ইমরান খান: রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেক ভাসমান ভুয়া কাজি, যাদের আইনগত বিয়ে পড়ানোর এখতিয়ার নেই। কাজি হিসেবে নিয়োগ পেতে যেসব যোগ্যতা বা আইনের বিধিবিধান রয়েছে, তার কোনোটাই তাদের নেই। এসব কাজির অধিকাংশই থাকেন ঢাকা জজকোর্ট এলাকায়।
তথ্য বলছে, কিছু অসাধু আইনজীবী ভুয়া কাজির মাধ্যমে বিয়ে রেজিস্ট্রি করে থাকেন। আর এসব কাজির কাছে বিয়ে করতে এসে প্রতারিত হচ্ছেন হাজারো মানুষ। তবে ওইসব ভুয়া কাজিকে গ্রেপ্তার বা তাদের আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো তৎপরতা নেই।
জানা গেছে, নিকাহ-তালাক রেজিস্ট্রারদের কেন্দ্রীয় কোনো পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই। কোন এলাকায় কাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তার তথ্য নেই। তাই সারা দেশে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। এক ধরনের নিয়ন্ত্রণহীনতাও সৃষ্টি হয়েছে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের কার্যক্রমে।
এ অবস্থায় তাদের নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ, স্থায়ীকরণ, জবাবদিহি ও শাস্তি নিশ্চিতকরণের বিষয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। এদিকে পুরোনো ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে বিয়ে ও বিচ্ছেদ নিবন্ধিত হওয়ার জটিলতার উদ্ভব হচ্ছে বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা। আব্দুল মোতালিব। ১০ বছর ধরে মিরপুরের ডিওএইচএস এলাকায় বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রিারের কাজ করেন। প্রতি মাসে তিনি অন্তত ৩০টি বিয়ে ও তালাক ‘রেজিস্ট্রি’করেন তিনি। সে হিসাবে গত ১০ বছরে ৩ হাজারের বেশি বিয়ে ও তালাক ‘রেজিস্ট্রি’ করেছেন মোতালিক। তবে ঢাকা জেলার মিরপুর ডিওএইচএস এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজিদের তালিকায় আব্দুল মোতালিব নামে কারো নাম নেই। তার মানে তিনি কাজি নন। তার পড়ানো কোনো বিয়ের আইনগত বৈধতা নেই। সবই ভুয়া।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থায়ী বা অস্থায়ী নিকাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে কখনো নিয়োগ দেয়া হয়নি কাজি আব্দুল মোতালিবকে। ২০১৩ সালে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নামে একটি ভুয়া স্মারক তৈরি করে জাল জালিয়াতের মাধ্যমে একটি নিয়োগপত্র তৈরি করেন তিনি। এরপরই কাজি হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি।
তবে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাজি আবদুল মোতালিব নামের কাউকে মন্ত্রণালয় থেকে ডিওএইচএস এলাকায় স্থায়ী বা অস্থায়ী নিকাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে কখনো নিয়োগ দেয়া হয়নি।
এমনকি মোতালিব কাজির প্রতারণার শিকার মো. কামরুজ্জামান নামের এক ভুক্তভোগী বলেন, ২০২২ সালে আব্দুল মোতালিবের নিকাহ রেজিস্ট্রারের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে আবেদন করেছিলাম।
এর জবাবে আমাকে জানানো হয়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পল্লবী থানাধীন মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় আবদুল মোতালিব নামে কোনো নিকাহ রেজিস্ট্রার কর্মরত নেই। সে একজন প্রতারক। সে যে বিয়েগুলো করাচ্ছে সেগুলোর কোনো বৈধতা নেই। সে মানুষের সঙ্গে ভয়াবহ প্রতারণা করছে।
পল্লবীর অন্য এলাকার জন্য নিযোগপ্রাপ্ত এক কাজি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ডিওএইচএস এলাকায় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কাজি অফিস খুলে আব্দুল মোতালিব নামের ওই ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন করে মানুষকে প্রতারিত করছে।
তিনি বলেন, তার জালিয়াতির বিষয়ে ২০১৬ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে চেয়েছিল। কিন্তু আব্দুল মোতালিব হাইকোর্টে সরকারকে বিবাদী করে রিট পিটিশন করে করেন। ২০১৯ সালে সে আদালত থেকে তার পক্ষে রায় প্রদান করা হলে রাষ্ট্রপক্ষ ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। এরপর রায়ের ওপর স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ দিয়ে লিভ পিটিশন দাখিল করার আদেশ দেন আপিল বিভাগ। এরপর সরকার ও আব্দুল মতিন কেউই লিভ পিটিশন দাখিল করেনি। আদালত স্থিতিবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দিলেও নিকাহ ও রেজিস্ট্রার রেজিস্ট্রেশন করা বন্ধ রাখেননি মোতালিব।
এ বিষয়ে কাজি মো. আব্দুল মোতালিবের সঙ্গে কথা বলার জন্য তার ডিওএইচএস অফিসে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। সেখানে তার সহযোগী হান্নানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, এসব অভিযোগ মিথ্যা। মোতালিব সাহেব আসলে এ বিষয়ে কথা বলতে পারবেন। সেখানে কয়েকদিন গেলেও কাজি পরিচয়দানকারী আব্দুল মোতালিবের দেখা মেলেনি।
শুধু মোতালিব নয় রাজধানীতে কোনো বৈধতা ছাড়াই বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রারের কাজ করছেন একাধিক ভুয়া কাজি। ২০২০ সালে ঢাকার আফতাবনগর থেকে একাধিক মামলার আসামি ও বিভিন্ন অপকর্মের হোতা ভুয়া কাজি খাইরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
তাকে গ্রেপ্তারের পর জানা যায়, খাইরুল ইসলাম আফতাবনগর আবাসিক এলাকার জি- ব্লকের ৪নং সড়কের ২নং বাড়ি এলাকায় আস্তানা গেড়ে সনদবিহীন ভুয়া নিকাহ রেজিস্ট্রারের কাজ করে আসছিল। টাকার লোভে অপ্রাপ্ত বয়সের ছেলে মেয়েদেরও ভুয়া বিয়ের সনদ দিয়েছে সে।
এছাড়া রাজধানীর আদালত চত্বরে কাজি পরিচয়ে বিয়ে ও তালাক নিবন্ধন করছেন শাহীন কাজি, মো. কাওছার, সাইফুল্লা কাজি, রুহুল আমিন, আকরাম, হানিফ মিয়া ও রাসেল। এছাড়া আদালতে কর্মরত মুহুরি রাসেল ও লতিফ নামের দুই ব্যক্তি কাজি পরিচয় দিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি ও তালাক নিবন্ধন কার্যক্রম করছেন। তাদের ছত্রচ্ছায়ায় দেদার চলছে ভুয়া বিয়ে রেজিস্ট্রি ও তালাক নিবন্ধন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার সমিতির মহাসচিব কাজি মাওলানা মো. খলিলুর রহমান সরদার বলেন, বিদ্যমান ব্যবস্থায় বর-কনের অনেক তথ্যই নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। রেজিস্ট্রি পদ্ধতি এখনো এনালগ রয়ে গেছে। ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করা গেলে ভুয়া কাজি শনাক্ত করা সহজ হতো।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য