রাজধানীতে বেড়েছে সন্ত্রাসী তৎপরতা

রুদ্র মিজান
রাজধানীতে বেড়েছে সন্ত্রাসী তৎপরতা

রুদ্র মিজান: রাজধানীজুড়ে আতঙ্ক। বেড়েছে সন্ত্রাসী তৎপরতা। প্রায়ই শোনা যাচ্ছে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি। টার্গেটকৃত ব্যক্তি ছাড়াও গুলিবিদ্ধ হচ্ছেন পথচারীরা। ঘটছে মৃত্যু। রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে ঢাকার রাজপথ। ঢাকা ভাগাভাগি হচ্ছে সন্ত্রাসীদের মধ্যে। কে কোন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেবে এ নিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডে চলছে এক ধরণের যুদ্ধ। সরকারি টেন্ডার থেকে শুরু করে ফুটপাত পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে এসব সন্ত্রাসী। আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে ঘটছে রক্তারক্তি। এই সন্ত্রাসের সর্বশেষ শিকার হয়েছেন মোটরসাইকেল আরোহী আইনজীবী ভুবন চন্দ্র শীল। স্বল্প আয়ের এই মানুষটির চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস^ হয়েছে তার পরিবার। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। গুলিবিদ্ধ ভুবন চন্দ্র শীলের মৃত্যু ঘটেছে ২৫ সেপ্টেম্বর সকালে। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। হিমেল নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। কিন্তু তার কাছ থেকে তেমন কোনো তথ্য উদ্ঘাটন করা যায়নি।

 

সূত্রমতে, একে একে সন্ত্রাসীরা জেল থেকে বের হচ্ছে। রাজনৈতিক স্বার্থেই প্রভাবশালীরা তাদের জামিনের ব্যবস্থা করছেন। মূলত সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই তা করা হচ্ছে। এমনকি দেশের বাইরে থাকা অনেক সন্ত্রাসী দেশে ফিরতে শুরু করেছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে নানামুখী তৎপরতা। আন্তর্জাতিক চাপে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছুটা নমনীয় হলেও ভিন্নপথে হাঁটছে রাজনৈতিক দলের কিছু নেতাকর্মী। প্রভাবশালী এই নেতারা নিজেরাও গডফাদার হিসেবে পরিচিত। এতে আন্ডারওয়ার্ল্ডে নতুন মেরুকরণ তৈরি হয়েছে। কয়েকজন কারাগারে বসেই কলকাঠি নাড়ছে বলেও তথ্য রয়েছে।

 

গত তিন মাস আগে প্রায় ২৬ বছর কারাভোগ করার পর জামিনে মুক্ত হন শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ মামুন। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আশির দশকে ঢাকা সিটি কলেজের ছাত্র থাকাকালে সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিতি গড়ে উঠে তার। ৯০ দশকে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে অন্যতম তারিক সাঈদ মামুন, সানজিদুল ইসলাম ইমন। ওই সময়ে পাং বাবু নামে তাদেরই এক বন্ধুর হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে যায় ইমন। এ মামলার প্রধান আসামি হলেও প্রভাবশালীদের চাপে পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বাধ্য হয়। পাং বাবু হত্যার পরপরই মামুন, হেলাল ও জোসেফকে নিয়ে বাহিনী গড়ে তোলে ইমন। পরে ধানমন্ডি এলাকায় জব্বার নামে একজনকে হত্যা করে এ বাহিনী। ১৯৯৮ সালে ঘটে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যাকাণ্ড। এ হত্যার দায়ে প্রথমে মামুন, পরে ইমনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এছাড়াও সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু হত্যা মামলার আসামি এই মামুন ও ইমন।

 

সূত্রমতে, কারাগারে বসে ইমনসহ কয়েক সন্ত্রাসী ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে। তাদের অনুসারীরা ঢাকার প্রতিটি মহল্লাতে রয়েছে। কারামুক্ত মামুনকে দিয়ে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে ইমন। কিন্তু ভিন্ন মেরুতে হাঁটছেন মামুন। মামুনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে কারাবন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালের। এ চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে পলাতক আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদের। যুবলীগের ঢাকা মহানগরের এক নেতাও রয়েছে এ চক্রে। কিন্তু ইমনকে বাদ দিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে তারেক সাঈদ মামুন। এমন তথ্যের ভিত্তিতেই দুই পক্ষের মধ্যে নতুন করে শত্রুতার তৈরি হয়েছে। যে কারণে গোয়েন্দারা ধারণা করছেন, মামুনকে হত্যার উদ্দেশ্যে গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে তেজগাঁও শিল্প এলাকার বিজি প্রেসের সামনে তার প্রাইভেট কারে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। দুই সহযোগীসহ পালানোর সময় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন মামুন। এসময় সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন ভুবন চন্দ্র শীল। পরে তার মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনায় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা করেছেন ভুবনের স্ত্রী রত্না রানী শীল। এই মামলায় হিমেল নামে এক সন্ত্রাসীকে গত সোমবার রাজধানীর গেন্ডারিয়া থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। দুই দিনের রিমান্ডে থাকা হিমেলের কাছ থেকে তেমন কোনো তথ্য উদ্ধার করা যায়নি বলে পুলিশ জানিয়েছে। রত্না রানী শীল দৈনিক ভোরের আকাশকে জানান, ধার-দেনা করে ভুবনের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হাসপাতালে সাড়ে ৮ লাখ টাকা দিতে হয়েছে। কেউ কোনো সহযোগিতা করেনি। ভুবনের খুনীরা গ্রেপ্তার হবে কিনা, এ নিয়ে সংশয় রয়েছে তার। মামলা করে তিনি উল্টো আতঙ্কে রয়েছেন বলে জানান।

 

একইভাবে গত বছরের ২৪ মার্চ রাত পৌনে ১০টার দিকে শাজাহানপুরের আমতলা ইসলামি ব্যাংক হাসপাতালের সামনে সন্ত্রাসীদের এলোপাথাড়ি গুলিতে নিহত হন মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু এবং কলেজছাত্রী প্রীতি। এসময় টিপুর গাড়িচালক গুলিবিদ্ধ হন। গত ৫ জুন সিএমএম আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমান দেয় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ইয়াসিন শিকদার। তদন্তে এই হত্যাকান্ডে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফ তালুকদার, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মারুফ আহমেদ মনসুর, ছাত্রলীগের মতিঝিল থানার সাবেক সাধারণ সম্পাদক খায়রুল ইসলাম, মতিঝিল থানা জাতীয় পার্টি নেতা জুবের আলম খান রবিন, হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক সোহেল শাহরিয়ার, ১০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি মারুফ রেজা সাগর, ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সভাপতি কামরুজ্জামান বাবুল, ১০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সদস্য কাইল্যা পলাশ, একই ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক নেতা আমিনুল, ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক সোহেল, সুমন শিকদার মুসা, মুসার ভাগনে সৈকত, মুসার ভাতিজা শিকদার আকাশ, ইমরান হোসেন জিতু, মোল্লা শামীম, রাকিব, বিডি বাবু, ওমর ফারুক, নাসির, রিফাত, ইশতিয়াক হোসেন জিতু, মাহবুবুর রহমান টিটু, হাফিজ, মাসুম ও রানা মোল্লার। তাদের মধ্যে ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ হত্যা মামলায় মুসা, শুটার আকাশ ও নাসির উদ্দিন মানিক স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের পর থেকে আতঙ্কে রয়েছেন এই মামলার বাদি টিপুর স্ত্রী ফারজানা ইসলাম ডলি। তিনি দৈনিক ভোরের আকাশকে জানান, বারবারই তাকে প্রাণে মারার হুমকি দেয়া হচ্ছে। গত ৩১ জুলাই দুপুর ১টায় মোবাইল ফোনে কল দিয়ে তাকে হুমকি দেন এক ব্যক্তি। নিজের নাম আশিক জানিয়ে তিনি হুমকি দিয়ে বলেছেন ‘আামার ছোট ভাই কাইল্যা পলাশ, গোলাম আশরাফ, সোহেল শাহরিয়ার, সাগর, মনসুররের জামিনের ব্যাপারে কোনো প্রকার বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। আমি হুমকি দেই না, আমি কাজ করে দেখাই।’ এ বিষয়ে ডিএমপির শাহজাহানপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করেছেন ডলি। পরে জামিনে মুক্ত হন কাইল্যা পলাশ ও মনসুর। সূত্রমতে, বিদেশে পলাতক সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করে শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক। ২০১৯ সালে মাদক ও অস্ত্র মামলায় যুবলীগের ঢাকা দক্ষিণের সাবেক সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট গ্রেপ্তার হলে ঢাকায় আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা করেন জিসান, মানিক। তাদের সহযোগিতা করে সোহেল শাহরিয়ার, কাইল্যা পলাশসহ শতাধিক সন্ত্রাসী। রামপুরা থেকে পল্টন পর্যন্ত আধিপত্য রয়েছে তাদের। গত বছরের ২২ আগস্ট জামিনে কারামুক্ত হন সম্রাট। কারামুক্ত হয়ে আবারো রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন তিনি।

 

সূত্রমতে, মোহাম্মদপুর ও শ্যামলী এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে ব্যাংককে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী নবী উল্লাহ নবী ও পিচ্চি হেলাল। এ দুই এলাকার বিভিন্ন খাত থেকে চাঁদা উত্তোলন করে তাদের লোকজন। তার বড় অংশ পাঠানো হয় তাদের কাছে। রামপুরা, গুলশান, বাড্ডাসহ রাজধানীর একটি বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ করে জিসান। তার হয়ে ঢাকায় সক্রিয় শতাধিক সন্ত্রাসী। তার সঙ্গে সমঝোতা করেই ভারতে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ মানিক ও মোল্লা মাসুদ গণপূর্ত, ক্রীড়া পরিষদ, রাজউক ও রেলওয়ের দরপত্র নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।

 

সন্ত্রাসীরা সক্রিয় হওয়ার পর থেকেই প্রায়ই প্রকাশ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। গত ৩০ জুলাই রাজধানীর শান্তিনগরে গুলিতে গুরুতর আহত হন শ্রমিক নেতা মানিক। গোলাগুলির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সড়ক পরিবহন ও যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাচ্চু ও তার গৃহকর্মী রুবেলকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। এ ঘটনায় মানিকের স্ত্রী সাজেদা বেগম বাদী হয়ে রমনা থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলায় তিনি অভিযোগ করেছেন, বাচ্চু তার বেইলি রোডের নিজ ফ্ল্যাটে হত্যার উদ্দেশ্যে মানিককে গুলি করে আলামত নষ্ট করেছেন। সূত্রমতে, অবৈধ টাকার ভাগ-বাটোয়ারাকে কেন্দ্র করে এই গুলির ঘটনা ঘটে। গোয়েন্দারা জানান, অবৈধ অস্ত্র দিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে প্রায়ই। এই ছিনতাইকারীরা এখন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে।

 

এসব বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সাহা বলেন, অপরাধীদের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নেই। অপরাধী যেই হোক তাকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। অপরাধীদের সম্পর্কে যথাযথ তথ্যপ্রমাণ পেলে পুলিশ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সন্ত্রাসীরা যাতে কোনো অপকর্ম করতে না পারে সেজন্য পুলিশ ও গোয়েন্দারা সক্রিয় রয়েছে বলে জানান তিনি।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য