-->

বিদেশে যেতে পারবে না সোনা চোরাকারবারিরা

ইমরান খান
বিদেশে যেতে পারবে না সোনা চোরাকারবারিরা

ইমরান খান: কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেও থেমে নেই স্বর্ণ চোরাচালান। প্রতি মাসেই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের তিন বিমানবন্দরে জব্দ করা হচ্ছে স্বর্ণের চালান। কোনো কোনো চালানে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার স্বর্ণও জব্দ করেছে কাস্টমস এবং শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। তারপরেও স্বর্ণের চালান আসছেই। স্বর্ণ চোরাচালানে বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

 

এবার স্বর্ণের চোরাকারবারিদের থামাতে ভিন্নরকম এক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। যাত্রীবেশে বিদেশ থেকে অবৈধ উপায়ে স্বর্ণ নিয়ে আসা চোরাকারবারিদের পাসপোর্ট কালো তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি। যারা বিভিন্ন সময় বিদেশ থেকে অবৈধ উপায়ে স্বর্ণ নিয়ে আসার সময় বিমানবন্দরে কাস্টমস ও শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের হাতে আটক হয়েছেন সেসব পাসপোর্টধারীদের কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। ইতোমধ্যে দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনসহ কর্মরত সকল সংস্থাকে এ বিষয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে স্বর্ণের চোরাচালান অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

 

ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে দেয়া ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বিমানবন্দরে আগত যাত্রীদের যাত্রীসেবা প্রদান, রাজস্ব সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, চোরাচালান ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছে ঢাকা কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ। এ সকল কার্যক্রমের অংশ হিসেবে কিছু ব্যক্তি বিদেশ হতে আগমনকালে শুল্ক ফাঁকি, নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত পণ্য পরিবহনসহ চোরাচালানের দায়ে কাস্টম কর্তৃপক্ষের অভিযুক্ত হয়েছেন এবং এ সংক্রান্ত মামলাসমূহ বিচারাধীন রয়েছে।

 

এ সকল যাত্রীগণের মাধ্যমে অবৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা পরিবহন ও পাচারের ঝুঁকি রয়েছে। এমতবস্থায় ওই সকল যাত্রীগণ বিদেশভ্রমণকালে বিমানবন্দর কাস্টমকে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হলো। একই সঙ্গে যাত্রীগণ বছরে কতবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন তা জানানোর জন্যও অনুরোধ করা হলো। সরকারি রাজস্ব সুরক্ষা, বৈদিশিক মুদ্রা পাচার ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধকল্পে বিষয়টি অতিব জরুরি। কাস্টম আইনের ১৯৬৯-এর সেকশন ৭ মোতাবেক এ সহায়তা চাওয়া হলো।’ এই চিঠিই দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই দেয়া হয়েছে।

 

কাস্টম কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে এক শ্রেণির যাত্রীরা ঘন ঘন বিদেশ যাচ্ছে। এরা মূলত মালয়েশিয়া, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে যায়। এদের কাজই হলো স্বর্ণসহ নানা ধরনের পণ্য নিয়ে আসে। এরা দেশের ভেতরে আসার সময় কাস্টম ট্যাক্স ভ্যাটও ক্লিয়ার করে।

 

কিন্তু এরা যে পণ্য নিয়ে আসে সেগুলোর কেনার জন্য যে টাকার প্রয়োজন সেই টাকা তারা হুন্ডির মাধ্যমে সেই সকল দেশে প্রেরণ করে। অর্থাৎ ব্যাংকিং চ্যানেলে এদের কোনো লেনদেন নাই। এরাই মূলত যাত্রীবেশি চোরাকারবারি। এদেরকে চিহ্নিত করার জন্যই মূলত এ চিঠি দেয়া হয়েছে।

 

সূত্র বলছে, দেশে বৈধভাবে যে পরিমাণ স্বর্ণ আসে সেগুলো দেশে থাকে না। অধিকাংশই স্বর্ণ দেশের বাইরে চলে যায়। এক্ষেত্রে দেশ থেকে যেমন টাকা চলে যাচ্ছে আবার স্বর্ণও চলে যাচ্ছে। দুই দিক থেকেই দেশের ক্ষতি হচ্ছে। এদিক বিবেচনা করে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

 

সূত্র আরো জানায়, এ সকল যাত্রীরা তারা জেনে শুনে বৈধভাবে আনার চেয়েও কিছু বেশি স্বর্ণ আনে। ওই সময় স্বর্ণগুলো জব্দ করে বিভাগীয় মামলাও করা হয়। পরবর্তীতে তারা বিচার শাখা থেকে ট্যাক্স ভ্যাট ও জরিমানা পরিশোধ করেও স্বর্ণ নিয়ে যায়। সেক্ষেত্রে সরকার শুধু ট্যাক্স ভ্যাট ও জরিমানার টাকা পায়। ফেরত পেয়ে যায় জব্দ করা স্বর্ণ। পরে ফেরত পাওয়া স্বর্ণগুলোও পাচার হয়ে যায়।

 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাস্টমের এ সিদ্ধান্তের ফলে চোরাচালান ও টাকা পাচার কমে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একই ক্ষেত্রে কাস্টমের এ উদ্যোগকে যুগান্তকারী বলেও উল্লেখ করেন। একজন যাত্রী বৈধভাবে দেশের বাইরে যাচ্ছেন আবার বৈধভাবে ট্যাক্স ভ্যাট দিয়ে স্বর্ণ আনছেন কিন্তু ওই স্বর্ণ কেনার জন্য যে পরিমাণ টাকা তিনি খরচ করেছেন সেই টাকা কিভাবে তিনি পাঠাচ্ছেন তার কোনো উত্তর নাই। অর্থাৎ সেই টাকাটা তিনি হুন্ডির মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। এক্ষেত্রে কি হলো টাকা পাচার হয়ে গেল। অথচ সবকিছু জানা শোনা সত্ত্বেও ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না।

 

কাস্টমের সিদ্ধান্তের ফলে যখন দেখা যাবে এক মাসে পাসপোর্টধারী ব্যক্তি মাসে কয়েকবার আসা যাওয়া করেছেন আর প্রতিবারই তিনি গোল্ড এনেছেন সেক্ষেত্রে ওই পাসপোর্টধারী ব্যক্তি চিহ্নিত হয়ে যাবে। তিনি যেন আর কোনোদিন দেশের বাইরে যেতে না পারেন তার জন্য সুপারিশ করবে কাস্টম। যখন দেখা যাবে এভাবে ঘন ঘন বিদেশ যাওয়া ব্যক্তি আর যেতে পারছেন না তখন টাকা পাচার ও বন্ধ হবে পাশাপাশি দেশ থেকে স্বর্ণ যেটা পাচার হচ্ছে সেটিও বন্ধ হবে।

 

এদিকে বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে বিজিবি দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে পাচারের সময় ৩১ কেজি স্বর্ণ জব্দ করেছে। আগস্টে উদ্ধার হয় ৩৩ কেজি। জুলাইয়ে ৮ কেজি, জুনে ১১ কেজি, মে মাসে ২০ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়। অর্থাৎ সীমান্ত এলাকা দিয়ে পাচারকারীরা যে স্বর্ণ পাচারের চেষ্টা ও পাচার করছে এই তথ্যই সেটি প্রমাণ করে।

 

ঢাকা কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার মিনহাজ উদ্দিন বলছেন, আমরা টাকা পাচার ও চোরাচালান রোধে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একই সঙ্গে পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলনায় দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নজরদারি বৃদ্ধি করেছি।

 

তিনি বলেন, আমরা অনুসন্ধান করেছি একজন যাত্রী সপ্তাহে দুইবার করে দুবাই যান। আসার সময় ১১০ গ্রাম করে গোল্ডবার ও অলঙ্কার নিয়ে আসেন। এই গোল্ডবার তিনি কাস্টম হলে ঘোষণা দিয়ে ট্যাক্স ও ভ্যাট দেন। অথচ এই গোল্ডবার কেনার টাকা তিনি কিভাবে পাঠিয়েছেন সেটার জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান টাকাটা হুন্ডির মাধ্যমে পাঠিয়েছেন।

 

যুগ্ম কমিশনার বলেন, এর অর্থই হলো টাকাটা পাচার হয়ে গেছে। পাশাপাশি তিনি যে গোল্ডবার নিয়ে এসেছেন সেটিও পাচার হয়ে গেছে। তাহলে দুই দিক থেকেই দেশের ক্ষতি। আবার অনেক সময় কাস্টমের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাইরে চলে গেলে কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। এটি আমলে নিয়ে নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে বৈঠকের মাধ্যমে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

 

মিনহাজ উদ্দিন বলেন, এখন থেকে যে সকল যাত্রীকে এভাবে পাওয়া যাবে তারা যেন আর কোনোভাবেই দেশের বাইরে যেতে না পারেন এমন কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে প্রতিদিন অন্তত ২০ কেজি স্বর্ণ বৈধভাবেই দেশে আসছে। এই ২০ কেজি স্বর্ণের মূল্যের টাকা হুন্ডির মাধ্যমে যাচ্ছে। তাহলে দেশ থেকে প্রতিদিন কি পরিমাণ টাকা পাচার হচ্ছে সেটি সহজেই অনুমান করা যায়। আবার দেশে আসা স্বর্ণগুলো পাচার হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার হয়ে যাওয়ার কারণে আমরা তথা দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এই সিদ্ধান্তের ফলে এটি প্রতিরোধ হবে বলে আমরা আশা করছি।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version