-->

ঢাকায় বেপরোয়া অজ্ঞান-মলম পার্টি

ইমরান খান
ঢাকায় বেপরোয়া অজ্ঞান-মলম পার্টি

ইমরান খান: ঢাকায় বেড়েছে ছিনতাই। বেপরোয়া অজ্ঞান-মলম পার্টি চক্রের সদস্যরা। বিশেষ অভিযানেও থামছে না তাদের দৌরাত্ম্য। প্রতিদিনই এসব চক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন মানুষ। রেহাই পাচ্ছেন না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। ঘটছে খুনের মতো ঘটনাও।

 

পরিসংখ্যান বলছে, গত এক মাসেই অজ্ঞান-মলম পার্টির সদস্যদের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন শতাধিক মানুষ। চিকিৎসকরা বলছেন, প্রাথমিক চিকিৎসায় অনেকেই প্রাণে বাঁচলেও অতিমাত্রায় চেতনানাশক ওষুধের মৃত্যুঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।

 

পুলিশ বলছে, ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে এই দুর্বৃত্তদের কবল থেকে রক্ষা পেতে হলে রাস্তার পাশ থেকে কোনো কিছু খাওয়ার আগে সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে নগরবাসীকে।

 

গত বুধবার ঢামেকের জরুরি বিভাগের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জসিম সাহা (২৪) নামের এক কলেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। ওই দিন বিকেলে তাকে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা এলাকা থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তিনি অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে মারা যান বলে জানিয়েছেন পুলিশ ও চিকিৎসকরা।

 

গত ৫ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া এলাকায় অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন এনআরবি ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জের হিরাঝিল শাখার কর্মকর্তা ফয়সাল আহমেদ। দুপুর ১টার দিকে সহকর্মীরা খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান।

 

এর আগে গত ৩ আগস্ট রাজধানীতে বাসে উঠে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন এক পুলিশ পরিদর্শক শফিকুল ইসলাম। তিনি গাজীপুর পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে কর্মরত। শফিকুলের এ খবর শুনে হাসপাতালে আসেন তার স্বজনেরা। মো. সালাউদ্দিন নামে তার এক শ্যালক বলেন, ঢাকার আশকোনা হাজি ক্যাম্প এলাকা থেকে সেদিন সকালে কারওয়ানবাজারের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন শফিকুল। তার কাছে এক লাখ টাকা ছিল। তিনি বিআরটিসি বাসে উঠেছিলেন বলেও জানান তিনি।

 

রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল রুটে চলাচলকারী ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের হেলপার মাসুদ বলেন, যাত্রী এক জায়গা থেকে উঠলে আমরা তাদের নির্দিষ্ট স্থানে নামিয়ে দিই। গাড়িতে সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে। কেউ বাসে উঠে ঘুমিয়ে যায়, কেউ মোবাইল চাপে। কে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে তা বোঝার উপায় নাই।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, অনেক সময় অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা দ্রুত টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে অজ্ঞান করতে অতিমাত্রায় চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করে থাকে, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। অনেক সময় দেখা যায় অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়া ব্যক্তি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। তার আচার-আচরণ ও চলাফেরা অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। অনেকক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসায় সাময়িক সুস্থ হলেও আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর ঝুঁকিও থেকে যায়।

 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল সূত্রে বলছে, প্রতি মাসে ১৫০ জনের বেশি মানুষ অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সেখানে চিকিৎসার জন্য আসেন। তবে চলতি মাসের প্রথম ১০ দিনেই অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে ৭০ থেকে ৮০ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। এদের মধ্যে ১ জনের মৃত্যুও হয়েছে।

 

যারা প্রাথমিক চিকিৎসায় সুস্থ হয়েছেন অতিমাত্রায় চেনানাশক এদের অনেকেই দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তবে চলতি সপ্তাহেই অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে অন্তত ১৫ জন রোগী ঢামেকে চিকিৎসা নিতে এসেছেন।

 

এর আগে চলতি বছরের ১ জুলাই ফার্মগেটের সেজান পয়েন্টে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের কনস্টেবল মনিরুজ্জামান নিহত হন। এ ঘটনায় নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক ৫০ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) নিয়ে জরুরি বৈঠকে ছিনতাই প্রতিরোধে বিশেষ অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেন।

 

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগে প্রতিদিন রাত আটটা থেকে পরদিন ভোর ছয়টা পর্যন্ত এই বিশেষ অভিযান শুরু হয়। ডিএমপির একজন যুগ্ম কমিশনারের (অপরাধ) তত্ত্বাবধানে অভিযান তদারকি করছেন উপকমিশনার পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা।

 

ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, জুলাইয়ের প্রথম ১৪ দিনে ৬৭৯ ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাকি ১৭ দিনে গ্রেপ্তার হয় তিন শতাধিক ছিনতাইকারী। ডিএমপির সাসপেক্ট আইডেনটিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেমের (এসআইভিএস) তথ্য বলছে, রাজধানীতে ৬ হাজার ১৯৮ জন ছিনতাই ও ডাকাতিতে জড়িত। এর মধ্যে ১ হাজার ৭৩৭ জন ছিনতাইকারী। পুলিশের চলমান বিশেষ অভিযানে ছিনতাই ও ডাকাতির সঙ্গে জড়িতরা গ্রেপ্তার হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিএমপির বিভিন্ন থানা এলাকায় পরিচালিত বিশেষ অভিযানে গত জুলাই মাসে ১ হাজার ৭৭৯ ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার হয়েছে। সে তুলনায় অজ্ঞান পার্টি বা মলম পার্টির সদস্যদের গ্রেপ্তারের সংখ্যা খুবই কম। গত ১ মাসে অজ্ঞান পার্টির মাত্র ৫ থেকে ৭ জন সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য কখনো বাড়ে, আবার কখনো কমে। এটা চলমান অপরাধ। তবে এটা যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে সেজন্য ঢাকা মহানগর পুলিশ কাজ করছে। প্রতিনিয়ত অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের ধরা হচ্ছে, মামলা দেয়া হচ্ছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে ধরনের ডেডিকেশন দরকার, সেটা নিয়েই পুলিশ কাজ করছে। গত ১ মাসে অজ্ঞান পার্টির অন্তত ৫ থেকে ৭ জন সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে বলেও জানান তিনি।

 

ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার) হারুন অর রশীদ বলেন, অজ্ঞান পার্টি আগেও ছিল, এখনো আছে। অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য থামাতে পুলিশের বিশেষ দল মাঠে কাজ করছে। অনেককে ধরে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। পথচারী বা যাত্রীসহ সবাইকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শও দেন এ কর্মকর্তা।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version