-->
কাস্টম হাউসের গুদাম থেকে ৪৫ কোটি টাকার স্বর্ণ চুরি

ডিবির গোয়েন্দা জালে জড়িতরা

রুদ্র মিজান ও ইমরান খান
ডিবির গোয়েন্দা জালে জড়িতরা

রুদ্র মিজান ও ইমরান খান: হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টম হাউসের গুদাম থেকে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা মূল্যের স্বর্ণ চুরির ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। স্বর্ণ চুরিতে সরাসরি অংশ গ্রহণ করেছে তিনজন। এছাড়াও বেশ কয়েকজনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় কাস্টমসের শীর্ষ কয়েক কর্মকর্তার নামও উঠে এসেছে তদন্তে।

 

নিয়ম অনুসারে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা না দিয়ে জব্দকৃত স্বর্ণ রাখা হতো বিমানবন্দর কাস্টম হাউসে। স্বর্ণ চুরির ঘটনায় গতকাল বিকেলে কয়েকজনকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে বিমানবন্দর কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম শাহেদ ও শহিদুল ইসলাম এবং সিপাহি নিয়ামত হাওলাদারকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল।

 

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ৫৫ কেজি ৫০১ গ্রাম স্বর্ণ চুরির ঘটনায় ইতোমধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টম হাউসের শীর্ষ কয়েক কর্মকর্তাসহ সাতজনের যোগসাজশ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গতকাল আটজনকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

 

ডিবি পুলিশ জানিয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদে একেক সময় একেক তথ্য দিচ্ছেন কাস্টম হাউসে কর্মরতরা। ধারণা করা হচ্ছে, এই চক্রটি দীর্ঘদিন থেকে স্বর্ণ চুরিসহ বিমানবন্দরের নানা অবৈধ কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও কিছু স্বর্ণ ব্যবসায়ী এতে জড়িত রয়েছে। তদন্তে জড়িতদের তালিকা আরো দীর্ঘ হতে পারে বলে গোয়েন্দারা জানান।

 

চাঞ্চল্যকর এই মামলাটি গতকাল থেকে তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে ডিবি পুলিশের উত্তরা বিভাগ। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কাস্টমসের গোডাউনের সিসিটিভি ফুটেজ ও চুরির সময় ডিউটিতে থাকা কর্মকর্তা ও সিপাহিদের টার্গেট করেই চলছে তদন্ত।

 

ডিবি পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার আকরাম হোসেন বলেন, প্রায় ৪৫ কোটি টাকা মূল্যের ৫৫ কেজি স্বর্ণ চুরির ঘটনাটি তথ্যপ্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমরা তদন্ত করছি। এতে জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকা কাস্টম হাউসের বেশ কয়েকজন কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জড়িত যে-ই থাকুক তাকে কোনো ছাড় দেয়া হবে না বলে জানান তিনি।

 

 

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বিমানবন্দরের কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম শাহেদ ও শহিদুল ইসলাম এবং সিপাহি নিয়ামত হাওলাদার স্বর্ণ চুরির দায় স্বীকার না করলেও পুলিশ অনেকটাই নিশ্চিত হতে পেরেছে যে, এতে তারা জড়িত। এ নিয়ে অধিকতর তদন্ত চলছে। অভিযুক্ত তিনজনসহ যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, তাদের কাস্টমসের করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হবে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২ সেপ্টেম্বরের আগে ও পরে সাইদুল, শাহেদ ও নিয়ামত হাওলাদারকে বিমানবন্দর এলাকায় একত্রে দেখা গেছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ অনুসারে তাদের গতিবিধি ছিল সন্দেহজনক।

 

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ চলমান রয়েছে। এছাড়া গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তা ভেরিফাই করা হচ্ছে। স্বর্ণগুলো গোডাউন থেকে সরিয়ে কোথায় বিক্রি করেছে বা কাদের কাছে রেখেছে, এসব বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। স্বর্ণ বেচাকেনার বিভিন্ন এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সেসব জায়গা থেকে গোয়েন্দারা তথ্য সংগ্রহ করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, জড়িতদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে স্বর্ণ উদ্ধারে অভিযান চালাবে ডিবি।

 

ডিবিতে আসার আগে মামলাটি তদন্ত করছিল থানা পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, গোডাউনে স্বর্ণালঙ্কার রাখার ব্যবস্থাপনা ভালো ছিল না। এ বিষয়ে জানতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার মোর্শেদ আলম বলেন, গোডাউনে রাখা স্বর্ণালঙ্কার তদারকির বা ম্যানেজমেন্টের বিষয়টি ছিল অত্যন্ত দুর্বল, যা আমি নিজে দেখেছি। মূল্যবান সম্পদ স্বর্ণ, যা লোকজনদের কাছ থেকে জব্দ করে অবহেলিত অবস্থায় রাখা ছিল।

 

মোর্শেদ আলম বলেন, কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বর্ণ জব্দ করার তিন দিন পরেই বাংলাদেশ ব্যাংকে স্বর্ণ জমা দিতে পারে। কিন্তু মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০২০ সাল থেকে স্বর্ণালঙ্কার বা স্বর্ণ সেখানে রক্ষিত ছিল। যথাযথ প্রক্রিয়া তারা অনুসরণ করেননি। অন্য আরেকটি জায়গা ছিল স্বর্ণগুলো রাখার জন্য, সেখানেও রাখা হয়নি। নিরাপত্তার দুর্বলতার জন্যই এমনটা হয়েছে। গত ৩ সেপ্টেম্বর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঢাকা কাস্টমসের গুদাম থেকে স্বর্ণ চুরির অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন বাদী হয়ে বিমানবন্দর থানায় এই মামলা করেন।

 

এর আগে গত ২ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টার দিকে গোডাউন থেকে স্বর্ণ চুরির বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন কাস্টমসের গুদাম কর্মকর্তা মাসুদ রানা। অভিযোগ অনুসারে, নিয়মিত টহল চলাকালে, বিমানবন্দরের একজন কর্মকর্তা একটি ভল্টের তালা ভাঙা দেখতে পান। খবর পেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দেখতে পান, ভল্টের একটি অংশ ধারালো বস্তু দিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে।

 

শুল্ক কর্মকর্তারা পরে দেখেন, ২০২০-২০২৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় জব্দ করা প্রায় ৫৫.৫১ কেজি স্বর্ণ উধাও হয়ে গেছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গুদামে কর্মরত এ, বি, সি এবং ডি এই চার শিফটের সরকারি রাজস্ব কর্মকর্তা মাসুম রানা, সাইদুল ইসলাম শাহেদ, মো. শহিদুল ইসলাম, আকরাম শেখ ও সিপাহি মো. রেজাউল করিম, মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, মো. আফজাল হোসেন, মো. নিয়ামত হাওলাদারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কোনো সদুত্তর পাননি।

 

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় আটক করা ৩৮৯টি ডিএম থেকে ৫৫ দশমিক ৫১ কেজি স্বর্ণ লকার ভাঙা আলমারিতে পাওয়া যাচ্ছে না। ঘটনাটি ২ সেপ্টেম্বর রাত ১২টা ১৫ মিনিট থেকে সকাল ৮টা ৩০ মিনিটের মধ্যে যেকোনো সময়ে কে বা কারা গোডাউন থেকে স্টিলের আলমারির লকার ভেঙে চুরি করে নিয়ে গেছে।

 

মামলার পর থেকেই চার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও চার সিপাহিকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেন উত্তরা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিমানবন্দর থানা পুলিশ ও ডিবি।

 

এছাড়াও ঘটনা তদন্তে কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version