-->
শিরোনাম

অপরাধের ধরন পাল্টে ভয়ংকর কিশোর গ্যাং

রুদ্র মিজান
অপরাধের ধরন পাল্টে ভয়ংকর কিশোর গ্যাং

রুদ্র মিজান: ঈদ, রমজান, নববর্ষ, থার্টিফাস্ট নাইটের নামে চাঁদাবাজি করে তারা। চাঁদার ধরন অভিযোগ করার মতো নয় মোটেও। বড় ভাই সালাম দিছে, সামনে পার্টি... কিংবা কাকা সালামি কই? এভাবেই নীরবে চাঁদাবাজি করছে উঠতি বয়সি ছেলেরা। রাজধানীর পাড়ায় পাড়ায় রয়েছে এরকম গ্যাং। ‘গ্যাং কালচারের’ নামে রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় উঠতি বয়সিদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে। শুরুতে আড্ডা, পার্টি বা রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার মতো অপরাধে যুক্ত থাকলেও এখন তা বিস্তৃত হয়েছে ভয়ংকরভাবে। আধিপত্য বিস্তার থেকে শুরু করে জবরদখল ও মাদকবাণিজ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে কিশোরদের। ঈদ উপলক্ষে ‘সালামি’র নামে নীরবে চাঁদাবাজি করছে এসব গ্যাং। এরকম শতাধিক গ্যাংয়ের তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। এসব গ্যাংয়ের সদস্য ৭০০ থেকে ৮০০। কিশোর গ্যাং সদস্যেদের ব্যবহার করে ফয়দা নিচ্ছেন স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণকারী অর্ধশত ব্যক্তির তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে।

 

২০১০ থেকে রাজধানীতে কিশোর অপরাধের কারণে মামলা হয়েছে প্রায় অর্ধশত। যার মধ্যে একটি মামলার বিচারকাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে। সম্প্রতি মিরপুরের বাউনিয়াবাদ এলাকায় শাহীন নামে এক ব্যবসায়ীর কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে কিশোর গ্যাং আশিক বাহিনীর সদস্যরা। এ সময় চাঁদার টাকা না পেয়ে প্রকাশ্যে তাকে চাপাতি ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া করে কিশোর গ্যাং সদস্যরা। গ্যাংয়ের প্রায় ১০-১২ জন সদস্য মিলে ধারালো ছুরি দিয়ে তাকে উপর্যুপরি আঘাত করে। এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পরে মামলা হলে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। স্থানীয় নেতা ও বড়ভাইদের ছত্রছায়ায় এলাকায় দাপিয়ে বেড়ায় এই আশিক বাহিনী। রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং থেকে শুরু করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কাজেও ব্যবহার করা হয় তাদের।

 

গ্যাং কালচারের শিকার হয়ে ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো প্রাণ হারায় উত্তরা ট্রাস্ট কলেজের ছাত্র আদনান। জানা গেছে, সম্প্রতি র‌্যাবের বিরুদ্ধে একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বক্তব্য দেয়া নাফিজের গড়ে তোলা কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যদের হাতেই খুন হয়েছিল আদনান। সেই মামলার এজাহারভুক্ত ৯ নম্বর আর চার্জশিটের ২ নম্বর আসামি নাফিজ। সম্প্রতি নিজ বাসা থেকে মাদকসহ গ্রেপ্তার হন নাফিজ। ঢাকার প্রবেশদার টঙ্গী এলাকায় কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইবাজদের নিয়ন্ত্রণ করে রাসেল মিয়া, সুমন মোল্লাহ, মিন্টু, ইউসুফ, কাইয়ুম, পল্লান। সোহেল রানার ছত্রছায়ায় টঙ্গী-গাজীপুরে এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা হচ্ছে। মাঝেমধ্যে এ গ্রুপের সদস্যরা আটক হলেও তদবিরে তাদের তাৎক্ষণিক ছাড়িয়ে আনেন সোহেল রানা। টঙ্গী থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক পরিচয়ে ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে এসব অপকর্ম করেন বলে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, তুরাগপাড়কে ঘিরে গড়ে ওঠা এই টঙ্গী শহরকে মাদকের আখড়ায় পরিণত করেছে এই কিশোর গ্যাং। শুধু মাদক নয়- হত্যা, চাঁদাবাজি ও ছিনতাই মামলার একাধিক আসামি রয়েছে সোহেল রানার গ্যাংয়ে। নিজেরা কিশোর না হলেও কিশোরদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলে নানা অপকর্ম করায় এ বাহিনী। সোহেল রানার আশীর্বাপুষ্ট এই কিশোর গ্যাংয়ের বেপরোয়া মাদক সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে একপ্রকার জিম্মি হয়ে পড়েছে স্থানীয়রা। প্রতিবাদ করলেই নেমে আসছে নির্যাতন। এমনকি তাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়নি সাংবাদিকও। সম্প্রতি স্থানীয় এক সাংবাদিক কিশোর দিয়ে মাদক ব্যবসা চালানোর বিষয়ে প্রতিবাদ করলে তাকেও দেয়া হয় হত্যার হুমকি। এ বিষয়ে থানায় ও পুলিশ সদর দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে।

 

সোহেল রানার বাহিনীতে টঙ্গী এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী, ছিনতাইকারী এমনকি হত্যা মামলার আসামিও রয়েছে। এদের মধ্যে সুমন মোল্লার বিরুদ্ধে মাদক, ছিনতাইসহ তিনটি ও নাজমুলের বিরুদ্ধেও অন্তত চারটি মামলা রয়েছে। ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের চিহ্নিত সন্ত্রাসী হুমায়ুন একটি হত্যা মামলাসহ তিনটি মামলার আসামি। একই এলাকার একাধিক মামলার আসামি ইউসুফ, কাইল্যা সাগর, রনি, জুয়েল ও জীবন রয়েছে তার গ্রুপে। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ চারটি করে মামলা রয়েছে। এই গ্রুপের সদস্যরা বয়সে অনেকেই তরুণ-যুবক। তারা মাদক ব্যবসার পাশাপাশি উত্তরা, গাজীপুর ও টঙ্গীতে ছিনতাইকারীদের নিয়ন্ত্রণ করে।

 

সম্প্রতি সোহেল রানা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছেন মো. রিয়াল নামের এক ফিশারি। অভিযোগে বলা হয়, গেল বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর দখলের উদ্দেশ্যে ও সোহেল রানার নির্দেশে প্রায় ৫০ জন সন্ত্রাসী তার মৎস্য খামারের ভেতরে থাকা ২,৫০,০০০ টাকার মাছের খাবারে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় পাশে থাকা এক নারীর মুদি দোকেনও তারা আগুন ধরিয়ে দেয়। এ বিষয়ে স্থানীয় পুলিশের সহযোগিতা না পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে অভিযোগ করা হয়। এছাড়া সোহেল রানা ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ওপর ভর করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এমন অভিযোগ করে দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, গৃহশিক্ষক থেকে মাত্র কয়েক বছরে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন তিনি। এমনকি টঙ্গীর বিভিন্ন এলাকায় ফ্ল্যাট ও ডাইং ফ্যাক্টরি গড়ে তুলেছেন।

 

২০১৯ সালের ২৪ মার্চ টঙ্গীতে দেশীয় অস্ত্রসহ চারজনকে আটকের পর থানা থেকে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছিল। ওই রাতে স্থানীয় নোয়াগাঁও এলাকায় দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে সোহেল রানার অফিসে অভিযান চালায় পুলিশ। দখলবাজিতেও সোহেল রানা ও তার নিয়ন্ত্রণাধীন কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য কম নয়। টঙ্গীর দত্তপাড়া ব্র্যাক টাউন এলাকায় কাউন্সিলর নুরুল ইসলাম নুরুর পৈতৃক সম্পত্তি জোরপূর্বক দখলের চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

 

এ ব্যাপারে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৪৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুরুল ইসলাম নুরু বলেন, গত ৩০ ফেব্রুয়ারি জমিটি দখলের পর সোহেল রানা তার লোকজন নিয়ে তার জমিতে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু করে। পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের কাজ বন্ধ করেছে পুলিশ। সোহেল রানার সঙ্গে একাধারে কয়েকদিন যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি খুদেবার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version