রুদ্র মিজান: কেএনএফ বা কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি। পাহাড়ের এক আতঙ্কের নাম। পাহাড়ে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, জিম্মি থেকে শুরু করে নির্বিঘ্নে খুন-খারাবি করছে বিচ্ছিন্নতাবাদী এ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। মঙ্গলবার বান্দরবানের রুমায় কুকি চিন সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হয়েছেন সেনাবাহিনীর দুই সদস্য। পাহাড়ে স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের দাবিতে দীর্ঘদিন থেকেই নানা ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে যাচ্ছে এ সশস্ত্র সংগঠনের সদস্যরা।
বাংলাদেশ সরকার তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহিৃত করেছে। কিন্তু কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। পাহাড়ের গভীর অরণ্যে আস্তানা গড়েছে তারা। সেখানেই দেয়া হয় প্রশিক্ষণ। যৌথ বাহিনীর অভিযানের ফলে ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করছে। দুর্গম পাহাড়ে অবস্থানের কারণে সহজেই এ সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না।
তবে অভিযান চালিয়ে এ পর্যন্ত কুকি চিনের অনেক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুই সেনার মৃত্যুর পর অভিযান আরো জোরদার করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সূত্রমতে, যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হলে প্রতিবেশী একটি দেশে আশ্রয় নেন কুকি চিনের প্রধান নাথান বম। নাথান বমসহ সংগঠনটির শীর্ষনেতারা বেশিরভাগ সময় মিজোরাম ও মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থান করেন। প্রতিবেশী একটি দেশে অবস্থান করে অবৈধভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করে সন্ত্রাসীরা। দুর্গম পাহাড়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তাদের।
র্যাবের সূত্রমতে, দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় প্রায়ই নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে কুকি চিনের সদস্যরা। এর মধ্যেই বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে কুকি চিনের ১৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। গোয়েন্দা সূত্রমতে, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিজরতের নামে নিখোঁজ তরুণদের একটা অংশ পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। তাদের অনেককে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
গোয়েন্দারা জানান, জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যদের পাহাড়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কুকি চিন। জঙ্গি সংগঠনকে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করে তারা। দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ফায়দা হাসিল করা তাদের উদ্দেশ্য।
গোয়েন্দারা জানান, কুকি চিনের সদস্যরা পাহাড়িদের জিম্মি করে চাঁদা আদায় করে। অত্যাধুনিক অস্ত্র সংগ্রহ করে। পাহাড়ে ক্যাম্প স্থাপন করে প্রশিক্ষণ দেয় সদস্যদের।
সূত্রমতে, রাঙ্গামাটির ৯টি উপজেলা নিয়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য সৃষ্টি করতে অপতৎপরতা চালাচ্ছে কেএনএ বা কুকি চিন। বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, বান্দরবানের উপকণ্ঠ থেকে চিম্বুক পাহাড়ের ম্রো অঞ্চল হয়ে রুমা রোয়াংছড়ি, থানছি, লামা ও আলীকদমকে টার্গেট করে দীর্ঘদিন থেকে সন্ত্রাসী হামলা করছে তারা। নিজেদের বঞ্চিত দাবি করে কুকি চিনের প্রধান বম সম্প্রদায়ের নেতা নাথান বম এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
শুরুতে উন্নয়ন সংস্থার নামে বিভিন্নভাবে অর্থ সংগ্রহ করেন নাথান বম। অর্থ দিয়ে মিয়ানমার ও মিজোরাম থেকে অস্ত্র কিনেছে তারা। তাদের অস্ত্র পাওয়া গেছে জঙ্গিদের কাছে।
সূত্রমতে, চড়া দামে এ অস্ত্র জঙ্গিদের কাছে বিক্রি করে কুকি চিন। সেইসঙ্গে ২০২১ সাল থেকে মাসিক ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণও দিয়েছে কেএনএ সদস্যরা। ২০০৮ সালে কেএনএর জন্ম। ২০১৬ সালে সংগঠনটি সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি করে। প্রথমে এ সংগঠনের নাম ছিল কুকি চিন ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স বা কেএনভি। বর্তমানে এ সশস্ত্র সংগঠনের নাম কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)।
কৌশল হিসেবে সংগঠনের শুরুতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে ভারতের মনিপুর ও বার্মার ‘চীন রাজ্যের’ সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে তারা। প্রথম ব্যাচে শতাধিক সদস্যকে মনিপুরে প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। এরপর প্রায় ১০০ জনকে ভারতের মনিপুর, বার্মার কারেন ও কাচিন রাজ্যে গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য পাঠায় এ সংগঠন।
২০১৯ সালে প্রশিক্ষণ শেষে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের ফিরে। তারপর সশস্ত্র এ সংগঠনের সদস্যরা তাদের আসল চেহারা প্রকাশ করতে শুরু করে। সূত্রমতে, কেএনএ সদস্য সংখ্যা কয়েক হাজার বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাহাড়ে নিজেদের আদি বাসিন্দা মনে করে কেএনএ সদস্য ও সমর্থকরা। তারা চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীকে বার্মিজ ও ভারতীয় জাতিভুক্ত মনে করে। তাদের বহিরাগত মনে করে কেএনএ।
যে কারণে জেএসএস ও ইউপিডিএফের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতি তাদের বৈরী মনোভাব রয়েছে। কেএনএফের সভাপতি নাথান বম সম্পর্কে জানা গেছে, তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালযয়ের চারুকলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। জেএসএসের ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিপিসি) ঢাকা মহানগর শাখা ও কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। খাগড়াছড়ির তেরাঙ্গি স্কয়ারের পাশে এমএন লারমার ভাস্কর্যটির অন্যতম কারিগর তিনি।
একসময় কুকি চিন জাতীয় ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন নামে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠাতা করেন। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন নাথান বম। পরে পাহাড়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেলে অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী। তারপর থেকেই আত্মগোপনে রয়েছেন নাথান বম।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, রুমা উপজেলার সুংসুংপাড়া সেনা ক্যাম্পের আওতাধীন জারুলছড়ি পাড়া নামক স্থানে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আস্তানার খবর পায় সেনাবাহিনী। এ সংবাদ পেয়ে সুংসুংপাড়া আর্মি ক্যাম্প থেকে মেজর মনোয়ারের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি টহল দল ১৬ মে দ্রুততার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্থানে যায়। টহল দলটি জারুলছড়ি পাড়ার নিকটস্থ পানির ছড়ার কাছাকাছি পৌঁছালে দুপুর ১টা ৩৫ মিনিটে কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) সন্ত্রাসীদের ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) বিস্ফোরণ ও অতর্কিত গুলিবর্ষণের মুখে পড়ে।
এতে দুই অফিসার ও দুই সেনা আহত হন। আহতদের দ্রুত হেলিকপ্টারের মাধ্যমে সিএমএইচ চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে চিকিৎসারত অবস্থায় আহত দুই সেনা মারা যান। আহত অপর দুই অফিসার বর্তমানে চট্টগ্রাম সিএমএইচে চিকিৎসাধীন।
আইএসপিআর জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে কেএনএ বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার গহিন অরণ্যে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মাধ্যমে অরাজক পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, কেএনএ সন্ত্রাসীরা পাহাড়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাচ্ছে। এ বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আমরা প্রায়ই অভিযান চালাচ্ছি।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য