রুদ্র মিজান: বিস্ময়কর ঘটনা। এক পলকে দেখা মানুষটি মুহূর্তেই বাধ্য হয়ে যায়। অনুগত দাসের মতোই। যা নির্দেশ করা হবে তাই পালন করবে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমন ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। এরকম ঘটনার শিকার রাজধানীর পল্টনের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মেহেদি হাসান। রাত ৯টার দিকে ফকিরাপুল হয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় যাচ্ছিলেন তিনি। এর মধ্যে পথ আগলে দাঁড়ান এক যুবক।
মেহেদির কাছে গিয়ে হাত নাড়িয়ে-নাড়িয়ে কিছু একটা বলেন তিনি। তারপর মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওই যুবকের পিছু পিছু হাঁটতে থাকেন মেহেদি। যুবকের সঙ্গে পাশের গলিতে আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিলেন, এমনটি দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শী কেউ কেউ। তারপর একসময় ওই এলাকা থেকে প্রায় অচেতন অবস্থায় মেহেদিকে উদ্ধার করেন আশপাশের লোকজন। ততক্ষণে তার মানিব্যাগটি হাওয়া হয়ে গেছে।
মেহেদির মতে, ঝামেলা এড়াতে এ নিয়ে তিনি থানা পুলিশমুখো হননি। এভাবে প্রায়ই কিছু বুঝে ওঠার আগে সর্বস্ব হারাচ্ছেন অনেকে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ডেভিল ব্রেথ বা শয়তানের নিশ্বাসের কবলে ঘটছে এরকম ঘটনা। একশ্রেণির অপরাধী ব্যবহার করছে এই হেলুসিনেটিক ড্রাগ। রাসায়নিকভাবে এটি স্কোপোলামিন নামে পরিচিত। নিশ্বাসের সঙ্গে এটি ভেতরে যাওয়া মাত্রই আক্রান্ত ব্যক্তি দাসে পরিণত হন। প্রতারক হয়ে যান মালিক। মালিক যা আদেশ করেন দাসের মতোই তা পালন করেন আক্রান্ত ব্যক্তি।
এই ডেভিল চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে যশোরের গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের মধ্যে তিনজন ইরানি নাগরিক। ঘটনাটি ঘটে গত ৫ মে রাতে। যশোর শহরের হাটখোলা রোড ও ঢাকার ভাটারা এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলাল হোছাইন জানান, এই শয়তানের নিশ্বাসের শিকার হয়েছেন যশোরের অভয়নগর উপজেলার বর্ণী হরিশপুর বাজারের ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম। ঘটনার দিন একটি প্রাইভেট কার থেকে নেমে তিন-চার ব্যক্তি তার দোকানে যান। তারা প্রায় সবাই আরবিতে কথা বলেন। দোকান থেকে নারকেল তেল কেনেন তারা। শরিফুলের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেন। মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে তার মুখের কাছে নিতেই ঘটে মূল ঘটনা।
তারা যা বলেন শরিফুল অনুগত দাসের মতোই তা করতে থাকেন। এরপর দোকানে থাকা নগদ প্রায় ছয় লাখ টাকা তাদের হাতে তুলে দেন শরিফুল। পরবর্তীতে শরিফুলের ছেলে বাদী হয়ে অভয়নগর থানার মামলা করেন।
ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও প্রাইভেটকারের রেজিস্ট্রেশন নম্বরের সূত্র ধরে জড়িতদের নাম-ঠিকানা শনাক্ত করে ডিবি পুলিশ। গত ৭ মে রাতে ঢাকার ভাটারা এলাকায় অভিযান চালিয়ে খোরশেদ আলম ও সাইদুল ইসলাম বাবু নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত ইরানি নাগরিক খালেদ মাহবুবী, ফারিবোর মাসুফি ও সালার মাহবুবীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা দীর্ঘদিন থেকে শয়তানের নিশ্বাস ব্যবহার করে প্রতারণা করছিল।
চলতি বছরের শুরু থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে শয়তানের নিশ্বাসে ব্যবহারের তথ্য পাওয়া গেছে। জানুয়ারি মাসের শেষের দিকের ঘটনা। অনলাইনে পুরাতন ফ্রিজ বিক্রির বিজ্ঞাপন দেন রাজধানীর মাদারটেক আজিজ স্কুল মহল্লার বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম। ফ্রিজ কেনার নামে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে ওই বাসায় যান দুই জন। তার আগে একই কারণে মনোয়ারার বাসায় গিয়েছিলেন পুরুষ ব্যক্তি। স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে বাসায় থাকা নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার ওই নারীর হাতে তুলে দেন মনোয়ারা নিজেই।
এমনকি যাওয়ার সময় তাদের এগিয়েও দেন তিনি। কিছু সময় পর পরিবারের অন্য সদস্যরা বাসায় গেলে সবকিছু এলোমেলো দেখে তাকে প্রশ্ন করতেই তিনি জ্ঞান হারান।
জানা গেছে, এই ডেভিলের নিশ্বাস ওষুধ হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকায় রয়েছে। রোগীকে অপারেশনের আগে অজ্ঞান করতে এটা ব্যবহার করা হয়। হেলুসিনেটিক এই ড্রাগ মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। দুর্বৃত্তরা লোকজনকে অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুটে নিতে এটি ব্যবহার করছে। এটি মাদক হিসেবে বা হেলুসিনেটিক ড্রাগ হিসেবে বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। চিকিৎসকরা জানান, এর ক্ষতির মাত্রা কোকেন থেকে বহুগুণ বেশি।
নানাভাবে ও নানা কৌশলে এটির অপপ্রয়োগ হচ্ছে। যেমন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে, ঘ্রাণের মাধ্যমে, খাবারের সঙ্গে, চিরকুটের মাধ্যমে, কোমল পানীয়ের সঙ্গে। এটি তরল ও শুকনো দুই ফরমেটেই পাওয়া যায়। ১০-১২ ইঞ্চি দূরত্বে থাকলেই শ্বাসের মাধ্যমে এটি মানবদেহে প্রবেশ করে। এটির কার্যকর সময় ১০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা পর্যন্ত। তবে খাবারের সঙ্গে খাওয়ালে এর প্রতিক্রিয়া থাকে কয়েক দিন পর্যন্ত।
চিকিৎসকরা জানান, স্কোপোলামিন বা শয়তানের নিশ্বাস শরীরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ভুক্তভোগী অনেকটা যন্ত্রের মতো হয়ে যান। তার আচরণ হয়ে যায় বশীভূত বা সুতায় বাঁধা পুতুলের মতো। তীব্র হেলুসিনেশন শুরু হয়। অন্যের দেয়া আদেশকে যান্ত্রিকভাবে অনুসরণ করতে থাকেন তিনি। এতে মানুষের মস্তিষ্কের প্রাথমিক স্মৃতি ব্লক হয়ে যায়। আক্রান্ত ব্যক্তি আক্রমণকারীকে দেখতে পেলেও চিনতে পারেন না। কিছু মনে রাখতে পারেন না।
এ বিষয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ডেভিল ব্রেথে আক্রান্ত হয়ে সর্বস্ব হারানোর তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে। আমরা এই চক্রের অনুসন্ধান করছি। এই চক্রে যারা তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান তিনি।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য