মোতাহার হোসেন: বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গিয়ে চুরি, ছিনতাই, রাহাজানিসহ নানা অপরাধ-অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। ফলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। তাদের এরকম কর্মকান্ডে বিব্রত সরকার এবং বিদেশে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট মিশন।
জানা গেছে, রোহিঙ্গারা অতিসহজে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে সৌদি আরব, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। পাসপোর্ট অধিদপ্তরের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, মেম্বার, পুলিশসহ স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় জাল সনদসহ প্রয়োজনীয় কাজপত্র দিয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরি করছে তারা।
সম্প্রতি হযরত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশি পাসপোর্টসহ আটক তিন রোহিঙ্গার কাছ থেকে এ তথ্য মিলেছে। সৌদি আরব যাওয়ার চেষ্টাকালে আটক ওই তিন রোহিঙ্গা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এ তথ্য প্রকাশ করেছে বলে ইমিগ্রেশন পুলিশ, এসবির পাসপোর্ট শাখা ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিশনের (পিবিআই) একাধিক ঊর্ধ্বতন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, রোহিঙ্গারা প্রথমে কক্সবাজারের স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলে। একপর্যায়ে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে টাকার বিনিময়ে তাদের সহায়তায় বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরি করতে যেসব কাগজপত্র দরকার, তার সবকিছুর ব্যবস্থা করেই পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন।
জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের পাসপোর্টসহ অন্যান্য কাগজপত্র দেখে অনেক সময়ে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা বিভ্রান্তিতে পড়েন। কারণ এসব পাসপোর্ট তৈরির আগে পুলিশ ভেরিফিকেশন করে। অনেক সময় এসব পাসপোর্ট ও প্রয়োজনীয় কাজপত্র দেখে বোঝার অবকাশ থাকে না যে, এসব কাগজপত্রও আসল না নকল। রহস্যজনক কারণে ভেরিফিকেশনে উতরে যায় তারা।
এমনকি পাসপোর্ট অফিস পর্যন্ত সবকিছু প্যাকেজ প্রোগ্রামের মতো চুক্তি করে তারা পাসপোর্ট হাতে পায়। নানা কৌশলে দালাল চক্রের মাধ্যমে বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে। ওইসব পাসপোর্টে তারা বাংলাদেশি পরিচয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ বিমানবন্দরে ধরাও পড়ছে।
ইমিগ্রেশনের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে জানান, সম্প্রতি উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে তিন যাত্রীর কথাবার্তা, আচরণ ও পাসপোর্ট দেখে সন্দেহ হলে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে। তাদের স্বীকারোক্তির তথ্যে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তদন্তে নেমেছে। জালিয়াতির মাধ্যমে তাদের নেয়া পাসপোর্ট বাতিল করার প্রস্তাব পাসপোর্ট অফিসে পাঠানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, আটককৃত তিন রোহিঙ্গার তথ্য ও স্বীকারোক্তি নেয়া শেষে তাদের বিমানবন্দর থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। গতকাল বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। ঈদের ছুটির কারণে ঘটনাটি প্রকাশিত হয়নি। গতকাল একজন ঊর্ধ্বতন অফিসারের সঙ্গে আলোচনায় তিনি ঘটনাটি জানিয়েছেন। এরপর খোঁজ নিয়ে নানা কাহিনী বেরিয়ে আসছে।
ইমিগ্রেশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিমানবন্দরে প্রায় সময় বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আটকা পড়েন। আবার অনেক রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে বিদেশে গেছেন। দেশে ফেরার সময় তারা আবার কাগজপত্র জাল করে আসেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) প্রধান বনজ কুমার মজুমদার গতকাল এ প্রতিবেদককে জানান, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কক্সবাজারের স্থানীয় কিছু লোকজনের সঙ্গে আত্মীয়ের সম্পর্ক গড়ে তুলে কৌশলে তাদের (দালাল) সহযোগিতায় কাগজপত্র সংগ্রহ করে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। পুলিশের কেউ তা ভেরিফিকেশন করতে গেলে বিভ্রান্তির শিকার হয়ে বা যেকোনোভাবে তদন্তে কাগজপত্র দেখে ছাড়পত্র দেন।
তবে শনাক্ত করার সময় কিছুৃ জালিয়াতি ধরা পড়ছে। কোনো কোনো রোহিঙ্গা জন্মসনদ, এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি) সবকিছু তারা অনিয়মের মাধ্যমে করে থাকে। এখন দেশে ডিজিটাল প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই প্রক্রিয়া পুরোপুরি চালু হলে জালিয়াতি কমবে বলে আশাবাদ তার।
পাসপোর্ট শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, শরণার্থী কিছু কিছু রোহিঙ্গা সদস্য জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে। এরপর অন্যান্য কাগজপত্র দেখিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে ঢাকার বাইরের বিভাগ ও জেলা থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে। এদের নির্দিষ্ট দালাল চক্র রয়েছে। তারাই সবকিছু করে দেয়। কাগজপত্র তৈরি থেকে পাসপোর্ট পর্যন্ত সবই প্যাকেজের আওতায় (টাকার বিনিময়ে) ম্যানেজ করা হয়। গ্রাম পর্যায়ে এসব জালিয়াতি বেশি হয়।
কিন্তু যে পাসপোর্ট করবে তার সঙ্গে কথা বললে শনাক্ত হয়ে যায়। এ ছাড়াও ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেয়ার সময় জালিয়াতি শনাক্ত হতে পারে। কিন্তু এই চক্র চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে সবকিছু অনিয়মের মাধ্যমে করে থাকে। এরপরও রোহিঙ্গারা মাঝেমধ্যে ধরা পড়ে বলে ওই কর্মকতা নিশ্চিত করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, সাধারণ নাগরিকরা পাসপোর্ট করতে গেলে পদে পদে নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। তার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে। এমনকি পুলিশ ভেরিফিকেশন করার জন্য অনেকেই তদবির করেন। এরপরও পাওয়া কষ্টকর। পাসপোর্ট অফিসে দালাল চক্রের সহায়তা নিতে গিয়েও বিপাকে পড়েন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট কীভাবে দ্রুত গতিতে হয়, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।
একবার পুলিশ ভেরিফিকেশন কিছুদিনের জন্য উঠিয়ে দেয়ার পর রোহিঙ্গারা ওই সুবিধা নিয়েছে। অনেকেই বিদেশে গিয়ে আবার ধরা পড়ছে।
এ ধরনের ঘটনা রোধে পাসপোর্ট অধিদপ্তর, পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বারদের আরো দায়িত্বশীল ও আন্তরিকতা প্রয়োজন।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য