-->

শাহজালাল বিমানবন্দরে বেড়েছে অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য

নিজস্ব প্রতিবেদক
শাহজালাল বিমানবন্দরে বেড়েছে অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য

শাহজালাল বিমানবন্দরে বেড়েছে অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য। বিদেশ থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষ দেশে ফেরেন। ফলে এক জায়গায় বেশি মানুষের আনাগোনার মাঝে টার্গেট খুঁজে পেতে বিমানবন্দরে আগের চেয়ে বেশি সক্রিয় হয়েছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। ২০২২ সালে থেকে শাহজালাল বিমানবন্দরে সক্রিয় হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাদের তৎপরতা অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছ্নে, বিমানবন্দরে অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য বন্ধ না হলে বিদেশফেরত যাত্রীরা আরও বেশি করে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবেন।

 

রাজধানীতে অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য নতুন কিছু নয়। তবে এবার তাদের তৎপরতা বেড়েছে বিমানবন্দরে। টার্গেট বিদেশফেরত যাত্রীরা। ইতোমধ্যে বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের অজ্ঞান করে মূল্যবান মালামাল লুটের ঘটনাও ঘটেছে। তাদের প্রয়োগ করা নেশা জাতীয় দ্রব্যের বিষক্রিয়ায় স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে পড়ছেন যাত্রীরা। বিদেশফেরত যাত্রীদের অভিযোগের ভিত্তিতে অজ্ঞান পার্টির একাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করেছে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ (এপিবিএন))।

 

সূত্র জানায়, বিদেশ থেকে যারা আসেন,তারা পরিবারের জন্য মোবাইল, গয়না, ঘড়িসহ মূল্যবান উপহার-সামগ্রী নিয়ে আসেন। এছাড়াও প্রবাসীদের সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা ও দামি জিনিসপত্র থাকে।

 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, দিনে কমপক্ষে ২০ হাজার যাত্রী (আসা ও যাওয়া) এই বিমানবন্দর ব্যবহার করেন। যাত্রীদের বিদায় জানাতে কিংবা নিতে আরও এক লাখের বেশি মানুষ বিমানবন্দরে আসেন। এক জন যাত্রীকে বিদায় জানাতে ১০-১৫ চলে আসেন অনেক সময়। একই ঘটনা ঘটে বিদেশ ফেরত যাত্রীদের নিতে আসা স্বজনদের ক্ষেত্রেও। বিমানবন্দরে যাত্রী ও তাদের স্বজনরা আবেগ-অনুভূতির মধ্যে থাকেন।

 

এ কারণে শাহজালালের মতো ছোট একটি বিমানবন্দরে এত মানুষের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে হয় সাবধানে। টার্মিনালের সামনের এলাকায়ও যদি যাত্রীর স্বজনদের পরিচয় নিশ্চিত করে প্রবেশের নিয়ম করা হয়, তাহলে তা যাত্রীর স্বজনদের জন্য বিরক্তির কারণ হতে পারে। অপরদিকে পুলিশের পর্যাপ্ত জনবল নেই। ফলে যাত্রীদের সচেতন হতে হবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে পুলিশকে জানালে ব্যবস্থা নেয়া সহজ হবে।

 

জানা গেছে, বিমানবন্দরের পার্কিং এলাকায় তাদের আনাগোনা বেশি। সেসব যাত্রী একা একা গাড়ি ভাড়া করে বাড়ি ফেরেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদেরই টার্গেট করে থাকে এই চক্র। বিদেশফেরত যাত্রীদের সঙ্গে প্রথমে গোশগল্পে মেতে ওঠে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। তারপর নানা ধরনের কথা বলে যাত্রীদের আস্থা অর্জন করে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই বন্ধু হয়ে ওঠে। অনেক তো গল্প হলো এবার বাড়ি ফেরার পালা।

 

যাত্রী যখনই বলছেন, তার বাড়ি নোয়াখালী, তখন অজ্ঞান পার্টির ওই সদস্যের বাড়িও নোয়াখালী কিংবা লক্ষীপুর হয়ে যায়। আর যাত্রী যদি বলেন, তার বাড়ি সিলেট। তখন অজ্ঞান পার্টির সদস্যরাও বলে তাদের বাড়ি সিলেট কিংবা শ্রীমঙ্গল এলাকায়। অর্থাৎ বিদেশফেরত যাত্রী যে এলাকায় যাবেন, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরাও ওই একই এলাকায় যাবার কথা বলে।

 

এভাবে একই এলাকা বা পাশাপাশি এলাকায় বাড়ির কথা বলে বিদেশফেরত যাত্রীর সঙ্গে অল্প সময়ে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করে তোলে প্রতারক চক্র। দুজনে একইসঙ্গে গেলে নিরাপদে যেতে পারবেন, একসঙ্গে গাড়ি ভাড়া করলে খরচ কম হবে, সময়ও কাটবে দারুণ বিদেশফেরত ব্যক্তিকে এমন প্রস্তাব দেয় অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। প্রস্তাবে রাজি হওয়ার পর শুরু হয়ে যায় ছদ্মবেশী এই চক্রের আসল তৎপরতা। কখনও গাড়িতে ওঠার আগে, কখন গাড়িতে ওঠার পর জুস,পানি কিংবা কোমল পানীয় খেতে দেয় তারা। আর তা খেয়ে বিদেশফেরত যাত্রী অজ্ঞান হয়ে গেলে মালামাল লুটে নিয়ে কেটে পড়ে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা।

 

আবার কখনও কখনও বিদেশফেরত যাত্রীর স্ত্রী,বোন বা ভাইয়ের জন্য ফারফিউম উপহার দেয় অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। ‘ঘ্রাণ পছন্দ হয়েছে কিনা দেখেন, না হলে আরেকটা দেবো, এখনই চেক করেন’, বলে চক্রের সদস্যরা। তখনই গন্ধ শুকতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন বিদেশ ফেরত যাত্রী।

 

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। হাজারো মানুষের ভিড়ে যাত্রীর বেশধারী অজ্ঞান পার্টির কৌশল শুরুতে নজরে আসেনি তাদের। কয়েকজন ভুক্তভোগী যাত্রী অভিযোগ করার পর নড়েচড়ে বসে তারা। গ্রেফতার করা হয় অজ্ঞান পার্টির সক্রিয় সদস্যদের। একইসঙ্গে বিমানবন্দরে বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। বিভিন্ন মাধ্যমে যাত্রীদের সচেতন করতে চালানো হচ্ছে প্রচারণা।

 

এর আগে ২০২২ সালের ১ অক্টোবর বিমানবন্দর থানা ও কদমতলী থানা এলাকা থেকে অজ্ঞান পার্টি চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলো মো. আমির হোসেন (৫২), মো. লিটন মিয়া ওরফে মিল্টন (৪৮), আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে পারভেজ (৩৫) ও জাকির হোসেন (৪০)। তারাও যাত্রীর ছদ্মবেশ ধরে বিমানবন্দরে অবস্থান নিত। তবে তাদের সহযোগিতা করতো বিমানবন্দরে ফাস্টফুডের দোকানের এক কর্মী।

 

ওই ঘটনায় র‌্যাব জানিয়েছিল, সেই চক্রের মূলহোতা মো. আমির হোসেন। বিমানবন্দর এলাকায় একটি ফাস্টফুডের দোকানে চাকরি করে সে। তবে তার মূল কাজ বিদেশ ফেরত যাত্রীদের টার্গেট করা। চক্রটি বিদেশ ফেরত যাত্রী, যাদের কোনো আত্মীয়স্বজন বা সঙ্গে কোনো গাড়ি থাকতো না, তাদের ফাঁদে ফেলে মালামাল লুট করে নিত। র‌্যাবের হাতে আটকের পর কৌশল বদলে ফেলে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। কিছুদিন বিরতি দিয়ে নতুন কৌশলে আবারও মাঠে নামে।

 

বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ জানায়, গত ৮ ও ১১ জুলাই দুই জন যাত্রীকে অজ্ঞান করে তাদের সর্বস্ব লুটে নেয়ার দুটি অভিযোগ আসে তাদের কাছে। বিমানবন্দরের পার্কিং এলাকায় যাত্রীবেশে বারেক ও আমিরের সঙ্গে পরিচয় হয় ভুক্তভোগীদের। একসঙ্গে শেয়ারে গাড়িতে ওঠার প্রস্তাবে রাজি হয়ে আক্রান্ত হয়েছেন ওই দুই যাত্রী।

 

১৭ আগস্ট রাতে বিমানবন্দর এলাকায় শিকারের আশায় যাত্রীবেশে ঘুরে বেড়ানো অবস্থায় অজ্ঞান পার্টির সদস্য মো. মামুনকে (৩১) গ্রেপ্তার করে এপিবিএন সদস্যরা।

 

জানা গেছে, চলতি বছরের ১৪ জুলাই বিমানবন্দরকেন্দ্রিক মলম এবং অজ্ঞান পার্টির মূল হোতা দুই জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা হলো বারেক সরকার (৪২) ও আমির হোসেন (৫২)। এপিবি জানায়, গ্রেপ্তারকৃত দুই জনই পেশাদার ডাকাত ও অজ্ঞান পার্টির সক্রিয় সদস্য। গ্রেপ্তার এই আমির হোসেনই ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে র‌্যাবের হাতে আটক হয়েছিল। জামিনে ছাড়া পেয়ে আবারো একই কাজে নেমেছে সে।

 

বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের অতিক্তি পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জিয়াউল হক বলেন, বিমানবন্দর এলাকায় অজ্ঞান পার্টির কয়েকটি চক্রের সদ্যদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে এপিবিএন। এ বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যাত্রীদের সচেতন করতেও প্রচারণা চালানো হচ্ছে।’

 

মুহূর্তের পরিচয়ে কাউকে বিশ্বাস করলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনা করে যাত্রীদের সচেতন হতে হবে জানিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জিয়াউল হক বলেন, ক্ষণিকের পরিচয়ে কারও সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করা কখনোই উচিত নয়। অপরিচিত মানুষের সঙ্গে শেয়ারে গাড়ি ভাড়া করাও ঝুঁকিপূর্ণ। একইসঙ্গে বাস, ট্রেন, গাড়ি যেখানেই হোক না কেন, অপরিচিত মানুষের দেয়া পানি, খাবার গ্রহণ করা যাবে না। সবাই যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হয়ে ওঠেন, তাহলে এ ধরনের প্রতারক চক্র কারও ক্ষতি করতে পারবে না। এছাড়া কাউকে সন্দেহভাজন মনে হলে, কিংবা ভুক্তভোগী হয়ে গেলে, পুলিশকে অভিযোগ জানাতে হবে।

 

সর্বশেষ ১২ সেপ্টেম্বর যাত্রী বেশে বিমানবন্দরের ভেতরে ঘোরাঘুরি করতে থাকা মো.কামাল মিয়া নামে একজন অজ্ঞান পার্টির সদস্যকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে এপিবিএন। এর আগে ৩১ আগস্ট ও ৭ সেপ্টেম্বর অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়া দুই যাত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয় কামালকে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version