ছিল ২০৯টি। পাঁচ মার্কেটের মোট ৩ হাজার ৭৪৪টি দোকান থেকে প্রতি মাসে ৩০০ টাকা করে চাঁদা নিত মালিক সমিতি।

 

এই হিসাব অনুসারে প্রতি মাসে ১১ লাখ ২৩ হাজার ২০০ টাকা এবং বছরে ১ কোটি ৩৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করা হতো। এছাড়া সিঁড়ির নিচে, গলির সরু পথে বসানো অবৈধ ২০৯টি দোকান থেকে কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা করে ভাড়া আদায় করা হতো। যার পরিমাণ বছর শেষে প্রায় দেড় কোটি। অন্যান মার্কেটেরও অভিন্ন অবস্থা।

 

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার কাছে লিখিত অভিযোগ রয়েছে এই মার্কেটগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে চাঁদাবাজি করছেন যুবলীগের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের বহিষ্কৃত সভাপতি শাহাবুদ্দিন, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক যুবদল নেতা হাছান মাহমুদ এবং শাহজালাল সোহেল। এদের সিন্ডিকেটে নিয়াজ মুর্শেদ জুম্মন নামের এক যুবদল নেতাও রয়েছেন।

 

রাজধানীর সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেট মালিক সমিতির নেতারা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের বহিষ্কৃত সভাপতি শাহাবুদ্দিন ও ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি নিয়াজ মুর্শেদ জুম্মনের বিরুদ্ধে একাধিকবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র, ডিএমপি কমিশনার, র‌্যাবের ডিজি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ করেছে মার্কেট কমিটি। কিন্তু প্রতিকার মেলেনি।

 

অভিযোগে বলা হয়, মার্কেটের অবৈধ দোকান বৈধ করে দেয়া ও উচ্ছেদ ঠেকানোর কথা বলে বিভিন্ন সময় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদার টাকা নেন তারা। তাছাড়া অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রেলওয়ে সুপার মার্কেটের বর্তমান নির্বাচিত কমিটির নেতাদেরও তারা মার্কেট থেকে বের করে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মার্কেটে চাঁদাবাজিসহ নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িত থাকায় যুবলীগের পদ খুইয়েছেন শাহাবুদ্দিন। অবৈধ দোকান বিক্রি ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে বিপুল সম্পত্তির মালিকও হয়েছেন তিনি। বিষয়টি জানতে পেরে তার কাছে সম্পদের হিসাব চেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এছাড়া তার বিরুদ্ধে দখলবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে বংশাল থানা, শাহবাগ থানা ও আদালতে মামলা রয়েছে। এ সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা শাহজালালের বিরুদ্ধে মাদকের মামলা রয়েছে।

 

ব্যবসায়ীরা বলছেন, শাহাবুদ্দিনের নির্দেশ ছাড়া বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে কোনো কাজ হয় না। দোকান বিক্রি থেকে শুরু করে ভাড়া, সব কিছুই চলে শাহাবুদ্দিনের ইশারায়। একইভাবে গুলিস্তানের সুন্দরবন স্কোয়ার মার্কেটের একক আধিপত্যও এই শাহাবুদ্দিনের। শাহাবুদ্দিনের দখলদার কার্যক্রম গুলিস্তানের বিভিন্ন মার্কেটে সীমাবদ্ধ থাকলেও ২০২০ সাল থেকে এই মার্কেটগুলোতে প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। এ নিয়ে হামলা-মামলার ঘটনাও ঘটে। তবে এর পরই শক্ত অবস্থান গেড়ে বসেন তিনি।

 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের দু’জন ব্যবসায়ী বলেন, ২০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সভাপতি মো. শাহাবুদ্দিন গুলিস্তানের মার্কেটপাড়ার অঘোষিত গডফাদার। এমন কোনো মার্কেট নেই যে মার্কেটে প্রভাব নেই শাহাবুদ্দিনের।

 

বঙ্গবাজারের আদর্শ ইউনিট মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক হলেও মহানগর, বঙ্গ, গুলিস্তান ইউনিটেরও নিয়ন্ত্রণ শাহাবুদ্দিনের হাতে। পাশাপাশি সাবেক যুবদল নেতা হাছান মাহমুদ এবং শাহজালাল সোহেল ও ঢাকা দক্ষিণের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি নিয়াজ মুর্শেদ জুম্মন এসব অপকের্মর মূলহোতা।

 

২০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও রেলওয়ে সুপার মার্কেট কমিটির কোষাধ্যক্ষ রফিক বলেন, হাছান মাহমুদ বিএনপি করত। বিএনপি সরকারের আমলেও সে গুলিস্তানের বিভিন্ন মার্কেটে চাঁদাবাজি ও দখলবাজি করত। বিএনপির পতনের পর নিজের দখল বাজি অব্যাহত রাখতে সে আবার আওয়ামী লীগে যোগ দেয়। এখন তার অত্যাচার থেকে আওয়ামী লীগের নেতা ও সাধারণ মানুষ কেউই রক্ষা পাচ্ছে না। যেখানে সুযোগ পায় সেখানেই দোকান দখল করছে।

 

তিনি বলেন, শাহবুদ্দিন ও তার লোকজন ফুলবাড়িয়া ও বঙ্গবাজার এলাকার চারটি মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করে। ফুলবাড়িয়াতে প্রায় ৪০০ দোকান অবৈধভাবে তৈরি করে সে বিক্রি করেছে। বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরাও তাকে টাকা না দিয়ে ব্যবসা করতে পারে না। এছাড়া হাছান মাহমুদ পুরান বাজার, পোড়া মার্কেট ও আন্ডার গ্রাউন্ড মার্কেটের চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন হাছান মাহমুদ। যখন সাঈদ খোকন মেয়র ছিলেন তখন এসব মার্কেটে ৬০০-এর মতো দোকান বানিয়ে বিক্রি করেছেন হাছান মাহমুদ।

 

একেকটা দোকান ১০ লাখ থেকে শুরু করে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন। সমবায় মার্কেটের বাইরেও অবৈধভাবে হাছান ও তার লোকজন অনেক দোকান ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেছিল। পরবর্তীতে মার্কেটটি ভেঙে ফেলা হয়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা তাদের জমা দেয়া টাকা আর ফেরত পাননি। হাছান মাহমুদ বলেন, তিনি কখনো এসব মার্কেটেই পা ফেলেননি। এসব মার্কেটের চাঁদাবাজির সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

 

রাজনৈতিক কারণে এসব অভিযোগ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। একইভাবে শাহাবুদ্দিন বলেন, আমি একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসার বাইরে আমি রাজনীতি করি। চাঁদাবাজি বা দখলবাজি আমার কাজ না। যেসব মামলা করা হয়েছে তা মিথ্যা দাবি করে তিনি বলেন, মামলাগুলো আমি লড়ছি। আশা করি শিগগিরই এসব অপবাদ থেকে অব্যাহতি পাব। হাছান মাহমুদ সম্পর্কে তিনি বলেন, হাছান মাহমুদও সমবায় সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী। তবে তিনি কখনো বিএনপি করেননি।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version