ইমরান খান: প্রায় প্রতিদিনই আকাশপথে আসছে অবৈধ স্বর্ণ। বিদেশে পাচার করা হচ্ছে দেশের অর্থ। কখনো কখনো বিদেশে জব্দ হচ্ছে দেশ থেকে অবৈধভাবে নিয়ে যাওয়া শত শত কোটি টাকা। দিন দিন এই চোরাচালান, অর্থপাচার বেড়েই চলেছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হতে পারে ধারণা করছেন অনেকে।
এসব ধারণা থেকেই অর্থপাচার আরো বেড়ে যেতে পারে। যদিও দীর্ঘদিন থেকেই নানা কৌশলে বিমানবন্দর হয়ে দেশের বাইরে পাচার হচ্ছে বিপুল অর্থ। সরকারকে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে দেশে ঢুকছে স্বর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে অর্থপাচার ও চোরাচালানের করিডর পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। কোনোভাবেই তা প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। এই অপকর্মে জড়িত বিমানবন্দরে-বিমানে কর্মরতদের কেউ কেউ।
এদের রয়েছে এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। মূলত ভারতে পাঁচারের জন্যই বাংলাদেশে এই স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে আনা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালান রুটের সবচেয়ে বড় করিডরগুলোর একটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। আবার ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানি করতে যে পরিমাণ টাকার এলসি করেন, তার ১০ গুণ পাঠান হুন্ডির মাধ্যমে। সে টাকাই প্রধানত সোনা চোরাচালানে ব্যবহার হয়। নানাভাবে দেশের অর্থ পাচার হচ্ছে বিদেশে। অর্থপাচারসহ চোরাচালান প্রতিরোধে এবার হযরত শাহজালাল (র.) আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে বিশেষায়িত পৃথক ইউনিট গঠন করেছে সরকার।
একজন যুগ্ম কমিশনারের নেতৃত্বে ১২ জনের এই দলটি চার শিফটে দায়িত্ব পালন করবেন। গত ১৫ অক্টোবর ঢাকা কাস্টম হাউস থেকে এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করা হয়। পরের দিন ১৬ অক্টোবর থেকেই ইউনিটটি তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ইউনিটটির প্রধান ঢাকা কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার মিনহাজ উদ্দিন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১২ জন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা নিয়ে নতুন এ ইউনিট। তারা হলেন মোহাম্মদ জাফর, মো. তৌহিদুজ্জামান, জান্নাতুল মাওয়া, মো. সোহেল, মো. সানোয়ার হোসেন, জুয়েল চক্রবর্তী, আল আমিন রিয়ন, নাজমুল বাসার, নাজমুল হোসেন, সারোয়ার কবির, এ কে এম আনিসুর রহমান ও খাদেমুল ইসলাম। ১২ জনের এ দলটি শিফট এ, শিফট বি, শিফট সি এবং শিফট ডিতে দায়িত্ব পালন করবেন।
আদেশে বলা হয়েছে, প্রতিটি শিফটের সদস্যরা ফ্লাইট রামেজিং সম্পাদন, বোর্ডিং ব্রিজ এলাকায় টহল ও চেকিং কার্যক্রম, ডিপার্চার স্ক্যানিং তদারকি এবং গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কাস্টম হাউসের আর কোনো দায়িত্ব পালন করবেন না। শুধুমাত্র তাদের এ কাজের জন্য ডেডিগেটেড করে দেয়া হয়েছে। ইউনিটের প্রতিটি সদস্যকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিতিও করা হয়েছে। প্রিভেনটিভ টিম পূর্বে চোরাচালান রোধে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করত। পাশাপাশি আমদানি পণ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অ্যাসেসমেন্ট করার কারণে চোরাচালান প্রতিরোধসহ অন্যান্য কার্যক্রমে সঠিকভাবে সময়ও দিতে পারতেন না।
এক রকম তাদের ওপর কাজের চাপও বাড়ত। কিন্তু বর্তমানে এ ইউনিটটিকে নির্দিষ্ট একটি কাজের জন্য নির্ধারণ করে দেয়ার কারণে শাহজালাল দিয়ে অর্থপাচারসহ অন্যান্য পণ্য চোরাচালান হিসেবে বাইরে চলে যাওয়া এবং দেশের অভ্যন্তরে আসার প্রবণতা একেবারে কমে আসবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশ থেকে অর্থপাচারসহ স্বর্ণসহ নানা পণ্য চোরাচালানের মাধ্যমে দেশ থেকে বাইরে যাওয়া কিংবা দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের আশঙ্কা থাকে। ইউনিটটি সঠিকভাবে দায়িত্বপালন করলে এগুলোর আশঙ্কাও একেবারে কমে যাবে। দীর্ঘদিন থেকেই নানাভাবে স্বর্ণসহ চোরাচালন প্রবেশ করছে দেশে। অনেকক্ষেত্রে বাংলাদেশ হয়ে উঠছে চোরাচালানের রুট।
গোয়েন্দা তথ্যমতে, ভারতে পাঁচারকৃত স্বর্ণের ৭৩ শতাংশই যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। মধ্যপ্রাচ্য-আফ্রিকাসহ অন্যান্য উৎস থেকে পাঁচার হওয়া সোনার সবচেয়ে বড় করিডর এখন বাংলাদেশ। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ হয়ে ভারতে স্বর্ণ পাঁচার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে বিজিবি সীমান্তে পাঁচারের সময় মোট স্বর্ণ আটক করেছিল ৫৯ কেজি ৪৬৮ গ্রাম।
আর চলতি ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই ১২১ কেজি ৪৭৯ গ্রাম স্বর্ণ আটক হয়েছে। এসব প্রতিরোধের পরিকল্পনা থেকেই বাছাইকৃত যোগ্য কিছু কর্মী নিয়ে গঠন করা হয়েছে বিশেষায়িত পৃথক ইউনিট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত রোববার ১৫ অক্টোবর আদেশ হওয়ার পরের দিন থেকেই দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন ইউনিটটির সদস্যরা। বিমানবন্দরের বহির্গমন, আগমনী, আমদানী, রপ্তানি কার্গো এলাকা নজিরবিহীন নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। পাশাপাশি বহির্গমনের সময় স্ক্যানিং তদারকি অন্যান্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে আগমনী এলাকাতেও বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। সন্দেহজনক যাত্রীর লাগেজ তল্লাশিও করা হচ্ছে। জানা যায়, ইউনিটের সদস্যরা আমদানি ও রপ্তানি কার্গো এলাকাতেও তল্লাশি চালাচ্ছেন। সন্দেহজনক মনে হলেই তারা স্ক্যানিংয়ের আওতায় আনছেন।
ইউনিটের প্রধান যুগ্ম কমিশনার মিনহাজ উদ্দিন বলেন, এটি আমাদের একটি বিশেষায়িত ইউনিট। এ ইউনিটের প্রতিটি সদস্যকে আমরা বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এরা মূলত অর্থপাচারসহ চোরাচালান প্রতিরোধ করবে।
তিনি বলেন, ঢাকা কাস্টম হাউস এই প্রথম এ ধরনের একটি বিশেষ ইউনিট গঠন করল। এর আগে প্রিভেনটিভ ইউনিটের আওতায় এই কাজগুলো হতো। তবে এই টিমকে এ কাজে ডেডিগেটেড করে দেয়া হয়েছে। তবে প্রিভেনটিভ টিমও তাদের কাজের পাশাপাশি এ কাজও করবেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ গোয়েন্দা সংস্থা বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। আমরাও এই টিমের মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছি। নির্বাচনকে সামনে রেখে বিমানবন্দর কেন্দ্রিক চোরাচালানিরা যেন কোনো অবৈধ পণ্য নিয়ে আসতে না পারেন কিংবা দেশ থেকে বাইরে না যেতে পারে সেজন্য আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।
তিনি বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্যই হলো বিমানবন্দর কেন্দ্রিক চোরাচালান শূন্যের কোটায় আনা। সেই লক্ষ্যেই আমাদের টিমের সদস্যরা কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য