-->
শিরোনাম

রাজধানীতে বেপরোয়া কিশোর-তরুণ গ্যাং

রুদ্র মিজান
রাজধানীতে বেপরোয়া কিশোর-তরুণ গ্যাং

রুদ্র মিজান: বেপরোয়া হয়ে ওঠছে কিশোর-তরুণ গ্যাং। রাজনৈতিক দলের পাড়া-মহল্লার নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেপরোয়া এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা। আধিপত্য বিস্তার থেকে শুরু করে মাদক সেবন-বিক্রি, ছিনতাই ও যৌন হয়রানিতে লিপ্ত হচ্ছে তারা। প্রায়ই ঘটছে হামলা, সংঘর্ষের মতো ঘটনা। এমনকি হত্যার মতো নৃশংস ঘটনাও ঘটছে কিশোর গ্যাং সদস্যদের হাতে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের হয়ে কাজ করছে কোনো কোনো কিশোর-তরুণ গ্যাং।

 

পুলিশের হিসেবে রাজধানী ঢাকায় ৫২টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। বুলেট গ্রুপ, আব্বা গ্রুপ, বড় ভাই, ভাইয়া, অ্যাকশন, ডিসকো, ডিজে, লাভার বয়স্, টাইগার, লায়ন, পোলাপান, কঠিন ভয়েস গ্রুপ.. এসব নানা নামে রয়েছে এসব গ্যাং। এসব গ্যাংয়ের সদস্য প্রায় সাত শ’। এ রকম একটি গ্যাংয়ের ভয়ঙ্কর রূপ দেখেছে মোহাম্মদপুরের বসিলাবাসী। গত ১ অক্টোবর সন্ধ্যার পরপরই ওই এলাকায় গণহারে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ছিনতাইয়ের আগে সশস্ত্র অবস্থায় ২৫-৩০ কিশোর-তরুণ ছুটে যায় ঢাকা উদ্যানে। উদ্দেশ্য আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে প্রতিপক্ষ গ্যাংয়ের সদস্যদের ওপর হামলা করা। কিন্তু প্রতিপক্ষের দেখা মিলেনি। বেপরোয়া গ্যাং সদস্যরা তখন যাকে সামনে পায় তার ওপরই হামলা চালায়। মারধর করে ছিনিয়ে ফোন, মানিব্যাগসহ সর্বস্ব। এমনকি তাদের যৌন হয়রানির শিকার হন ওই এলাকার তরুণীরা। রাস্তার দোকানগুলোতে ভাঙচুর চালিয়ে আতঙ্ক তৈরি করে। অন্তত ১৫ থেকে ২০টি দোকানের মালামাল লুট করে তারা। তাদের হামলায় কয়েকজন আহত হন। বসিলা গার্ডেন সিটি হাউজিং এলাকায় শুরু হয় এই তান্ডব। অন্তত দুই কিলোমিটার দূরে চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকা পর্যন্ত গ্যাং সদস্যদের তান্ডবের শিকার হন সাধারণ মানুষ।

 

বাসার পাশে নদীর ওয়াকওয়েতে হাঁটতে গিয়ে ছিনতাই ও যৌন হয়রানির শিকার হন কিছু তরুণী। এরমধ্যে চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকার এক তরুণী বলেন, হঠাৎ কয়েক ছেলে আমাকে ঘিরে ধরে হুমকি দেয়। গলায় অস্ত্র ধরে আমার মোবাইলফোন নিয়ে নেয়। টাকার জন্য আমার শরীরে তল্লাশির চেষ্টা করে। তখন তিনি দৌড় দিলে তাকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে বলে জানান এই তরুণী। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তাদের সবার হাতেই ধারল অস্ত্র ছিল। প্রকাশ্যে অস্ত্র দেখিয়ে এক ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে তারা।

 

জানা গেছে, ‘সিন্ডিকেট বাদল’ নামে এক সন্ত্রাসীর আশ্রয়-প্রশয়ে গড়ে উঠেছে এই কিশোর গ্যাং। ফুটপাত ও অটোরিকশা থেকে চাঁদা আদায় করে এই চক্র। তাদের মূল হোতা কারাবন্দি ভয়ঙ্কর শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল। হেলাল নিজে বিএনপিপন্থি হলেও যখন যে সরকার ক্ষমতায় তাদের লোকজনকেই ব্যবহার করে নিজের চাঁদাবাজির রাজত্ব টিকিয়ে রেখেছেন বলে জানা গেছে। বাদলের মাধ্যমে মোহাম্মদপুরে একটি কিশোর-তরুণ গ্যাং তৈরি করেছেন পিচ্চি হেলাল। এই গ্রুপে ১৬ বছরের কিশোর থেকে ৩০ বছরের তরুণরাও রয়েছে। তাদের বেশিরভাগ বেকার। তাদের মধ্যে শ্রমিক, শিক্ষার্থীরাও রয়েছে। মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাহফুজুল হক ভূঞা বলেন, এ ঘটনায় ডাকাতির মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার ১৪ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মূলত এরা সবাই কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের সদস্য। তারা নানা অপকর্মে জড়িত বলে জানান ওসি।

 

ঢাকায় সব চেয়ে বেশি গ্রুপ রয়েছে মিরপুরে। ওই এলাকায় ১৭২টি গ্রুপ রয়েছে। এরমধ্যে পল্লবীতেই রয়েছে প্রায় ১০টি গ্রুপ। এরমধ্যে আশিক গ্রুপের আধিপত্য বেশি। এই চক্রে ৩০ জনের মতো সদস্য রয়েছে। এই চক্রের নেতা আশিক পল্লবী থানা ছাত্রলীগের এক নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় বেপরোয়া বলে অভিযোগ রয়েছে। একইভাবে বেপরোয়া মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের পিন্টু-কালু গ্রুপ। এই গ্রুপটি ঢাকা মহানগর উত্তরের আওয়ামী লীগের এক নেতা ও যুবলীগের এক সদস্যের পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।

 

মিরপুরের একটি কিশোর গ্যাংয়ের প্রধান আরিফ মিয়া (২৩)। তার গ্রুপের নাম ‘তোমাদের আরিফ ভাইয়া’। ওই গ্রুপে ১৫-২০ জন সদস্য। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে তারা। গ্রুপের কোনো সদস্য কোথাও আক্রান্ত হলে অন্যরা ছুরি, লাঠি নিয়ে সেখানে হামলা করে। চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িত এই গ্রুপ। গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে মিরপুরের জার্মান টেকনিক্যালের সামনে থেকে তিন সহযোগীসহ আরিফকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবেদ জানান, আরিফ মিরপুরের চিহ্নিত কিশোর গ্যাং প্রধান। তার দলের নাম তোমাদের আরিফ ভাইয়া। দলবল নিয়ে বিভিন্ন স্থানে মারামারি করা, আতঙ্ক সৃষ্টি করাই তাদের কাজ।

 

গত ১৫ আগস্ট বেইলি রোডে বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়েই কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় গুরুতর আহত হন সদ্য এসএসসি পাস করা আরিয়ান। সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের এই হামলা চালায় ওই এলাকার হামিম গ্রুপ নামের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। লাঠি, রড, ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয় তাকে। সেইসঙ্গে এলোপাতাড়ি লাথি-ঘুসি। প্রাণ বাঁচাতে রক্তাক্ত শরীরে ছুটতে থাকে আরিয়ান। পেছনে হামলাকারীরাও ছুটতে থাকে। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা তুলে নিতে প্রতিনিয়ত হুমকি দেয়া হয় বাদীকে।

 

গত ৩০ জুলাই রাতে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর বেড়িবাঁধ মাহাদিনগরে কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের ধারাল অস্ত্রের আঘাতে রাসেল মোল্লা ও মাসুদ রানা নামে দুই কিশোর আহত হয়েছেন। আহত রাসেল জানান, সন্ধ্যায় যখন তিনি নিজের বাসায় ফিরছিলেন তখন তার ওপর হামলা করা হয়। ওই এলাকার রাকিব, আব্দুল্লাহ, প্যাডিস, প্রিন্স, তারেকসহ ২০-২৫ জন ধরে নিয়ে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে তাকে। পরবর্তীতে মাসুদকেও ছুরিকাঘাত করে এই গ্যাং। ওই কিশোরদের মধ্যে মাসখানেক আগে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনার জের ধরেই তাদের দুজনকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়। এভাবে প্রায় প্রতিদিন ঘটছে হামলা, পাল্টা হামলার ঘটনা।

 

গ্যাং সদস্যদের হাতে ঘটছে হত্যাকান্ডও। গত ২১ মে রাতে কিশোর গ্যাং সদস্যের ছুরিকাঘাতে সিয়াম (১৪) নামে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক কিশোর নিহত হয়। রাজধানীর দারুস সালামের লালকুঠির বসুপাড়া এলাকায় হত্যাকান্ড ঘটে। প্রত্যক্ষ্যদর্শীদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, রাজধানীর দারুস সালাম থানার লালকুটিতে দুর্বৃত্তরা স্কুলছাত্র সিয়ামকে পরিকল্পিতভাবে ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

 

গ্যাং কালচারের শিকার হয়ে ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো প্রাণ হারায় উত্তরার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির। ওই বছরের ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কের খেলার মাঠে তাকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ধানমন্ডি, তেজগাঁও, রামপুরা, খিলগাঁও, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, জুরাইনসহ রাজধানীর প্রতিটি অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে পড়েছে গ্যাং কালচার। গোয়েন্দাদের তথ্যানুসারে নানা অপকর্মে লিপ্ত তারা।

 

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমাজ ও অপরাধ-বিজ্ঞানী তৌহিদুল হক বলেন, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে সুস্থ বিনোদন না থাকলে, নৈতিক শিক্ষার অভাব থাকলে কিশোর-কিশোরীদের বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শুধু পুলিশি তৎপরতায় এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ করা যাবে না। এজন্য সামাজিকভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবার থেকে সমাজ, শিক্ষক ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঠিক ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version