দাতা-গ্রহীতা জানেন না। সাক্ষীও জানেন না। এমনকি শনাক্তকারী লাপাত্তা। তারপরও তৈরি হয়েছে রেজিস্ট্রি দলিল। পৌনে চার কোটি টাকা মূল্যমানের সাড়ে ৫১ শতাংশ জমি নিয়ে লাগামহীন এই জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। ভুয়া দাতা, সাক্ষী আর শনাক্তকারী দিয়ে এমন জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রি অফিসে। রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী একটি দলিলে দাতা, গ্রহীতা, দুজন সাক্ষী ও একজন শনাক্তকারী থাকার কথা। আইনের এই বাধ্যবাধকতার পর সবগুলো ভুয়া সাজিয়ে জাল দলিল দিয়ে জমি আত্মসাতের অপচেষ্টা হয়েছে। আর এই জালিয়াতির মূল কারিগর আড়াইহাজার উপজেলার ব্রাহ্মন্দী গ্রামের মৃত ছাবেদ আলীর ছেলে লাক মিয়া। নারায়ণগঞ্জ মুখ্য মহানগর আদালতে বিচারাধীন এক মামলায় এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এরই মধ্যে মামলার শুনানি সম্পন্ন শেষে আগামী ৬ জুন রায়ের দিন ধার্য করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ আদালতে দেয়া সাক্ষীদের বক্তব্য এবং এ বিষয়ে আদালতে দাখিল করা পিবিআইর তদন্ত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, প্রথমে শুভ বিশ্বাস নামের এক চা দোকানদারকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি মূলে জমির মালিক দেখানো হয়। এরপর তার কাছ থেকে সাব কবলা (রেজিস্ট্রি দলিল) দলিলের মাধ্যমে জমির মালিকানা হস্তান্তর করা হয় ফুটপাতের দোকানদার মো. মামুনের কাছে। আর এই মামুনের কাছ থেকে হেবা বিল এওয়াজ দলিল মূলে মালিকানা হস্তান্তর করা হয় লাক মিয়ার স্ত্রী মাহমুদা বেগমের নামে। এরপর লাক মিয়া সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে ওই জমি দখলের অপচেষ্টা চালায়। এ নিয়ে জমির মূল মালিক ঢাকার বাসিন্দা মো. জাহের উদ্দিন সরকারের করা মামলার পর আদালতের আদেশে পিবিআই তদন্ত করে। এই তদন্তকালে জাল দলিলের শনাক্তকারীকে খুঁজে পায়নি পিবিআই। এরপর লাক মিয়াসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে জমি আত্মসাতের অপচেষ্টার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে মর্মে পিবিআই আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে লাক মিয়াসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলার বিচার চলছে।
আদালতে জমির মূল মালিক জাহের উদ্দিন সরকার এবং সাক্ষীদের দেয়া সাক্ষ্য, পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট যে, জালিয়াতি চক্রের মূল কারিগর লাক মিয়া বিভিন্ন নামে একাধিক জাল দলিল করে কোটি টাকার জমি আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছে।
আদালতে দেয়া সাক্ষ্যে জাহের উদ্দিন সরকার বলেন, তার কেনা জমি ও নামজারি মূলে দখলে থাকা জমি লাক মিয়া তার স্ত্রী মাহমুদা বেগম, ফারুক ও শফিউল্লাহ পরস্পর যোগসাজশে শুভ বিশ্বাসের নামে জাল পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বানিয়েছে। এরপর জাল পাওয়ার অব অ্যাটর্নি মূলে মামুনের নামে জাল দলিল করে দিয়েছে জালিয়াত চক্র। আসামিপক্ষ যেসব জাল দলিল ও পাওয়ার অব অ্যাটর্নি মূলে জমির মালিকানা দাবি করছে, তার কোনোটিই জমির মূল মালিক জাহের উদ্দিন সরকার করেননি। আসামিপক্ষের জেরার জবাবে তিনি বলেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে জাল দলিল করে তার জমি আত্মসাতের চেষ্টা করেছে।
পিবিআইর তদন্ত প্রতিবেদন এবং আদালতে সাক্ষীদের দেয়া সাক্ষ্য থেকে দেখা যায়, ‘জাল’ দলিলে রূপগঞ্জের মর্তুজাবাদ মধ্যপাড়া গ্রামের হাজী নুরুল ইসলামের ছেলে মো. জয়নাল আবেদীন মিয়া ও রূপগঞ্জের ভুলতা আমবাগানের জাদব চন্দ্র সরকারের পুত্র শৈলেন সরকারকে সাক্ষী রাখা হয়েছে। আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে দুইজনই জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না।
শৈলেন সরকার বলেন, আমি এ মামলার দলিল ৮৫৭-তে কোনো প্রকার সাক্ষী দিই নাই। সাবরেজিস্ট্রি অফিসে উপস্থিত হয়ে কোনো স্বাক্ষরও দিইনি। কে বা কারা আমার নাম উল্লেখে স্বাক্ষর দিয়ে আমাকে এই দলিলে সাক্ষী বানিয়েছে, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। তিনি বলেন, জমির মূল মালিক জাহের উদ্দিন সরকার। তাকে আমি চিনি।
একইভাবে মো. জয়নাল বলেন, ‘এটি জাল দলিল। এই দলিলে সাক্ষী হিসেবে আমার নাম ব্যবহার করা হয়েছে। ২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি এই দলিল রেজিস্ট্রি হয়েছে।’ কিন্তু ওই তারিখে জয়নাল রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে কোনো দলিলে স্বাক্ষর করেননি বলে আদালতকে জানান। তিনি বলেন, আসামি লাক মিয়া, শুভ বিশ্বাস, মামুন, ফারুক, মাহমুদাসহ আসামিরা জাল দলিল করে জমি আত্মসাতের চেষ্টা করেছে। এই জমির মূল মালিক জাহের উদ্দিন সরকার। জাহের উদ্দিন সরকার ওইসব জাল দলিলের দাতা ছিলেন না। তার স্বাক্ষর জাল করে তাকে দাতা দেখানো হয়েছে। আসামিরা জমি দখলের জন্য জমিতে থাকা চারটি টিনশেড রুম ও জমির সীমানা প্রাচীর ভেঙে ফেলে।
এখানেই শেষ নয়। এই জাল দলিলে বিক্রেতা হিসেবে মো. জাহের উদ্দিন সরকারের নাম রয়েছে। অথচ যে তারিখে দলিলটি রেজিস্ট্রি হয়েছে, ওই দিন অন্য একটি ‘মিথ্যা’ মামলায় কারাগারে ছিলেন তিনি। এ বিষয়ে দায়েরকৃত মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, জাহের উদ্দিন সরকার সাজিয়ে অন্য কাউকে উপস্থিত করে দলিলটি তৈরি করা হয়েছে। এ বিষয়ে আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে এই মামলার সাক্ষী নয়ন হোসেন জানান, জাল দলিল তৈরির সময়ে এই মামলার বাদী ঘটনাস্থলে উপস্থিতই ছিলেন না। বাদীর অনুপস্থিতিতে একটি ভুয়া ও জাল দলিল তৈরি করা হয়। চাঞ্চল্যকর এই মামলার শুনানি শেষে রায়ের জন্য আদালত আগামী ৬ জুন ধার্য করেছেন।
মামলাটি দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত বছরের ১৯ জানুয়ারি আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তারপরই শুরু হয় এর বিচারকার্য। তদন্তকালে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে অংগুলাংক বিশারদের মাধ্যমে ওই দলিলের আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করা হয়। এ বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে পিবিআই উল্লেখ করেছে, দলিলে উল্লিখিত জাহের উদ্দিন সরকার জাহের নামের ব্যক্তির প্রদত্ত আঙুলের ছাপটি মামলার বাদী জাহের উদ্দিন সরকার জাহেরের আঙুলের নমুনা ছাপগুলোর সঙ্গে মিল নেই। এতে প্রমাণিত হয় যে, ওই দলিলের দাতা তিনি নন। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দলিলটি তৈরি করা হয়েছে। এমনকি আসামিরা ভুয়া দলিলমূলে নিজেদের জায়গার মালিক দাবি করে হুমকি ও হামলা করেছে বলে প্রমাণ পেয়েছে পিবিআই।
আদালতে দায়েরকৃত মামলা সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের পানাবে ২০১৪ সালের ১ অক্টোবরে আরএস ৩৫২ নম্বর দাগে ১৪ শতাংশ জমি ক্রয় করেন মো. জাহের উদ্দিন সরকার (জহির)। একই বছরের ১৮ ডিসেম্বর ওই এলাকাতে আরএস ৩৪১ নম্বর দাগে ৩৭.৫০ শতাংশ জমি ক্রয় করেন তিনি। ওই এলাকাতে মোট ৫১.৫০ শতাংশ জমির মালিক হন জাহের উদ্দিন সরকার। জমি ক্রয়ের পর তা দখলে নিয়ে বাউন্ডারি দেয়াল ও টিনশেড ঘর নির্মাণ করেন। এমনকি ওই জমি প্রাইম ব্যাংকের শ্যামলী শাখায় মর্টগেজ প্রদান করেন। ২০২১ সালের ২০ মার্চ দুপুরে ওই জমি দখলে নিতে সশস্ত্র হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা।
ওই সময়ে হামলাকারীরা জানায়, তারা এই জমি ক্রয় করেছে। পরবর্তীতে জাহের উদ্দিন সরকারকে দাতা দেখিয়ে রূপগঞ্জের মণ্ডলবাড়ির সুধন বিশ্বাসের পুত্র শুভ বিশ্বাস গ্রহীতা হয়ে একটি দলিল তৈরি করে। এতে মো. জয়নাল ও শৈলেন বিশ্বাস সরকারকে তাদের অজান্তেই সাক্ষী হিসেবে রাখা হয়েছে। আদালতে বাদী পক্ষের হয়ে মামলা পরিচালনা করছেন অ্যাডভোকেট রুহুল আমিন। এ মামলায় ন্যায়বিচার পাবেন প্রত্যাশা করে তিনি বলেন, জাল-জালিয়াতির অভিযোগে অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি হবে।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লাক মিয়া, শুভ বিশ্বাস ছাড়াও এই মামলার অন্য আসামিরা হচ্ছেনÑ লাক মিয়ার স্ত্রী মাহমুদা বেগম, রূপগঞ্জের মর্তুজাবাদের ফারুক মিয়া, একই গ্রামের আবু সাইদ, সাইফুল ইসলাম, গোলাকান্দাইলের আব্দুল মজিদ মিয়া, নাহাটি গ্রামের সফি উল্লাহ, প্রভাকরদীর আলী আকবর, দলিল লেখক সন্দিপ চন্দ্রসহ ১৩ জন।
সূত্রমতে, রূপগঞ্জ নিজের এলাকা আড়াইহাজার ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ জেলাব্যাপী রয়েছে লাক মিয়া সিন্ডিকেট। জাল দলিল তৈরি, জবরদখলই তাদের কাজ। প্রভাবশালী লাক মিয়ার বিরুদ্ধে প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি এমনকি হত্যার অভিযোগে মামলা রয়েছে। আড়াইহাজার এলাকায় ত্রাসের নাম লাক মিয়া। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ পথেই রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন তিনি।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য