-->

পলিথিন তৈরিতে শুভঙ্করের ফাঁকি

রাতেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে যায়

হেলাল সাজওয়াল
পলিথিন তৈরিতে শুভঙ্করের ফাঁকি

পলিথিনের লাগাম টেনে ধরা অনেক কঠিন। একের পর এক অজুহাত দাঁড় করিয়ে দেদারসে চলছে উৎপাদন। আবার রাতের আঁধারেই এগুলো পৌঁছে দেওয়া হয় প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এর পেছনে রয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কতিপয় কর্মকর্তারা, পুলিশ, সাংবাদিক ও রাজনীতিক নেতারা।

জানা গেছে, রাজধানীর পুরান ঢাকা এলাকায় রয়েছে অসংখ্য পলিথিন কারাখানা। এগুলোতে বৈধ পলিথিন উৎপাদনের নামে অবৈধ পলিব্যাগ তৈরি করা হচ্ছে। রপ্তানিযোগ্য কিছু পণ্য, প্যাকেজিং, নার্সারির চারা, রেণু পোনা পরিবহন ও মাশরুম চাষের জন্য পলিথিন উৎপাদনের ছাড়পত্র রয়েছে। এটার ওপর ভিত্তি করেই দেদারসে পলিব্যাগ তৈরি করা হচ্ছে। কখনো কখনো প্রশাসনের হাতে ধরা পড়লে তারা অস্ত্র হিসেবে ওইসব কাগজ দেখিয়ে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতা হলোÑ আইন অমান্য করে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, মজুদ ও বাজারজাত করা হচ্ছে। আর পলিথিন বাজারজাতকরণে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটটি এই পলিথিনগুলো তাদের নিজস্ব পরিবহনের ব্যানারে ট্রাকে করে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দেয়।

জানা গেছে, বিগত ১৫ বছর ধরে সরকার নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন ও সরবরাহে নিয়োজিত আছে অনেক পরিবহন কোম্পানি। চকবাজার, ইমামগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে পরিবহন (ট্রান্সপোট) এজেন্সি গড়ে উঠেছে শুধু এই পলিথিন পরিবহনের জন্য। এসব ট্রান্সপোর্টের মাধ্যমে বরিশাল, রংপুর, খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটসহ বিভিন্ন জায়গায় নিষিদ্ধ পলিথিন সরবরাহ করা হয়ে থাকে।সারাদেশে বিভিন্ন থানার ওসি এবং গণমাধ্যমকর্মী, সোর্সদের মাসহারা দিয়েই দেদারসে চলে নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবসা। দেশের বিভিন্ন থানায় পরিবেশ আইনে নিষিদ্ধ পলিথিনের মামলা হলেও মূল ব্যবসায়ীদের ওপর প্রভাব পড়ে না। কারণ এরা পুলিশ এবং প্রশাসন সব কিছু ম্যানেজ করেই ব্যবসা করে থাকেন।

জানা গেছে, ঢাকার চকবাজার থেকে সারা দেশে পলিথিন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে আছে একাধিক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এগুলোর মধ্যে হাজী জুয়েল সিন্ডিকেট, বিজয় ট্রান্সপোর্টের বাতেন, জাহাঙ্গীর ও মিরাজ সিন্ডিকেট অন্যতম। এরা সবাই চকবাজার থেকে সারা দেশে পলিথিন বাজারজাত করে থাকে। এ ছাড়াও অনেক ছোট ছোট ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি এবং কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পলিথিন ছড়িয়ে যায় সারাদেশে। রাজধানীর নয়া বাজার, বাবুবাজার, তাতীবাজার, ইংলিশরোডসহ আশপাশের সকল কুরিয়ার সার্ভিস এবং পণ্য পরিবহন এজেন্সিগুলো নিষিদ্ধ পলিথিন পারাপার করে থাকে। এমনকি বেশি ভাড়ায় যাত্রী পরিবহনের বাসের মালবক্সে পলিথিন বহন করা হয়। ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লায়ও কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার মালিকদের হাত অনেক লম্বা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নারায়ণগঞ্জের টাউনপাড়ায় একটি কারখানার মালিক জানান, আমার কারখানা ওপেন; এত বড় ঘরের মধ্যে মেশিনের শব্দ তো আর আটকে রাখা যায় না। আমরা পরিবেশকে ম্যানেজ করেই কারখানা চালাই। সরকার নিষিদ্ধ করলেই হবে ভাই; মানুষের প্রয়োজন আছে বলেই পলিথিন বানাই। এ কারণে পরিবেশের লোকও কিছু বলে না।

কুমিল্লা বিসিক এলাকায় নিষিদ্ধ পলিথিন কারখানার মালিক সবুজ ভোরের আকাশকে জানান, এতদিন কারখানা বিসিক শিল্প নগরীর মধ্যে থাকলেও বর্তমানে তার কারখানা ঢাকার ইসলামবাগে স্থানান্তর করেছেন। তিনি জানান, বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার কুমিল্লায় কারখানা নিয়ে আসবেন।

ক্ষতিকর জেনেও দিনের পর দিন পলিথিন ব্যবহার বেড়েছে; যা পরিবেশকে হুমকিতে ফেলেছে। ক্ষতির বিষয়টি জানলেও এতদিন কার্যত তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। ২০০১-০২ সালে তৎকালীন সরকারের বন ও পরিবেশমন্ত্রী শাহজাহান সিরাজ পলিথিনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এর উৎপাদন ও বিপণন প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছিল। এরপর সরকার পরিবর্তনের পর ধীরে ধীরে আবারও পলিথিনের উৎপাদন ও এর ব্যবহার শুরু হয়। যা বর্তমানে ব্যাপক আকারে রূপ নিয়েছে।

আইন অনুযায়ী, পলিথিন সামগ্রী উৎপাদনের জন্য অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড (জরিমানা) বা উভয় দণ্ড এবং আমদানি ও বাজারজাতকরণের প্রতিটি অপরাধের জন্য দুই বছর, অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা, অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড (জরিমানা) বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুত, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন ব্যবহারের জন্য অনধিক এক বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। আবার পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধী ন্যূনতম দুই বছর, অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা, অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুত, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রেও রয়েছে শাস্তির বিধান। এক্ষেত্রে অনধিক এক বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের দায়ে দুই বছর, অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা, অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন অপরাধীরা। এই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশে শত শত পলিথিন কারখানা তৈরি হয়। এসব কারখানায় দিনে কয়েক কোটি পলিথিন ব্যাগ উৎপাদিত হয়। রাজধানীর চকবাজার, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীর চর, কেরানীগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায় অসংখ্য কারখানায় রাতের আঁধারে চলে উৎপাদন।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version