-->
শিরোনাম

রাতের শহরে গতিদানব, ঘটছে দুর্ঘটনা

রুদ্র মিজান
রাতের শহরে গতিদানব, ঘটছে দুর্ঘটনা

রুদ্র মিজান: রাত গভীর হয়। নির্জন হতে থাকে সড়কগুলো। ফাঁকা শহরে রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন বাড়ে গাড়ির গতি। ট্রাক-পিকআপ আর ব্যক্তিমালিকানাধীন গাড়ির চালকরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন রাতের শহরে। বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে গতির প্রতিযোগিতায় নামে গাড়ি। বেশিরভাগ চালকই থাকেন মদ্যপ। যে কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। রাতের শহরে বেপরোয়া গতির এসব গাড়ি সামলাতে হিমশিম খান ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা।

 

গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকে ঢাকার বিভিন্ন বার। এসব বার ও তারকা হোটেলে রাতভর চলে নানা পার্টি। এসব পার্টিতে মদপান করে রাতের ফাঁকা শহরে বের হন একশ্রেণির তরুণ-তরুণী। গতকাল গভীর রাতে গুলশান-২ এলাকায় দেখা গেছে, কিছুক্ষণ পর পর ছুটে যাচ্ছে বিলাসবহুল গাড়ি। গাড়ির চালকের আসনে যারা বসেছিলেন তারা কিছুক্ষণ আগেই কিং ফিশার নামক বার থেকে বের হচ্ছিলেন মদ্যপ অবস্থায়। হাঁটতে হাঁটতে ঢলে পড়ছিলেন যেন। প্রত্যেকের ছিল একেকজন সঙ্গী।

 

একইভাবে গভীর রাত পর্যন্ত বনানী ও উত্তরার বারগুলো থেকে মদ্যপ তরুণ-তরুণীদের বের হতে দেখা যায়। গত ২৩ এপ্রিলের ঘটনা। গুলশানের একটি পার্টি থেকে মদপান করে ফেরার সময় দুর্ঘটনা ঘটান তরুণ-তরুণী। ওই রাতে মালিবাগ চৌধুরীপাড়া এলাকায় বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর অভিযোগে আটক হন একটি বেসরকারি বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদমান ও সারাবান তহুরা। রাস্তায় তাদের কালো রঙের ফিল্ডার গাড়ির ধাক্কায় আহত হন বেশ কয়েকজন।

 

একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের গাড়ি আটক করে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় রামপুরা থানা পুলিশ। এ সময় অতিরিক্ত মদপান করে প্রায় অচেতন অবস্থায় ছিলেন সারাবান তহুরা নামের তরুণী।

 

রামপুরা থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলাম জানান, আটকের পর থেকেই তারা পুলিশের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে থাকেন। তখন পুলিশ তাদের পাকস্থলী ধৌত করার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। ওই সময় সারাবান তহুরা নামের ওই তরুণী হাসপাতালে থাকা সবার সঙ্গে অস্বাভাবিক আচরণ করেন। পরে ওই যুগলের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হলে তাদের জেলহাজতে প্রেরণ করেন আদালত। রাজধানীতে মদপান করে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর ঘটনা অসংখ্য।

 

এই গতি ভয়ংকর। ভয়ংকর গতিতে বেশিরভাগ গাড়ি ছুটে যায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ও তিনশ ফিট রোডে। কোনো কোনো গতিদানব থামে হাতিরঝিল এলাকায়। কখনো কখনো হাতিরঝিলের ব্রিজে জড়ো হয়ে আড্ডায় মেতে ওঠেন এসব গাড়িতে আসা লোকজন। এছাড়াও পণ্য নিয়ে অল্প সময়ে গন্তব্যে পৌঁছার প্রতিযোগিতায় নামেন আরেক শ্রেণির চালক। রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত ঢাকা শহরের সড়কে থাকে ট্রাকের আধিপত্য। এই আট ঘণ্টায় রাজধানীতে দুর্ঘটনায় ৫০ শতাংশের বেশি হতাহত হন।

 

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ২০২২ সালে ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ৯ হাজার ৯৫১ জন নিহত হয়েছেন। আহত হন ১২ হাজার ৩৫৬ জন। যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানিয়েছে, দুর্ঘটনায় আক্রান্ত গাড়ির মধ্যে ২৮.৫৯ শতাংশ মোটরসাইকেল, ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ডভ্যান ও লরি ২৪.৫ শতাংশ, বাস ১৩.৯৫ শতাংশ, ব্যাটারিচারিত ইজিবাইক, ভ্যান ও রিকশা ১১.৪২ শতাংশ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যাচ্ছেন পথচারীরা।

 

রাতে দায়িত্ব পালনকারী ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরাও থাকেন বেপরোয়া ট্রাক আতঙ্কে। রাতের শহরের আতঙ্কের নাম ট্রাক। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় নিবন্ধিত ট্রাক রয়েছে ৮১ হাজার ৮৬৯টি, প্রাইভেটকার ৩ লাখ ৩২ হাজার ৯৩১টি। নিবন্ধন ছাড়া রয়েছে তার চেয়ে দ্বিগুণ। এ ছাড়াও প্রতিরাতে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় অন্তত অর্ধলক্ষাধিক ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও পিকআপ যাতায়াত করে।

 

ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সাধারণত তিন হাজার কেজি ওজনের বেশি গাড়িগুলো রাত ১০টার আগে শহরে ঢোকার নিয়ম নেই। তারপরও রাত ৮টার পরেই এই গাড়িগুলো ডিএমপি এলাকায় ঢুকতে শুরু করে। তখনই যানজটের সৃষ্টি হয় ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে। আব্দুল্লাহপুর, গাবতলী, কাঁচপুর, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, মাওয়া সড়কে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। ওই সময়েও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে এসব এলাকায়।

 

ডিএমপির তেজগাঁও জোনে দায়িত্ব পালনকারী সার্জেন্ট দুর্জয় জানান, রাতে ফাঁকা সড়কে কিছু প্রাইভেট গাড়ি ও ট্রাক বেপরোয়া গতিতে চলে। গভীর রাতে ট্রাকচালকরা নিয়ম-নীতির পরোয়া করেন না। ট্রাক চলাচলে পুলিশের বেঁধে দেয়া গতিসীমা ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। কিন্তু বাস্তবে ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে দেখা যায়। বেপরোয়া গতিতেই রাজধানীর বিভিন্ন মোড় পার হয় ট্রাকগুলো।

 

এ সময় ঝুঁকির মধ্যে থাকে ছোট যানবাহনগুলো। রাতে সাধারণত ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা থাকে অল্প। ঢাকার সড়কের বিশেষ মোড়গুলোতে ট্রাফিক পুলিশ তখন দায়িত্ব পালন করেন। অনেক ঝুঁকি নিয়ে তখন ট্রাফিক পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে হয় বলে জানান সার্জেন্ট দুর্জয়।

 

ডিএমপির ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মীর রেজাউল আলম বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে। তবে শুধু আইন প্রয়োগে এটা হয়তো সম্ভব নয়। এজন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। সচেতনতা সৃষ্টি করতে ট্রাফিক পুলিশ কার্যক্রম চালাচ্ছে। এজন্য সমাজের সবাইকে সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

 

ঢাকা মেট্রোপলিটনের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, বেপরোয়া গতিসহ আইন অমান্য করলেই ব্যবস্থা গ্রহণ করছে পুলিশ। অনেক ঝুঁকি নিয়েই দিনে-রাতে ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে। তারপরও দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনায় অকালে অনেক প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। অনেকে সারাজীবনের মতো পঙ্গু হচ্ছে। তাই পুলিশের পাশাপাশি প্রতিটি মানুষকে এসব বিষয়ে সচেতন হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version