-->

ভার্চুয়াল প্রেমের ফাঁদ, অতঃপর ধর্ষণ

ইমরান খান
ভার্চুয়াল প্রেমের ফাঁদ, অতঃপর ধর্ষণ

ইমরান খান: ফেসবুকে পরিচয়। সময়ের ব্যবধানে বাড়ে ঘনিষ্ঠতা। সম্পর্ক গড়ায় প্রেম-ভালোবাসায়। এরপর বিয়ের আশ্বাস দিয়ে তরুণিকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়। অতঃপর প্রতারণার ফাঁদ পেতে হাতিয়ে নেয়া হয় লাখ লাখ টাকা। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয় হওয়া প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন অনেক নারী।

 

ক্রমেই বেড়ে চলছে এ ধরণের ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, সচেতন হলে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়ানো সম্ভব। আর এসব ঘটনা প্রতিরোধে মানসিকতার পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞারা।

 

২০২১ সালের ৩১ জুলাই রাজবাড়ীতে ফেসবুকে পরিচয় হওয়া প্রেমিকের হাতে ধর্ষণের শিকার হন স্কুল পড়ুয়া এক ছাত্রী। রাত দেড়টায় বাথরুম থেকে ফেরার পথে সৈকত তরুণীর মুখ আটকে ধরে ধর্ষণ করে। বিষয়টি কাউকে বললে হত্যা করার হুমকি দেয় ধর্ষক সৈকত। যে কারণে বিষয়টি সে আর কাউকেই বলতে পারেনি। কয়েকদিন পরে বিষয়টি জানাজানি হলে রাজবাড়ী থানায় মামলা করেন ভুক্তভোগী তরুণী। পরে তাকে গ্রেপ্তার করে থানা-পুলিশ।

 

ভুক্তভোগী ওই ছাত্রীর ভাষ্য, সৈকতের সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয়। ওই পরিচয়ের সূত্র ধরে সে মোবাইল ফোনে কথাবার্তা বলা শুরু করে। এক পর্যায়ে সৈকত ওই ছাত্রীকে অনৈতিক কাজের কথা বলে। তবে সে তাতে রাজি হয় না। পাশাপাশি সে সৈকতের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এতে সৈকত ক্ষিপ্ত হয় এবং তার ক্ষতি করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। যার অংশ বাথরুম থেকে ঘরে ফেরার পথে সৈকত তার মুখ আটকে ধরে ধর্ষণ করে।

 

একই রকম ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামের রাউজানেও। ফেসবুকে বন্ধুত্বের জেরে চট্টগ্রামের রাউজানে স্কুল পড়ুয়া কিশোরী দেখা করতে যান তার প্রেমিকের সঙ্গে। সেখানে গিয়ে দেখেন প্রেমিকের বয়স ৫৫। প্রতারণার ফাঁদে ফেলে এতদিন সম্পর্ক করে আসছেন। কিন্তু সুচতুর এই ব্যক্তি কৌশলে আটকে দেয় তরুণীকে। প্রায় দেড় মাস আটকে রেখে চালান পাশবিক নির্যাতন। পরে কৌশলে পরিবার আর পুলিশের সহায়তায় কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় ৫৫ বছর বয়সি প্রতারক-ধর্ষক নাছির উদ্দিনকে।

 

ফেসবুকসহ অন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারী-পুরুষের বন্ধুত্বের সম্পর্কে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। অনেকটাই ফাঁদ পেতে গড়া সম্পর্কে দেখা করতে গিয়ে ঘটছে ধর্ষণের মতো ঘটনা। অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে নিজের সম্পর্কে ভুয়া তথ্য দিয়ে নারীদের আকর্ষণ করার ফাঁদ পাতা হচ্ছে। আর ফাঁদে পা দিয়ে নারীরা তাদের সম্ভ্রম হারাচ্ছেন। পারিবারিক ও সমাজিকভাবে নিগৃহিতের শিকার হচ্ছেন। অনেকেই উপায়হীন হয়ে আইনের আশ্রয় নিলে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে প্রতারকদের।

 

জানা গেছে, ফেসবুকে পাইলটের ভুয়া প্রোফাইল তৈরি করে এই প্রতারক নিঃসঙ্গ নারীদের টার্গেট করে প্রতারণা করে আসছিলেন নড়াইলের বেনজির। প্রথমে প্রেমের ফাঁদে ফেলে, পরে বিয়ের প্রলোভন ও সপরিবার আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখাতেন। এভাবে বছরের পর বছর তিনি নারীদের সঙ্গে প্রতারণা করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেন। অবশেষে প্রতারিত এক নারীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে।

 

জানা গেছে, প্রথমে ফেসবুকে অপরিচিত একাউন্ট থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। একসেপ্ট করলে পরিচয় হয়। তারপর চলতে থাকে চ্যাট, অনলাইন আড্ডা। আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠ হয়ে দেখা করার প্রস্তাব আসে। দেখা করতে যাওয়া মানেই প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা দেয়া। এভাবে অনেক তরুণীকে অপহরণের ফাঁদ পাতে প্রতারক চক্র। তারপর আটকে রেখে ধর্ষণ, নিপীড়ন-নির্যাতন, সর্বস্ব বিলীন করে এক সময় পতিতালয়ে বিক্রির মত ঘটনাও ঘটছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুত্ব বা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে নারীদের যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার বানাচ্ছে এক শ্রেণির মানুষ।

 

ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজমের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের উপ-পুরিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে এ ধরনের ঘটছে। এখানে নিজেদের সাবধানতার বিকল্প কিছু নেই।

 

তিনি বলেন, ফেসবুকে যারা প্রতারণা করা তারা নানা কৌশল ব্যবহার করে। এতে অনেকেই আকৃষ্ট হতে পারে। কিন্তু যাছাই-বাছাই করা প্রয়োজন। আবেগের বশবর্তি হয়ে কোনো কিছু করতে গেলেই বিপদে পড়তে হয় এটা মনে রাখতে হবে।

 

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সাইবার ক্রাইম দল ইতোমধ্যে নানা ধরনের প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে। কোনো বিষয়ে সন্দেহ হলেই নিকটস্থ থানা বা পুলিশের বিভিন্ন হটলাইন নম্বর রয়েছে সেখানে কল করে সহযোগীতা পেতে পারে। আমারা সবাই একটু সচেতন হলেই এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে পারি।

 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, সারা দেশে ধর্ষণ ও দলবেঁধে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০১৮ সালে ৭৩২ জন, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ জন ও ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭ জন, ২০২১ সালে ১ হাজার ৩২১ জন এবং ২০২২ সালে ৯৩৬ জন, ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৫৮৩ জন।

 

তথ্য বলছে, গত কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় প্রতি বছরই গড়ে ১ হাজার ২৬০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার প্রায় অর্ধেকই ধর্ষণের।

 

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর তথ্যানুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। এ বছরের জুলাই পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ১১ হাজার ৯৫৯টি ফোনকল এসেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ৬১৯টি, ধর্ষণচেষ্টা ৩১৪টি, যৌন নির্যাতন ২৬৮টি, ধর্ষণের হুমকি ৩১টি এবং উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানির ১ হাজার ৯টি।

 

মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা হিউম্যান রাইটস ভয়েস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সভাপতি আব্দুল আওয়াল নয়ন খান বলেন, দেশজুড়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের ফলে মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে আইন করা হলেও নারী নির্যাতন বা ধর্ষণ কমছে না। এজন্য অপরাধীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান না দেখে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করা প্রয়োজন।

 

সমাজে নারী-শিশু নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. সানজীদা আখতার বলছেন, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানসিকতা থেকেই ক্ষমতা প্রয়োগের একটা কুৎসিত রূপ নারী নির্যাতন বা ধর্ষণ। পর্যায়ক্রমে ওই জায়গাগুলোতে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।

 

একই সঙ্গে নারী নির্যাতন, সহিংসতা বা ধর্ষণের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোরও একটা বিরাট প্রভাব।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version