-->

কৃষিজমির মাটি যাচ্ছে ভাটায়, ভক্ষকের ভূমিকায় পুলিশ

ইমরান খান
কৃষিজমির মাটি যাচ্ছে ভাটায়, ভক্ষকের ভূমিকায় পুলিশ

ইমরান খান: রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভারের ধামারাই থানার খুল্লা ইউনিয়নের পাল্লি গ্রাম থেকে কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই ফসলি জমির মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে কেটে নেয়া এই মাটির বেশিরভাগই যাচ্ছে গ্রামের পাশে গড়ে ওঠা ইটভাটায়। এতে জমির উর্বরা শক্তি নষ্টের পাশাপাশি অবৈধ ভাটায়িইট পোড়ানোর দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ।

 

স্থানীয়দের অভিযোগ, এলাকার প্রভাবশালী ও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা মাটির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এ কারণে ভক্ষকের ভ‚মিকায় পুলিশ প্রশাসন। খোঁজ নিয়ে যানা গেছে, দিনে দুপুরে ভেকু দিয়ে কৃষকদের তিন ফসলি জমির মাটি ইট ভাটায় নিয়ে যাওয়ায় চাষের যোগ্যতা হারিয়েছে এই গ্রামের ফসলি জমি। এক সময়ে মাঠের ফসলে হাসি ফুটলেও সেটি এখন অতীত। এখন ফসলের মাঠ জুড়ে বড় বড় কূপ। আর এই ভাটার মালিককে রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের অভিযোগ থানা পুলিশের বিরুদ্ধে।

 

গ্রামের বাসিন্দারা বলছেন, জমির মাটি কাটায় বাধা দিলেই এসে হাজির হয় থানা পুলিশ। তারা মামলাসহ বিভিন্ন ধরনের হুমকি দেয়। এমন কি রাতের অন্ধকারে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্রামের সাধারণ বাসিন্দের শ্বাসানোর অভিযোগর উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। বারবার লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরেও অজানা কারণে ব্যবস্থা নিচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও উপজেলা প্রশাসন।

 

আইন অনুযায়ী কোনো ইট ভাটার এক কিলোমিটারের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান থাকলে সেই ইটভাটা বন্ধ করতে হবে। এছাড়া, ইটের কাঁচামালের জন্য যাবেনা কোনো ফসলি জমির মাটি। ক্ষতি করা যাবে না আশেপাশের ফসলি জমি, বনজ ও ফলজ গাছের। অথচ পাল্লি গ্রামের জন্য যেন আইন ভিন্ন। এক কিলোমিটারের ভিতরে দুটি প্রাথমিক স্কুল, স্বাস্থ্য সেবার কমিউনিটি ক্লিনিক, মাদরাসা রয়েছে। তারপরেও নীবর ভূমিকায় প্রশাসন।

 

সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পাল্লি গ্রামের প্রবেশ মুখেই দেখা মিললো বিশাল এক ইটের ভাটার। মাহী ব্রিকস নামের এই ভাটার চার পাশেই কৃষি জমি। ভাটা লাগোয়া জমিতে মজুদ করা লাখ লাখ ইটের পাহাড়। পাশেই ফসলি জমি থেকে কেটে আনা মাটির পাহাড়। আর দানব আকৃতির কয়েকটি ভেকু। এগুলো দিয়ে গত চার বছর ধরে কৃষকের সোনালী ফসলের মাঠ ক্ষতবিক্ষত করা হচ্ছে। ভাটা থেকে কয়েক শো মিটার দূরে দেখা মিললো ছোট একটু ধানের ক্ষেত। এর বাইরে পুরোটাই পানির নিচে। রাস্তা লাগোয়া জমিতে অল্প কিছু আমনের বিজ। পানি থাকায় বাস্তবাতা বুঝতে কথা হলো গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে। কথা বলে বোঝা গেলো গ্রাম জুড়ে ফসলের মাঠ আর কৃষকের হৃদয়ের আসল ক্ষতটা।

 

জানা গেছে, চার বছর আগে পাশের ইউনিয়নের বাসিন্দা সোলাইমান ইসলাম পাল্লি গ্রামের প্রধান সড়ক লাগোয়া কয়েক বিঘা জমি কিনে মাহী ব্রিকস নামের ইটভাটা গড়ে তোলেন। এরপর ধিরে ধিরে গ্রাস করা শুরু করেন চাষের জমি। প্রথমে টাকার প্রলোভন দিয়ে অল্প কিছু জমি কেনেন। এরপর সেই জমির মাটি গভীর করে কেটে নিয়ে যান। ফলে পাশের জমি ভেঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এই সুযোগে অল্প দামে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয় কৃষকরা।

 

এভাবে কয়েক বছরে শত শত বিঘা জমি কিনেছেন এই মাটিখেকো সোলাইমান। তার কাছে কেউ জমি বিক্রি না করলে দিনে দুপুরে ভেকু দিয়ে জমির মাটি কেটে নিয়ে যায়। প্রতিবাদ করতে গেলে থানা পুলিশ এসে হাজির হয়।এভাবে গত চার বছরে পাল্লী গ্রামসহ আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের শত শত একর জমির মাটি কেটে ইট ভাটায় নিয়েছেন সোলাইমান। এমন কি বাদ যায়নি গ্রামের পাশের সরকারের সংরক্ষিত বিটলা বিলের মাটি।

 

এই প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে ইট ভাটায় ক্ষতিগ্রস্ত জমির কয়েকজন মালিক ও কৃষক জড়ো হন। তবে তারা কথা বলতে চান না। এর কারণ পত্রিকা বা টিভিতে নাম প্রকাশ পেলেই রাতের আধারে পুলিশের হয়রানি ভয়। গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র আত্মগোপনে থাকতে হয়।

 

পাল্লি গ্রামের বাসিন্দা ইউসুফ (ছদ্মনাম) বলেন, আমার বাপ দাদার জমি। কিন্তু আমরা প্রতিবাদ করতে পারি না। নানা কৌশলে তারা মাটি কেটে নিয়ে যায়। আবার মাটি কাটায় বাধা দিলে ভাটার লোকজন চলে যায় কিন্তু পুলিশ এসে হাত-পা ভেঙে দেয়া, জীবন শেষ করে দেয়ার হুমকি দেয়। অনেক সময়ে দুই দিন তিন দিন পালিয়ে থাকতে হয়।

 

তিনি আরও বলেন, আমাদের জমি থেকে যে ধান পেতাম তাতে নিজেদের বছরে চাল আসতো। কিন্তু ইট ভাটার কারণে এখন আগের মতো ফসল হয় না। ধানের চাষের খরচই ওঠে না। অথচ তিন ফসল কখনো কখনো চার ফসল পেতাম। এখন জমিতে মাটি নেই বড় বড় কুয়া করে রাখছে। এমন কি জমি মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রাক চলাচলের কারণেও বহু জমি নষ্ট হয়ে গেছে। এই সকল জমি মাটি ট্রাকের চাকার কারণে শক্ত হয়ে যাওয়া ফসল হয় না।

 

অপর এক বাসিন্দা রাশেদ (ছদ্মনাম) বলেন, কারোটা বলে কাটে, কারোটা না বলে কাটে। তাদের কাগজে (দলিল) জোর না থাকলেও ইট বেচা টাকার জোর আছে। এই টাকার জোরে সবার চোখ, মুখ বন্ধ। আমরা ভুক্তভোগীরা প্রতিবাদ করলেই পুলিশ দিয়ে হয়রানি করে। তখন বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়। ভাটায় যখন কয়লা আর টায়ার পোড়ায় তখন বাতাস বিষাক্ত হয়ে যায়। ধানের শীষ পুড়ে যায়। গ্রামের অন্যসব ফল গাছের ফল অকালে পেকে পরে যায়। সব চেয়ে বেশি কষ্ট শিশু ও বয়স্কদের। তাদের শ্বাস কষ্টসহ নানা সমস্যায় ভোগেন।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন শত অনিয়মের পরও এসকল ভাটা যদি নবায়ন পায় তাহলে এর দায় পরিবেশ অধিদপ্তর এবং জেলা প্রশাসনের। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান বলেন, ইটভাটার বিরুদ্ধে পরিবেশ দূষণের অভিযোগ ওঠলে পরিবেশ অধিদপ্তর প্রথমেই দেখবে পরিবেশগত ছাড়পত্র এবং জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স আছে কি না।

 

যদি দুটোই থাকে তাহলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট টিম গিয়ে তৎক্ষণাৎ সেটি বন্ধ করে দিতে পারে এবং পরিবেশগত ছাড়পত্র বাতিল করতে পারে। পরিবেশগত ছাড়পত্র বাতিলের পর সেটি অবৈধ হয়ে যাবে এবং তখন সেটি ভেঙে দিতে কোন সমস্যা নেই।

 

তিনি বলেন, যেখানে বারবার মানুষ অভিযোগ করছে এবং ইটভাটা বন্ধের আবেদন জানাচ্ছে এবং যেখানে পরিবেশ অধিদপ্তর নিজেও বলছে যে তারা জরিমানা করেছে সেখানে এই ইটভাটা বন্ধ করে দিতে তো সমস্যা নেই।

 

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং ইট প্রস্তুত আইন বিবেচনা করে ইটভাটার ছাড়পত্র দেওয়া হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর আইন এবং জেলা প্রশাসকের লাইসেন্স এই দুটো নিয়েই কিন্তু ইটভাটা পরিচালনা করতে হয়। এটা সত্য যে, যে শর্ত দিয়ে ছাড়পত্র দেওয়া হয়, ইটভাটার মালিকরা অনেক সময় সেসব শর্ত পালন করেন না। গত বছর প্রায় তিনশ’র ওপরে ইটভাটা বন্ধ করা হয়েছে। এ বছর ইতোমধ্যে কয়েকশ ইটভাটা বন্ধ করা হয়েছে।

 

তিনি বলেন, অনেক সময় আমরা শুনতে পাই কিছু কিছু অসৎ কর্মকর্তা অবৈধ ইটভাটা থেকে সুবিধা নিয়ে থাকে। তারা ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তাদের সাহায্য করে। এটা আমরা তদন্ত না করে বলতে পারছি না, আবার এসব নাকচও করতে পারবো না। তাই এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারো কাছে তথ্য থাকলে যেন আমাদের অভিযোগ দেয়।

 

এ বিষয়ে ঢাকা জেলা প্রসাশক আনিউর রহমান বলেন, এসব ইটভাটার বিষয় আমাদের একটি জরুরী সভা হবে। সেখানে সকল তথ্য প্রমাণসহ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

গ্রামের কৃষকদের হয়রানি ও পুলিশের রক্ষকের ভূমিকা পালনের বিষয়ে জানতে চাইলে ধামরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আতিকুল রহমান, এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। এ ঘটনায় কোনো অভিযোগও আসেনি। বিষয়টি আমি প্রথম আপনার কাছে শুনলাম।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version